চার বছরে ক্যান্সারের ৮২ কেমো, তবুও উচ্চ মাধ্যমিকে নবম হার না মানা অদ্রিজা
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ০১ নভেম্বর ২০২৫, ১০:০০ AM
ষষ্ঠ শ্রেণির গণ্ডি পেরোতে না পেরোতেই শরীরে বাসা বাঁধে ক্যান্সার। মারণরোগের থাবা থেকে মুক্তির লড়াই চলেছিল চার বছর। ভারতের মুম্বই-কলকাতা একাকার করে জিতে এসেছেন স্কুলশিক্ষিকা মা আর তাঁর ছোট্ট মেয়ে। এবার সেই মেয়ের মুকুটে নতুন পালক। অদ্রিজা গণ এবার উচ্চ মাধ্যমিকের প্রথম পর্বের পরীক্ষায় সম্ভাব্য সেরা দশে জায়গা করে নিয়েছে। ৯৭.৩৭ শতাংশ নম্বর নিয়ে সে হয়েছে নবম।
শুক্রবার সেমিস্টার পদ্ধতিতে উচ্চ মাধ্যমিক প্রথম পর্বের ফল ঘোষণা হয়েছে। নিজের নাম শুনেই খুশি অদ্রিজা। তার ভাষ্য, ‘ভীষণ খুশি, কিন্তু এখনই তেমন আনন্দ করার সময় নেই। সামনে পরীক্ষা। ভালো ফল সেখানেও করতে হবে।’
ষষ্ঠ শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষার শেষ হওয়ার পরই টি-সেল লিম্ফোমা ক্যান্সার ধরা পড়েছিল উত্তর ২৪ পরগনার নিমতার বাসিন্দা অদ্রিজার। তড়িঘড়ি শুরু হয় চিকিৎসা। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে পেরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন তার ঠাকুমাও। এক দিকে মেয়ে, অন্য দিকে মা— দিশাহারা হয়ে পড়েন অদ্রিজার বাবা জয়মঙ্গল গণ।
তিনি নিজে টাকি হাউস গভর্নমেন্ট স্পনসর্ড মাল্টিপারপাস বয়েজ় স্কুলের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। সে সময় হাল ধরেন মা জ্যোতি গণ। বেলঘরিয়া বয়েজ় স্কুলের শিক্ষিকা জ্যোতি একাই লড়াই শুরু করেন মেয়েকে নিয়ে। তাকে মুম্বাই নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করিয়ে আনেন তিনি একাই।
একের পর এক ৮২টি কেমো, চার বছর পর সুস্থ হয়েছে অদ্রিজা। এ লড়াইয়ে পাশে থেকেছেন মা ও মেয়ের স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারাও। মেয়ের কৃতিত্বে ভীষণ খুশি জ্যোতি। তিনি বলেন, ‘পড়াশোনা নিয়ে জোর করিনি কোনও দিন। যেমন ভাল লাগে, তেমন ভাবেই এগিয়ে যাক ওরা। তার নিজের তাগিদ রয়েছে, তাই আশা রাখছি, ভবিষ্যতেও ভালো হবে।’
লাগাতার কেমো, স্কুলের মাতাজি, শিক্ষিকাদের সাহচর্যে, নিয়মিত থেরাপির সাহায্যে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে আদ্রিজা। ২০২১ সালে পুরোপুরি রোগমুক্ত হয় সে। মেয়ের জন্য মা রাতের পর রাত জেগেছেন, কথা বলতে বলতে গলা ধরে আসে তার বাবার। এখনও প্রতি বছর মুম্বইয়ের হাসপাতালে গিয়ে সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে আসতে হয় মেয়েকে।
তার কথায়, ‘মেয়ে আমার নবম হয়েছে, সেটা অবশ্যই ভাল খবর। কিন্ত যেভাবে ও এত কিছু পেরিয়ে জীবনের লড়াইটা জিতেছে, আমি তাতে বেশি খুশি।’
অদ্রিজার দিদি সৃজা বর্তমানে সিএসআইআর-ইউজিসি নেট-এর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বোনের এমন ফলে উৎফুল্ল তিনিও। তার ভাষ্য, ‘ও নিজের মতো করে পড়াশোনা করেছে, কোথাও আটকালে আমি দেখিয়ে দিয়েছি। তা ছাড়াও ওর মনের এত জোর, ও নিজেই নিজের সমস্যার মোকাবিলা করেছে। আমি খুবই খুশি।’
আরও পড়ুন: ইউক্রেনকে টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র দিতে পেন্টাগনের সবুজ সংকেত
যার মনের জোর নিয়ে এত চর্চা, এত আলোচনা, সেই অদ্রিজা নিজে পড়াশোনা করতে চায় ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে। মানুষের আচরণের বৈচিত্র আগ্রহের বিষয়। মন খারাপের সমাধান করতে চায়। অবসাদে ডুবে যাওয়া প্রজন্মের জন্য তার পরামর্শ, সবার সমস্যা মন দিয়ে শুনে সমাধান করা যেতে পারে। তার জন্য ছোট ছোট পদক্ষেপ করতে পারলে হয়তো পরিস্থিতি বদলাবে।
স্কুলের বন্ধুরাও যে তার পাশে থেকেছে, সেটাও জানাতে ভোলেনি কৃতী। স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট টিচার নির্বাণপ্রাণা মাতাজি জানিয়েছেন, অদ্রিজা খুব বাধ্য ছাত্রী। পড়াশোনার বিষয়ে যথেষ্ট মনোযোগী। এত ভালো ফল করায় স্কুলের সবাই খুব খুশি।
তিনি বলেন, অত ছোট বয়সেও ও নিজের সমস্যার কথা বুঝেছে। সুস্থ হতে চেয়েছে শুরু থেকেই। বাঁচার স্পৃহাই ওকে শক্তি দিয়েছে। কঠিন সময়ে ও বার বার শুনেছে বা শুনতে চেয়েছে প্রার্থনাসঙ্গীত। শিক্ষিকা, সহপাঠী, দিদিরা— সবাই ওর জন্য প্রার্থনা করেছে। এ সবই ওকে এগিয়ে নিচ্ছে।
অদ্রিজার রাত জাগা নিষেধ। তাই, স্কুলে যতক্ষণ পড়ানো হত, ততটুকুই। বাড়িতে ফিরে শুধু একবার চোখ বোলানো। পড়াশোনার বাইরেও বাংলা সাহিত্যে আগ্রহ অদ্রিজার। পছন্দের লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সায়ন্তনী পুততুন্ড বা অর্পিতা সরকার। গান শুনতে ভালো লাগে তার। প্রিয় শিল্পী শ্রেয়া ঘোষাল এবং অরিজিৎ সিং। খবর: আনন্দবাজার।