যে গ্রামে শত শত পুরুষকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেছিল তাদের স্ত্রীরা
- বিবিসি
- প্রকাশ: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:২৯ AM , আপডেট: ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮:৩০ AM
সময়টা ১৯২৯ সালের ডিসেম্বর। হাঙ্গেরির ছোট শহর সলনোকের একটি আদালতে চলছিল একটি চাঞ্চল্যকর বিচার। মামলাটি ঘিরে ছিল নাগিরেভ নামের একটি ছোট্ট গ্রাম, যেখানে স্বামীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করার অভিযোগে একে একে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন গ্রামের বহু নারী।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিষ প্রয়োগে পুরুষ হত্যা মামলায় প্রায় ৫০ জন নারীকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। তদন্তে বেরিয়ে আসে, ১৯১১ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে বুদাপেস্ট থেকে ১৩০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত কৃষক অধ্যুষিত নাগিরেভ গ্রামে ৫০ জনেরও বেশি পুরুষকে ধীরে ধীরে আর্সেনিক দিয়ে হত্যা করা হয়।
এই নারীরা পরে 'এঞ্জেল মেকার' নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন—একটি শব্দ যার মাধ্যমে বোঝানো হয়, যেসব নারী কাউকে (বিশেষ করে স্বামী বা অবাঞ্ছিত সন্তান) হত্যা করে তাকে ‘পরলোক’ পাঠায়।
বিচার প্রক্রিয়ায় যাঁর নাম সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তিনি ঝুঝানা ফাজেকাশ। পেশায় ধাত্রী, কিন্তু গ্রামে কোনো চিকিৎসক বা পুরোহিত না থাকায় কার্যত তিনিই ছিলেন চিকিৎসা সহায়তার একমাত্র ভরসা। ঔষধি ও রাসায়নিক সম্পর্কে তাঁর জ্ঞানই তাঁকে ‘বিশ্বাসের প্রতীক’ করে তুলেছিল।
নাগিরেভ ছিল তিজা নদীর তীরে অবস্থিত একটি কৃষক অধ্যুষিত বসতি। ওই অঞ্চলে বিয়ের বিষয়গুলো সাধারণত পারিবারিকভাবে নির্ধারিত হতো। খুব অল্প বয়সী নারীদের জোর করে বিয়ে দেওয়া হতো বয়সে অনেক বড় পুরুষের সঙ্গে। এসব বিয়ে ছিল জমি, সম্পত্তি ও আইনি চুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়া, যার কোনো পরিণতি divorce বা বিচ্ছেদ হতে পারতো না।
ঝুঝানা ফাজেকাশ গ্রামের পাশেই একটি একতলা বাড়িতে থাকতেন। গ্রামীণ নারীরা নিয়মিত তাঁদের স্বামীদের নির্যাতনের কথা জানাতে তাঁর কাছে যেতেন। মারিয়া গুনিয়া, যার বাবা ছিলেন স্থানীয় একজন কর্মকর্তা, ২০০৪ সালে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানান, “নারীরা যখন বলত তাদের স্বামী মদ খায়, মারধর করে, ধর্ষণ করে, তখন ফাজেকাশ বলতেন—তোমার জন্য আমার কাছে একটা সমাধান আছে।”
সেই সমাধান ছিল ঘরোয়া উপায়ে তৈরি করা আর্সেনিক। ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য টাইমস জানায়, ফাজেকাশের বাড়ির আঙিনায় পুঁতে রাখা অবস্থায় বিষের শিশি পাওয়া যায়।
সালগুলো গড়াতে থাকে, আর কবরস্থানে বাড়তে থাকে মৃত স্বামীদের কবর। অবশেষে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সন্দেহ করতে শুরু করে এবং মৃতদেহ উত্তোলনের নির্দেশ দেয়। পরীক্ষা করা ৫০টি মৃতদেহের মধ্যে ৪৬টিতে আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যা বিষ প্রয়োগের প্রমাণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
সন্দেহের তীর তখন পুরোপুরি ঝুঝানা ফাজেকাশের দিকে ঘুরে যায়। পুলিশ যখন তাঁকে গ্রেপ্তার করতে বাড়িতে যায়, তখন দেখা যায় তিনি নিজের কাছে থাকা বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছেন।
পুলিশের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথম হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছিল ১৯১১ সালে, যেই বছর ফাজেকাশ গ্রামে এসেছিলেন। অর্থাৎ তিনি এসেই বিষ প্রয়োগের এক নারকীয় অধ্যায়ের সূচনা করেন, যা দুই দশক ধরে অব্যাহত ছিল।
তবে এই ঘটনার জন্য কেবল ফাজেকাশকে একক অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা হয়নি। ১৯২৯ সালে সলনোক শহরের আদালতে ২৬ জন নারীর বিরুদ্ধে বিচার শুরু হয়। তাঁদের মধ্যে আটজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সাতজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
তবে নারীদের খুব কমজনই দোষ স্বীকার করেছিলেন। কেন তাঁরা এমন করলেন, তার পূর্ণ ব্যাখ্যা আজও অজানা। বিভিন্ন প্রতিবেদনে নানা তত্ত্ব উঠে আসে—দারিদ্র্য, লোভ, একঘেয়েমি, বা অনিচ্ছাকৃত বিবাহ—সবই ছিল এর পেছনে অনুঘটক।
কিছু তত্ত্ব বলছে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় গ্রামের পুরুষরা ফ্রন্টলাইনে গেলে তাদের স্ত্রীরা রুশ যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। পুরুষরা যখন যুদ্ধে শেষে বাড়ি ফিরে আসেন, তখন নারীরা হঠাৎ হারানো স্বাধীনতায় ক্ষুব্ধ হয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেন।
শুধু নাগিরেভ নয়, কাছাকাছি টিজাকুর্ট শহরেও একই ধরনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এবং সেখানে উত্তোলিত মৃতদেহেও আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যায়, যদিও কেউ দোষী সাব্যস্ত হয়নি। গবেষকদের মতে, এই এলাকায় বিষ প্রয়োগে হত্যা হওয়া পুরুষের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
সময়ের আবর্তে নাগিরেভে সেই ভয়াবহ ঘটনার স্মৃতি আজ অনেকটাই মুছে গেছে। এখন আর গ্রামের নাম শুনে কেউ আঁতকে ওঠে না। তবে মারিয়া গুনিয়ার কথায়, তখনকার সেই নারকীয় ঘটনার পর গ্রামের পুরুষদের আচরণে ‘উল্লেখযোগ্য উন্নতি’ দেখা গিয়েছিল।