মিয়ানমার থেকে মণিপুরে ফিরছেন যোদ্ধারা, বাড়ছে সহিংসতার শঙ্কা

  © রয়টার্স

ভারতীয় বিচ্ছিন্নতবাদী সশস্ত্র বিভিন্ন গোষ্ঠীর অনেক সদস্য মিয়ানমারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। যুদ্ধের কঠিন প্রশিক্ষণ নেওয়া সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের সহিংসতায় বিধ্বস্ত মণিপুর রাজ্যে ফিরছেন। ফলে মণিপুর রাজ্যের ১৯ মাসের তিক্ত জাতিগত সংঘাত আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। শুক্রবার (২০ ডিসেম্বর) ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের বরাতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

মণিপুরের প্রভাবশালী হিন্দু মেইতেই সম্প্রদায় এবং প্রধানত খ্রিস্টান কুকি উপজাতির মধ্যে সহিংসতা বেড়ে গেছে, যে সংঘাত সমালোচকদের মতে- ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ১১ বছরের শাসনামলে সবচেয়ে বড় আইন-শৃঙ্খলা ব্যর্থতা। ২০২৩ সালের মে মাস থেকে এ পর্যন্ত লড়াইয়ে প্রায় ২৬০ জন নিহত এবং ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

ভারতের নয়জন সামরিক ও পুলিশ কর্মকর্তা এবং মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ ও বিদ্রোহী সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলোর ক্যাডাররা সীমান্ত পেরিয়ে মণিপুরে ঢোকায় নতুন নতুন এলাকায় সংঘাত ছড়িয়ে পড়ছে।

এই যোদ্ধারা রকেট লঞ্চারসহ অনেক আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত। কেবল নভেম্বরেই লড়াইয়ে ২০ জন নিহত হয়েছে। প্রতিক্রিয়া হিসাবে, ফেডারেল সরকার ঘোষণা করেছে, তারা মণিপুরে আরও ১০,০০০ সেনা মোতায়েন করছে। ৩০,০০০ শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী ছাড়াও মোট সেনা সংখ্যা প্রায় ৬৭,০০০।

এই সহিংসতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে অপরাধ প্রবণতা। পুলিশ ও সামরিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর অস্ত্র ও তৎপরতায় অর্থায়নের জন্য অপরাধ বৃদ্ধি পেয়েছে- যার মধ্যে আছে মূলত চাঁদাবাজি এবং অবৈধ মাদক ব্যবসা।

মণিপুরের সাবেক পুলিশ প্রধান ২০১৭ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজ্যের উপ-মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ইয়ুমনাম জয়কুমার সিং বলেন, “১০ বছর আগে আমরা যে বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণ করেছিলাম, তারা আবারও সুযোগ বুঝে বিরোধ তৈরি করছে।”

তিনি বলেন, “কিছু যোদ্ধা মিয়ানমার থেকে ফেরত আসছে। আর কিছু এরই মধ্যে এসেছে।” তবে এ বিষয়ে মন্তব্যে অনুরোধে ফেডারেল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, মণিপুর পুলিশ এবং মিয়ানমারের জান্তা কোনও সাড়া দেয়নি।

বাংলাদেশের পূর্বদিকে পড়েছে মণিপুর এবং মিয়ানমারের সঙ্গেও এর সীমান্ত রয়েছে। এই রাজ্যে ৩২ লাখ মানুষের বাস। তাদের অর্ধেকের বেশিই মেইতেই জনগোষ্ঠীর। কুকি ও নাগারা মিলে মোট জনগোষ্ঠীর ৪৩ শতাংশ। মে মাসের শুরুতে রাজ্যটিতে সংঘাত শুরু হয়।

সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে চেষ্টা চালাচ্ছে সেনাবাহিনী, আধা সামরিক বাহিনী ও পুলিশ। তবুও সেখানে বহু মানুষ হতাহত হচ্ছে। সমস্যার শিকড়ে রয়েছে মেইতেই জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কুকিসহ বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর এক আইনি লড়াই।

স্বাধীনতার পর থেকে, খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কুকি সম্প্রদায় তফসিলি উপজাতির মর্যাদা পেয়েছে। অন্যদিকে মেইতেইরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের একটা অংশ যেমন সংরক্ষণের সুযোগ সুবিধা পাননি, তেমনই আরেকটি অংশ আবার তফসিলি জাতিভুক্ত হয়েছেন কেউ আবার অন্যান্য পিছিয়ে পড়া শ্রেণীতে নাম তুলেছেন।

গত মার্চে মণিপুর হাইকোর্ট এক নির্দেশে রাজ্য সরকারকে বলেছিল, মণিপুরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই জনগোষ্ঠী তফসিলি উপজাতি হিসেবে সংরক্ষণ পেতে পারে কি না, তা খতিয়ে দেখতে। এ নির্দেশ প্রকাশ আদালতের ওয়েবসাইটে প্রকাশ পেতেই বিক্ষোভ শুরু করে উপজাতি সম্প্রদায়। মণিপুরের রাজধানী ইম্ফলের আশেপাশে সহিংসতা ছড়াতে শুরু করে।

সহিংসতা কমানোর চেষ্টায় নিরাপত্তা বাহিনী দুই গোষ্ঠীর মধ্যে একটি বাফার জোন তৈরি করেছে। রাজ্যটিতে বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে। সম্প্রতি কয়েক দশকে অনেক জঙ্গি সামরিক অভিযানের পরে সীমান্ত পেরিয়ে পালিয়ে গেছে।

নিরাপত্তা কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, মেইতেই গোষ্ঠীগুলো মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধে ক্ষমতাসীন জান্তার পক্ষে লড়াই করছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত তাদের আনুমানিক দুই হাজার সদস্য মণিপুরের সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সাগাইং অঞ্চলে শিবির স্থাপন করেছে।

তারা মিয়ানমারের জান্তা-বিরোধী পিপলস ডিফেন্স ফোর্সের মতো কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে লড়ছে। আবার কুকি সম্প্রদায়কে সমর্থন করে মিয়ানমারের কাচিন বিদ্রোহীরা।

কিছু মেইতেই যোদ্ধা আগে মিয়ানমারের শিবির থেকে অভিযান পরিচালনা করত। কিন্তু এখন তারা সীমান্ত এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে এবং মণিপুরে ফিরছে-বলেছেন, মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী বিদ্রোহী গোষ্ঠী চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের ভাইস চেয়ারম্যান।

ভারতীয় সেনা ও পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, ফিরে আসা সশস্ত্র যোদ্ধাদের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। তবে মিয়ানমার সীমান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়া কয়েকজনসহ শতাধিক মেইতেই বিদ্রোহীকে গত বছর মণিপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

তাছাড়া, চলতি বছর দুই শতাধিক মেইতেই বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে এক নিরাপত্তা কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য এবং সরকারি উপাত্ত পর্যালোচনা করে জানিয়েছে রয়টার্স। একই সময়ে প্রায় ৫০ জন কুকি বিদ্রোহীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলেও দেখা গেছে সরকারি তথ্যে।

সামরিক বাহিনী যোদ্ধাদের কাছ থেকে যেসব অস্ত্র জব্দ করেছে তাতে দেখা গেছে, এই মেইতেই ও কুকি যোদ্ধাদের কাছে আছে- রকেট লঞ্চার, মেশিনগান, স্নাইপার এবং অ্যাসল্ট রাইফেল। আরও আছে বিদেশি এম১৬, এম৪এ১এস এবং একে-৪৭’ও।

কর্মকর্তারা বলেন, মণিপুরে প্রথমদিককার সংঘাতের সময় রাষ্ট্রীয় অস্ত্রাগার থেকে লুট হওয়া অস্ত্রই এখনও সেখানকার সংঘাতে ব্যবহার হয়ে আসলেও এখন সেখানে যোগ হচ্ছে মিয়ানমার থেকে আসা আরও অত্যাধুনিক সব অস্ত্র। এই অস্ত্রগুলো মূলত এ বছর থেকেই সংঘাতে ব্যবহার হচ্ছে।

ধরা পড়া বিদ্রোহীদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ভারতীয় কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, মণিপুরের মেইতেই অধ্যুষিত উপত্যকা এলাকায় আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার অবৈধ অস্ত্র আমদানি হয়েছে। আর কুকি এলাকায় আমদানি হয়েছে প্রায় ২০০০ অস্ত্র।

সরকারি অস্ত্রগার থেকে মেইতেইদের লুট করা প্রায় ৫,০০০ অস্ত্র এবং কুকিদের লুট করা প্রায় ১,০০০ টি অস্ত্রের সঙ্গে যোগ হয়েছে আমদানি করা এইসব অবৈধ অস্ত্র।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence