স্বতন্ত্র ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’ গঠন কতটা জরুরি

রেজাউল ইসলাম
রেজাউল ইসলাম  © টিডিসি ফটো

দেশ-বিদেশের বরেণ্য শিক্ষাবিদরা বলে থাকেন যে, শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো মাধ্যমিক শিক্ষা। কারণ এটি শিক্ষার্থীদের উচ্চ শিক্ষা ও ভবিষ্যৎ কর্মের জন্য প্রস্তুত করে, তাদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধের বিকাশ ঘটায়। এজন্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ শিক্ষা, তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) শিক্ষা পরিসংখ্যান রিপোর্ট অনুসারে, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার ছিল ৬১ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে কমে এসে দাঁড়িয়েছে ৩২.৮৫ শতাংশে।

মাধ্যমিক স্তর থেকেই ঝরে পড়া বিশাল সংখ্যক এই শিক্ষার্থীরা যাতে উপযুক্ত শিক্ষা নিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারে, তার জন্যও কিন্তু মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তি অনেক শক্তিশালী হওয়া দরকার। কিন্তু বাংলাদেশের মাধ্যমিক শিক্ষার বাস্তব পরিস্থিতি তার সম্পূর্ণ বিপরীত বলেই ধরে নেওয়া যায়! 

দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার ভিত্তিকে শক্তিশালী করার প্রথম ও প্রধান শর্তই হলো এ স্তরের শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানো। কারণ শিক্ষা প্রশাসন-ই বিদ্যালয়ের পড়ালেখার সার্বিক পরিবেশের তদারকি করে থাকে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার অতি গুরুত্বপূর্ণ এই স্তরের প্রশাসন চালানো হচ্ছে একেবারেই জোড়াতালি দিয়ে! দেশের প্রাথমিক, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনা করার জন্য আলাদা অধিদপ্তর থাকলেও, এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার স্তর মাধ্যমিকের জন্য নেই আলাদা কোনো অধিদপ্তর। 

আরও পড়ুন: ছাত্রদলের দেওয়া তালা ভেঙে রাকসু কার্যালয়ে ঢুকল শিক্ষার্থীরা

স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও এটিকে অন্য স্তর থেকে আলাদা না করে ‘মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর’ নামে উচ্চ শিক্ষাস্তরের সাথে জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে।

আরও মজার ব্যাপার হলো জোড়াতালি দিয়ে তৈরি করা এই অধিদপ্তরের সিংহভাগ কর্মকর্তা-ই আসেন উচ্চ শিক্ষা স্তর, অর্থাৎ বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে। তারাই হলেন এই আজব অধিদপ্তরের হর্তাকর্তা। এখানে মাধ্যমিক স্তর থেকে কোনো কর্মকর্তা আসার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্তত মহাপরিচালক ও পরিচালক পদে তাদের আসার কোনো সুযোগ-ই রাখা হয়নি এখানে। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, পরিচালক সবাই আসেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার থেকে। 

দেশজুড়ে অধিদপ্তরের বিভিন্ন আঞ্চলিক অফিসে উপ-পরিচালক পদে মাধ্যমিক থেকে কর্মকর্তা নেওয়ার প্রচলন থাকলেও, অতি সাম্প্রতিক সেসব পদেও পরিচালক বসিয়ে মাধ্যমিকের সুযোগ আরো সংকীর্ণ করে ফেলা হয়েছে। এখানে বলে রাখা ভালো যে, অধিদপ্তরটি শিক্ষা ক্যাডারের মেধাবী কর্মকর্তাদের দ্বারা পরিচালিত হওয়াতেও কোনো সমস্যা ছিল না, যদি কিনা তারা সেটি দক্ষতা, সততা ও সমতার ভিত্তিতে পরিচালনা করতে পারতেন। কিন্তু, এখানে বৈষম্য এতোটাই প্রকট যে, মাত্র আড়াইহাজার মহাবিদ্যালয়ের দুই লাখ কর্মকর্তা চব্বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ছয় লাখ কর্মকর্তাকে একেবারে গিলে ফেলেছেন!

বিসিএস শিক্ষা ক্যাডার দ্বারা পরিচালিত এই অধিদপ্তরের পেশাগত সুযোগ-সুবিধার সিংহভাগ-ই লাভ করে থাকেন উচ্চ শিক্ষা স্তরের শিক্ষক ও কর্মকর্তাগণ। তাদের বেতন কাঠামো ও পদোন্নতির সুযোগ মাধ্যমিকের থেকে অনেক ভালো ও গতিশীল। তাদের জন্য আছে আলাদা একটি সুষ্ঠু বদলি নীতিমালা— যার মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সহজেই এক কর্মস্থল থেকে অন্য কর্মস্থলে বদলি হতে পারেন। তাদের জন্য সরকারি স্কলারশিপের মাধ্যমে বিদেশ থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের সুযোগও ঢের আছে। আর মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা স্তরের জন্য পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নেও তাদের রয়েছে একচ্ছত্র মালিকানা।

মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা কী পড়বে, কীভাবে পড়বে— এ বিষয়টিও পুরোপুরি তারাই তদারকি করে থাকেন। এখানে মাধ্যমিকের কারোর বুদ্ধি, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা শেয়ার করার কোনো সুযোগ নেই। ব্যাপারটা এমন যে, মাধ্যমিকের একদল অসভ্য, বর্বর ও মূর্খের মধ্যে দীর্ঘমেয়াদে জ্ঞানের আলো জ্বালিয়ে রাখার ঔপনিবেশিক দায়িত্ব ঘাড়ে নিয়েছেন বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের এই কর্মকর্তারা!

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের ১,৮০০ কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য রয়েছে আলাদা ‘কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর’। আর ৯ হাজার ৬৫৬টি মাদ্রাসার জন্য রয়েছে আলাদা 'মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর'। অথচ চব্বিশ হাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য যে একটি আলাদা অধিদপ্তরের প্রয়োজন আছে, সেই বিষয়টি ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে কোনো একটি অদৃশ্য শক্তির অসীম ক্ষমতাবলয়ের ছত্রছায়ায়। 

এই অদৃশ্য শক্তি তার নিজের স্বার্থেই মাধ্যমিকের ছয় লাখের অধিক শিক্ষক-কর্মচারীকে দীর্ঘদিন ধরে তার দাস বানিয়ে রেখেছে। এখানে কোনো সুষ্ঠু বদলি নীতিমালা নেই। অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের মর্জিমাফিক বদলির আদেশ হয়ে থাকে। এ বিষয়ে মাধ্যমিকের কেউ টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করতে পারেন না। এজন্যই সরকারি মাধ্যমিকের কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের অধিক বা সমান সংখ্যক শিক্ষক আছেন। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের অর্ধেক শিক্ষকও নেই। 

যার ফলশ্রুতিতে, সেসব বিদ্যালয়ে নিয়মিত পাঠদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। দশজন শিক্ষকের সৃষ্ট পদে পাঁচজন শিক্ষক কর্মরত থাকলে যা হয় আরকি! দেশের নানা প্রান্ত থেকে সচেতন মহল কর্তৃক এসবের প্রতিকার চাইলেও, আমলাতন্ত্রের চিরচেনা সেই লালফিতার দৌরাত্ম্যে সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়।

এ তো গেল বদলি নীতিমালার কথা। মাধ্যমিকের শিক্ষকগণ দীর্ঘদিন ধরে আর্থিক ও পদমর্যাদার দিক দিয়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে আসছেন। এখানকার অনেক সিনিয়র শিক্ষকের টাইমস্কেল, সিলেকশন গ্রেডের সুবিধা আটকে রাখা হয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। যারা নতুন যোগদান করেছেন বা করছেন তারা তাদের উচ্চতর ডিগ্রির জন্য ‘অগ্রিম বর্ধিত বেতন’ সুবিধা পাচ্ছেন না। 

আরও পড়ুন: প্রার্থীতা চ্যালেঞ্জ করে রিট দায়েরকারী বামজোটের নেত্রীকে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি: ফরহাদ

অথচ এই আর্থিক সুবিধাগুলো পেতে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের কোনোরূপ বেগ পেতে হচ্ছে না। অনায়াসেই পেয়ে যাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭৩ সালে ঘোষিত বাংলাদেশের প্রথম পে স্কেলে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ১০ম গ্রেডের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদের সমমর্যাদার অন্য অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের পদগুলোর বেশিরভাগ-ই কালের বিবর্তনে আজ ৯ম গ্রেডের পদে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। এমনকি অনেক অধিদপ্তর, পরিদপ্তরের ১১তম গ্রেডের পদও ৯ম গ্রেড হয়ে গেছে। 

কিন্তু সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটি এদেশের জন্মলগ্ন থেকে কোনো এক অজানা কারণে সেই দশম গ্রেডের বৃত্তেই আটকে রয়েছে! অথচ, মাধ্যমিক শিক্ষকদের সাথে রাষ্ট্রের এমন বিমাতাসুলভ আচরণের বিপরীতে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর যোগ্য অভিভাবক হিসেবে কোনোকালেই কিছু করেনি!

আজকে তাই সরকারি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের নিজেদের দাবি নিজেদেরকে-ই আদায় করতে মাঠে নামতে হচ্ছে। তারা বুঝতে পেরেছেন এদেশে শিক্ষক হয়ে বেঁচে থাকা কতটা অসম্মানের। তাই তারা আর এক বিন্দু ছাড় দিতে চান না তাদের যৌক্তিক অধিকারের জায়গাগুলো থেকে। 

অনেক দেরি হয়ে গেলেও, এখন তারা ‘সহকারী শিক্ষক’ পদটিকে ১০ম গ্রেডের স্থলে ৯ম গ্রেড হিসেবে দেখতে চান। তারা তাদের শিক্ষকতার উপযুক্ত মর্যাদা হিসেবে নিয়মিত পদোন্নতি চান। তারা তাদের পেশাগত উন্নয়নের জন্য সরকারি স্কলারশিপের মাধ্যমে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের‌‌‌ সুযোগ পেতে চান। তারা তাদের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যক্রম, পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যপুস্তক স্বহস্তে প্রণয়নের অধিকার চান। এসব ব্যাপারে তারা আর কারো দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দি থাকতে চান না। তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, শিক্ষা সংক্রান্ত এসব কাজ সুষ্ঠু, সুন্দর ও নিখুঁতভাবে সম্পাদন করার মতো যথেষ্ট যোগ্য ও দক্ষ শিক্ষক বাংলাদেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে আছে। 

অতএব, তাদের চাওয়া— ২০১০ সালের শিক্ষানীতির সুপারিশের আলোকে মাধ্যমিক শিক্ষাকে উচ্চ শিক্ষা স্তর থেকে আলাদা করে স্বতন্ত্র মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করা হোক- যাতে তারা সেখানে স্বাধীনভাবে তাদের শিক্ষার্থীদের শারীরিক মানসিক ও নৈতিক শিক্ষার উন্নয়নে উপযুক্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে পারেন।


সর্বশেষ সংবাদ