শুভ বড়দিন
ভাববাণী পূর্ণ করে শান্তির বার্তা নিয়ে মশীহ এলেন এই জগতে!
- জগেশ রায়
- প্রকাশ: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:১৮ PM , আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:২৭ PM
২৫ ডিসেম্বর ২০২৫, শুভ বড়দিন। যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন। এই দিনটা খ্রিস্ট বিশ্বাসীসহ সকল সম্প্রদায়ের মানুষ যার যার মতো পালন করছেন। এটা সবার জন্য খুবই আনন্দের দিন। তবে খ্রিষ্ট বিশ্বাসীদের কাছে বড়দিন মানে শুধু উৎসববের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এই উৎসবের মাধ্যমে ঈশ্বরের অসীম প্রেমকে স্মরণ করা হয়। বড়দিন মানে শুধু গির্জায় যাওয়া, কেক খাওয়া, আলোক সজ্জায় নিজেকে রঙিন করা বা উপহার দেওয়া-নেওয়া নয়, এটা ঈশ্বরের প্রতিজ্ঞার পূর্ণতা। যীশু খ্রীষ্টের আগমনের মাধ্যমে ঈশ্বরের প্রতিশ্রুত পরিত্রাণ ও শান্তির পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়েছে, যা বহুবছর আগেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।
যিশু খ্রিস্টের সময়কালকে স্মরণ করলে দেখা যায়, সেই সময়ে যিহূদা নগরী রোমান সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল। তখন আগস্ত কৈসর সম্রাট, আর রাজা হেরোদ রোমের পক্ষে শাসন করতেন। সাধারণ মানুষের জন্য সময়টা ছিল আসলে খুবই কঠিন। দারিদ্র্যতা যিহুদার পেছন ছাড়তেছিল না। তার উপর রোমান সম্রাটকে কর দিতে হতো। রোমানরা সামরিক শক্তি দিয়ে সবাইকে দমিয়ে রেখেছিল সেই সময়ে। এদিকে ধর্মীয়ভাবে, ইহুদীরা ছিল কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত। সদ্দূকীদের ছিল রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা, ফরীশীদের ছিল জনপ্রিয়তা ও শিক্ষাগত প্রভাব বিশেষ করে মন্দিরে, এবং এসসেনেসরা ছিলেন আধ্যাত্মিক আদর্শের অনুসারী যারা মশীহের অপেক্ষায করেছিলেন। তবে সবাই মিলে আশা করত যে মশীহ এসে রোমানদের হাত থেকে মুক্তি দেবেন। তবে ঈশ্বরের চিন্তা আর মানুষের চিন্তার যে অনেক পার্থক্য ছিল যিশুর জন্ম ছিল তার উদাহরণ। কারণ যীশুর আগমন ছিল আধ্যাত্মিক মুক্তির জন্য, শুধু রাজনৈতিক নয়।
পবিত্র বাইবেলে ভাববাদীরা মশীহের আগমনের কথা বহুবছর আগে থেকেই বারবার উল্লেখ্য করেছিলেন। হিব্রু শব্দ מָשִׁיחַ( মশীয়াহ) শব্দ থেকে এসেছে মশীহ, যার অর্থ 'অভিষিক্ত' বা 'নির্বাচিত' । পবিত্র বাইবেল ও ইহুদিদের ধর্মীয় গ্রন্থে এই শব্দটি ভবিষ্যতের একজন ত্রাণকর্তা বা রাজার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। সেই সব ভাববাণী যীশু খ্রিস্টের জন্মের মাধ্যমে পুরোপুরি পূর্ণতা পেয়েছে। খ্রিষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দীতে যিশাইয় ভাববাদীর বলেছেন: “অতএব প্রভু আপনি তোমাদিগকে এক চিহ্ন দিবেন; দেখ, এক কন্যা গর্ভবতী হইয়া পুত্র প্রসব করিবে, ও তাঁহার নাম ইম্মানূয়েল [আমাদের সহিত ঈশ্বর] রাখিবে।” এই ভবিষ্যতবাণী কুমারী মরিয়মের গর্ভধারণের কথা প্রকাশ করেছিল। যা বাইবেলে মথি লিখিত সুসমাচারে সেই ভবিষ্যতবাণীর অর্থ পুর্ণতা পায়।
যেখানে বলা হয়েছে “যীশু খ্রীষ্টের জন্ম এইরূপে হইয়াছিল। তাঁহার মাতা মরিয়ম যোষেফের প্রতি বাগ্দত্তা হইলে তাঁহাদের বিয়ের পূর্বে জানা গেল, তাঁহার গর্ভ হইয়াছে- পবিত্র আত্মা হইতে। ... তুমি তাঁহার নাম যীশু [ত্রাণকর্তা] রাখিবে; কারণ তিনিই আপন প্রজাদিগকে তাহাদের পাপ হইতে ত্রাণ করিবেন। যিশুর খ্রিষ্টের জন্ম গোশালায় হয়েছিল। এই জন্ম বার্তা দেয়, তার বাণী সবার জন্য অথাৎ ধনী-গরিব সবার।
যিশু তার শিষ্যদের দুইট আদেশ দিয়েছিলেন। প্রথমটি “তোমার সমস্ত অন্তঃকরণ, তোমার সমস্ত প্রাণ ও তোমার সমস্ত মন দিয়া তোমার ঈশ্বর প্রভুকে প্রেম করিবে। আর দ্বিতৃীয়টি হচ্ছে, তোমার প্রতিবাসীকে আপনার মত প্রেম করিবে।” এই দুটি বাণীর মাধ্যমে তিনি প্রেমের বাণী সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আজকের সমাজে, যেভাবে বিদ্বেষ-বিভাজন ছড়াচ্ছে, এই প্রেমের বাণী দিয়ে এই বিদ্বেষ-বিভাজনকে শান্তিতে রুপান্তর করতে বার্তা দেয়।
যিশু খ্রিস্ট আরও উদার প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছেন এই বাক্যের মাধ্যমে “তোমরা আপন আপন শত্রুদিগকে প্রেম করিও, এবং যাহারা তোমাদিগকে তাড়না করে, তাহাদের জন্য প্রার্থনা করিও” তার আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে তোমাকে একগালে চড় দিলে, আরেক গাল পেতে দাও। তিনি আরেক বাক্যে বলেছেন “অতএব সর্ববিষয়ে তোমরা যাহা যাহা ইচ্ছা কর যে, লোকে তোমাদের প্রতি করে, তোমরাও তাহাদের প্রতি সেইরূপ করিও; কেননা ইহাই ব্যবস্থার ও ভাববাদি-গ্রন্থের সার।” এই বাক্যগুলো অনেক পড়তে ও জানতে সহজ হলেও বাস্তবে প্রয়োগ করা কঠিন হয়ে যায়। যারা প্রয়োগ করে তারাই এই বাক্যের ফল দেখতে পায়।
আজকের পৃথিবীতে ভোগবাদ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে অসঙ্গতি, বৈষম্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ আর যুদ্ধ লেগেই আছে।তবে যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন অথাৎ বড়দিনে তার শিক্ষা আমাদের একে অপরের সেবা ও প্রেম করতে অনুপ্রাণিত করে। বড়দিনে আমরা এই শিক্ষাকে অনুসরণ করে আরও ভালো সমাজ গড়তে পারি। বাংলাদেশে বড়দিন সবার মিলনের উৎসব। এই দিনটিকে ঘিরে খ্রিস্টান, মুসলিম, হিন্দু সবাই মিলে আনন্দ করে। আজকে দিনে বিশ্বে ক্ষমতার দাপট আর অস্ত্রের প্রদর্শনীর অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, অপরদিকে যীশুর বার্তা আমাদেরকে প্রেমের মাধ্যমে শান্তি বারতা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য ডাকছে। আসুন, এই বড়দিনে আমরা একে-অপরের মধ্যে প্রেম ছড়াই এবং শান্তির বার্তা উড়াই। শুভ বড়দিন ।
লেখক : জগেশ রায়
সদস্য, বাংলাদেশ প্রেসবিটারিয়ান চার্চ; শিক্ষার্থী, এক্টস ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া।