বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ইংরেজি-মাদ্রাসা মাধ্যমকে উপেক্ষা করা হয়

  © টিডিসি ফটো

বিদেশী ছাত্রছাত্রী থাকলে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেই পরিবেশ পেত সেই পরিবেশের কাছাকাশি পরিবেশ দিতে পারতাম যদি আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন ধারার শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে পাশ করা ছাত্র-ছাত্রীদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দিতে পারতাম।

বর্তমান ভর্তি পরীক্ষা কেবল বাংলা মিডিয়ামকেই বিবেচনায় নেওয়া হয়। আমাদের ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা মাধ্যমকে নেগলেক্ট করা হয়। অথচ এরা সবাই এই দেশের নাগরিক এবং সকলেরই সমান রাইট আছে। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয় যেমন এমআইটি, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মত প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারলেও নিজ দেশে ভর্তি পরীক্ষার হার্ডল পার হতে পারেনা যার কারণ আমি নিচে ব্যাখ্যা করব।

আমাদের দেশে এখন প্রচুর ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রী আছে। তাদের কাররিকুলাম আমাদের বাংলা মিডিয়ামের কাররিকুলাম থেকে একটু ভিন্ন। এই ছাত্র-ছাত্রীদের একটি অংশ SAT এবং টোয়েফল দিয়ে দেশের বাহিরে চলে যায় এবং আরেকটি অংশ দেশের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। আর এদের খুব ক্ষুদ্র একটি অংশ বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারে। এদের জন্য আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়য়ের ভর্তি পরীক্ষাগুলো মোটেই সহায়ক নয়।

যারা ভর্তি হতে পারে তারা A-লেভেল পরীক্ষা দিয়েই ৬ মাস ধরে বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে বাংলা মাধ্যমের সিলেবাস পড়ে ও বাংলা মাধ্যমের প্রশ্নের ধারার সাথে পরিচিত হয়। এইটা ফেয়ার না। আমরা আমাদের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দুই সিলেবাসের কমন বিষয়ের উপর করতে পারতাম। অনেক কিছুই কমন আছে।

ছাত্রছাত্রীদের একটি অংশ যদি দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়তে পারতো তাহলে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ার কারণে বাংলা ভাষা ও দেশের কৃষ্টি কালচার সম্মন্ধে তাদের যতটুকু জানার অভাব আছে সেটা পূরণ হতো। একটি উদাহরণ দিলে সম্ভবত বিষয়টা বোঝাতে সহজ হবে। আমাদের EEE বিভাগে আমাদের একজন সহকর্মী আছে যার নাম ড. মাইনুল হোসেইন (Mainul Hossain)।

সে ইংরেজি মাধ্যমে পড়ে পড়ে আমাদের EEE বিভাগ (তৎকালীন ইলেকট্রনিকস এন্ড অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স) থেকে পাশ করে আমেরিকা থেকে পিএইচডি করে Globalfoundries (যারা IBM কে কিনে নিয়েছে ) এর মত বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্টানের আর এন্ড ডিতে গবেষণা করে দেশে ফিরে এসেছে। তার গবেষণাপত্রের সংখ্যা, সাইটেশন সংখ্যা উল্লেখ করার মত। শুধু তাই না দেশে এসে সেই বিভাগ থেকে নিয়মিত খ্যাতিমান জার্নালে গবেষণাপত্র প্রকাশ অব্যাহত রেখেছে। ড. মাইনুল হোসেইন হতে পারে একটি সেরা উদাহরণ।

আমরা যদি এইরকম আরো বেশি ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করতে পারতাম তাহলে আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান বাড়তো। এই ছাত্রছাত্রীরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়ায় এরা বাংলা ভাষায় একটু দুর্বল হয়। এছাড়া দেশি সংস্কৃতি সম্মন্ধে একটু কম জানে। এদের এই দুর্বলতাগুলো দূর করার দায়িত্বতো আমাদেরই। এরাতো আমাদেরই সন্তান এবং এই দেশেই থাকতে চায়। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লে এরা সেই দুর্বলতাগুলো কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারতো।

ড. মাইনুল হোসেইন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার কারণে এখন তার সাথে কথা বললে কারো বোঝার উপায় নেই যে সে ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্র ছিল। ওর বাংলা ভাষা এবং বাংলা সাহিত্যের উপর নলেজ দেখে আমি অভিভূত। ইংরেজি মাধ্যমের ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করলে যে কেবল তারাই উপকৃত হবে তা নয়, তাদের উপস্থিতির কারণে বাংলা মিডিয়ামের ছাত্র-ছাত্রীরাও উপকৃত হতো বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা ব্যাকগ্রউন্ডের ছাত্রছাত্রী থাকলে একটা কম্পেটিটিভ এনভায়রনমেন্ট তৈরী হয় যার মাধ্যমে সকলেই সকলের দ্বারা উপকৃত হয়।

আমি আশা করি, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ও ইউজিসি বিষয়টা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করবে। আমাদের ব্রেইন ড্রেইনকে প্রতিরোধ করতে এর কোন বিকল্প নেই।

লেখক: অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ