আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা এরদোয়ান

মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির মৃত্যুর পর ইস্তাম্বুলে এক প্রতীকী জানাজায় যোগ দেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান
মিশরের ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট মুরসির মৃত্যুর পর ইস্তাম্বুলে এক প্রতীকী জানাজায় যোগ দেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান  © বিবিসি

মিশরকে সাথে নিয়ে উপসাগরীয় অধিকাংশ আরব দেশ তুরস্ককে কোণঠাসা করার উপায় খুঁজতে তৎপর হলেও সিংহভাগ আরব জনগণ মনে করেন, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানই তাদের সবচেয়ে বড় শুভাকাঙ্ক্ষী। তুরস্ক এবং প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ব্যাপারে আরব দেশের সরকার ও জনগণের এই বিপরীত অবস্থান উন্মোচিত হয়েছে সম্প্রতি প্রকাশিত আরব জনমতের ওপর একটি ব্যাপক-ভিত্তিক জরিপের ফলাফলে।

আরব বিশ্বের ১৩টি দেশে পরিচালিত হয় এই জনমত জরিপ। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৮ শতাংশই মনে করেন, অন্য যে কোনো দেশের নীতির তুলনায় তুরস্কের মধ্যপ্রাচ্যে নীতি আরব স্বার্থের পক্ষে। ফিলিস্তিন ইস্যু তো বটেই, এমনকি সিরিয়া এবং লিবিয়ায় তুরস্কের বিতর্কিত সামরিক হস্তক্ষেপও সিংহভাগ আরব জনগণ সমর্থন করছে। তুরস্কের পর চীন ও জার্মানির মধ্যপ্রাচ্য নীতির প্রতি আরবদের মনোভাব সবচেয়ে ইতিবাচক। চীনের নীতির প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন ৫৫ শতাংশ, আর জার্মানির নীতির পক্ষে ইতিবাচক মতামত দেন ৫২ শতাংশ উত্তরদাতা।

উল্টোদিকে, সবচেয়ে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ পেয়েছে আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির ব্যাপারে। এশিয়া ও আফ্রিকায় আরব বিশ্বের ১৩টি আরব রাষ্ট্রে বিভিন্ন জাতীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সাধারণ আরব জনগণের মনোভাব জানতে এই জরিপটি করেছে দোহা এবং বৈরুত ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ‘আরব সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি স্টাডিজ’।

লন্ডনে রাজনৈতিক ঝুঁকি সম্পর্কিত গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারেস্টের প্রধান এবং মধ্যপ্রাচ্য রাজনীতির বিশ্লেষক সামি হামদি মনে করেন, তুরস্ক রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান যে সাধারণ আরব জনগণের বিরাট একটি অংশের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছেন, তা নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই।

হামদি বলেন, ‘সন্দেহ নেই তুরস্কের গ্রহণযোগ্যতা, বিশেষ করে সাধারণ প্রান্তিক আরব জনগোষ্ঠীর কাছে, বাড়ছে। গ্রহণযোগ্যতা বাড়ার পেছনে তুরস্ক রাষ্ট্রের চেয়ে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ানের ভাবমূর্তি প্রধান ভূমিকা রাখছে। এরদোয়ানের আগের তুরস্ক এবং এরদোয়ান পরবর্তী তুরস্ক যে অনেক আলাদা আরবরা তা বুঝতে পারছে।। তারা জানে তুরস্কের নতুন যে বিদেশ নীতি তার স্রষ্টা এককভাবে এরদোয়ান।’

সামি হামদির মতে, এরদোয়ানের আগের তুরস্ককে আরবরা দেখতো একটি নিপীড়নকারী রাষ্ট্র হিসাবে- যারা আরব এবং মুসলিমদের স্পর্শকাতরতাকে তোয়াক্কা করতো না। এটি ঐতিহাসিক সত্য যে একসময় আরবরা যখন স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের দাবি আদায়ে এককাট্টা হয়ে কাজ করছিল, তুরস্ক তখন পুরো উল্টোপথে গিয়ে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু আরবরা এখন দেখছে প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান তুরস্কের সেই অবস্থান বদলে দিয়েছেন। মিশর, ইউএই (সংযুক্ত আরব আমিরাত), তিউনিসিয়া এবং এমনকি সৌদি শাসকরা যখন আরবদের চিরাচরিত মুসলিম পরিচিতি এবং সত্ত্বাকে খাটো করার চেষ্টা করছেন, মিস্টার এরদোয়ান তখন মুসলিম পরিচিতি তুলে ধরতে দ্বিধাহীনভাবে সোচ্চার। এটা আরব বিশ্বের বহু মানুষকে আকৃষ্ট করছে।

হামদি মনে করেন, এরদোয়ানের তুরস্কের প্রতি এই মুগ্ধতার সাথে ‘আরব বসন্ত‘ পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতির যোগসূত্র রয়েছে। আরব বসন্তের পর মিশরসহ যেসব দেশে নির্বাচন হয়েছিল, তাতে প্রধানত ইসলামপন্থীরা জয়ী হলেও কিছুদিনের মধ্যে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বিশেষ করে মিশরে নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুড সরকারকে টেনে-হিঁচড়ে নামানো এবং তা নিয়ে পৃথিবীর অনেক ক্ষমতাধর দেশ যেভাবে চুপ ছিল, অনেক মানুষ তাতে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। তারা মনে করেছে, একটি মুসলিম পুনঃজাগরণ ঠেকাতে চক্রান্ত হয়েছে।

ফলে, সামি হামদির মতে, তুরস্কের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যখন জোর গলায় ইসলামী সত্ত্বার কথা বলেন, তখন আরব বিশ্বের বহু মানুষ মনে করে যে তিনি আসলে তাদেরই মনের কথা বলছেন। আরব বিশ্বের মানুষ দেখছে এরদোয়ান একজন ইসলামপন্থী হলেও গণতান্ত্রিক তুরস্কের রাজনীতিতে তিনি একচ্ছত্র প্রাধান্য বিস্তার করতে পেরেছেন। তিনি তার দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন দিয়েছেন, দেশের সামরিক শক্তি বাড়িয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া বা ইউরোপের মত বড় বড় শক্তির সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলছেন। এতে বহু আরব মুগ্ধ হচ্ছেন।

তিনি বলেন, আরবদেরও স্বপ্নও তেমন, তারা তাদের নিজেদের দেশকে, নিজেদের সরকার এবং নেতাদের এভাবেই দেখতে চায়। ফলে এরদোয়ানের সাথে তারা নিজেদের মেলাতে পারছেন, এরদোয়ানের মধ্যে তারা বাস্তবে একটি আদর্শ মুসলিম নেতা খুঁজে পাচ্ছেন।

জনমত জরিপে ফিলিস্তিন ইস্যুতে সাধারণ আরব জনগণের আবেগের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে ইচ্ছুক আরব নেতাদের মাথাব্যথার কারণ হতে পারে। ফলাফলে দেখা গেছে, এখনও ৮৯ শতাংশ আরব মনে করেন যে ফিলিস্তিন ইস্যু বিচ্ছিন্ন কোনো ইস্যু নয়, বরঞ্চ এটি একটি আরব ইস্যু। এমনকি উপসাগরীয় দেশগুলোর জনগণের মধ্যেও এই মনোভাব এখনও খুবই জোরালো।

জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, এখনও ৮৮ শতাংশ আরব ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিপক্ষে। মাত্র ছয় শতাংশ সমর্থন করে। কেন? - এ প্রশ্নে উত্তরদাতারা প্রধান কারণ হিসাবে ফিলিস্তিনীদের প্রতি ইসরায়েলের ‘বর্ণবাদী আচরণ‘ এবং ফিলিস্তিনী ভূমি ‘জবর-দখল’ করার কথা উল্লেখ করেছেন। কোন দেশ আরবদের নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি - এমন এক প্রশ্নের জবাবে ৬৬ শতাংশ উত্তরদাতাই ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলেছেন।

অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েলের ব্যাপারে এই বৈরী জনমত বুঝেই হয়ত ইহুদি ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন নিয়ে সৌদি শাসকরা দোটানায় পড়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপসাগরীয় রাজনীতির বিশেষজ্ঞ গিওর্গিও ক্যাফেইরো কিছুদিন আগে টুইট করেন, ‘অনির্বাচিত আরব শাসকদের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করা আর আরব জনগণের সাথে সম্পর্ক স্থাপন এক বিষয় নয়। ইসরায়েল নিয়ে মিশরের জনগণের মনোভাবের দিকে তাকালেই তা বোঝা যায়। ইরান এবং তুরস্ক মধ্যপ্রাচ্যের এই বাস্তবতাকে ব্যবহার করবে।’

তবে সামি হামদি বলেন, ফিলিস্তিন ইস্যুতে তুরস্কের অবস্থান কিছুটা জটিল ও স্ব-বিরোধী, এবং শুধু এই ইস্যু ব্যবহার করে সৌদি আরব বা ইউএইকে ঘায়েল করা তাদের জন্য অসুবিধা হবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, তুরস্ক নিজেরাই ইসরায়েলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ধরে রেখেছে। দুই দেশের মধ্যে নিয়মিত বিমান যোগাযোগ চালু রয়েছে এবং দুটো দেশের মধ্যে ব্যবসাও চলছে।

‘তবে এটা ঠিক এমন একটি ধারণা আরব দুনিয়ায় জোরালো হচ্ছে যে অনেক আরব দেশ যেখানে তাদের বহুদিনের নীতি ছুঁড়ে ফেলে ফিলিস্তিনী স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতে প্রস্তুত হচ্ছে, সেখানে মিস্টার এরদোয়ান তার দেশের অবস্থান পরিবর্তন করে ফিলিস্তিনীদের পক্ষ নিয়েছেন।’ যোগ করেন তিনি।

প্রশ্ন হলো, আরব শাসকেরা কি তাদের জনগণের মধ্যে এরদোয়ানের এই প্রভাব নিয়ে আদৌ বিচলিত? সাদি হামদি বলেন, আরব নেতাদের সামনে রাস্তা দুটো- এরদোয়ানের সাথে সন্ধি করা অথবা তার মোকাবেলা করা। ‘অনেক আরব শাসক মনে করেন, এরদোয়ান নতুন এক অটোম্যান সম্রাট হতে চাইছেন। তারা তাই ইসরায়েল এবং আমেরিকার সাথে মিলে এরদোয়ানকে সামলানোর চেষ্টাই করছেন।’

তার মতে, জনমতের ব্যাপারে এখনও অধিকাংশ আরব শাসক খুব বেশি গুরুত্ব দিতে রাজী নন। বরঞ্চ, তিনি বলেন, ইসরায়েলের সাথে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নিয়ে সৌদি রাজপরিবারের একাংশের মধ্যে এখনও যে দ্বিধা, তার পেছনে বৃহত্তর মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগই বেশি প্রাধান্য পাচ্ছে। সৌদি রাজপরিবার মক্কা ও মদিনার মসজিদের রক্ষক। বৃহত্তর ইসলামী দুনিয়ায় তাদের সেই মর্যাদা এবং গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ হওয়া নিয়ে তারা বেশি চিন্তিত।’ খবর: বিবিসি বাংলা।


সর্বশেষ সংবাদ