বিশ্ব শিক্ষক দিবস আজ
বৈষম্যে আটকা শিক্ষকদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধা
- খাঁন মুহাম্মদ মামুন
- প্রকাশ: ০৪ অক্টোবর ২০২৩, ১০:২৪ PM , আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪৭ AM
দেশের প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় শিক্ষার মূল চালকের আসনে রাখা হয়েছে শিক্ষকদের। প্রাক-প্রাথমিক, প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা সব কাঠামোতেই শিখন-পাঠনসহ সব কাজই করতে হয় শিক্ষকদের। অথচ বেতন-ভাতা, মর্যাদা, পদোন্নতি, অবসর সুবিধাসহ প্রায় সবক্ষেত্রেই বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন দেশের শিক্ষকরা। দেশে প্রচলিত কাঠামোয় সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার প্রাথমিকের শিক্ষকরা। এরপর মাধ্যমিকের বেসরকারি এবং উচ্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষার বেসরকারি খাতের শিক্ষকরা। যার চূড়ান্ত পরিণতি, শিক্ষার গুণগত মানে ক্রমবর্ধমান ছাড়।
আজ ৫ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’। এবারের প্রতিপাদ্য "The teachers we need for the education we want: The global imperative to reverse the teacher shortage (অর্থাৎ, কাঙ্ক্ষিত শিক্ষা পেতে যেমন শিক্ষক চাই : শিক্ষক সংকট ঠেকাতে বৈশ্বিক উদ্যোগ)”। শিক্ষকদের অবদানকে স্মরণ করার জন্য জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো সদস্যভুক্ত প্রতিটি দেশে ১৯৯৫ সাল থেকে প্রতি বছর এদিন দিবসটি উদযাপন করা হয়। বাংলাদেশে এবারেই প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘শিক্ষক দিবস’ পালিত হতে যাচ্ছে।
চলমান কাঠামোগত অবস্থানের কারণে শিক্ষায় সবচেয়ে বেশি বৈষম্য বলে মনে করছেন দেশের শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা। দেশে বর্তমানে সবচেয়ে কম বেতন পাচ্ছেন শিক্ষার প্রাথমিক স্তরের শিক্ষকরা। প্রাথমিকের শিক্ষকরা তৃতীয় শ্রেণির এবং প্রধান শিক্ষকরা দ্বিতীয় শ্রেণির হিসেবে বিবেচিত হন রাষ্ট্রীয় কাঠামোয়। অথচ শিক্ষার এ স্তরে সবচেয়ে বেশি ঝামেলা পোহাতে হয় প্রাথমিকের শিক্ষকদের। এটি বৈষম্য পাশের দেশ ভারত কিংবা প্রাথমিক শিক্ষায় বিশ্বের সেরা ফিনল্যান্ডে বেশি দেশের তুলনায়। এছাড়াও ফিনল্যান্ডে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত পেশা শিক্ষকতা। কারণ সেখানে পেশাভিত্তিক মর্যাদা এবং বেশি বেতন পান শিক্ষকরা।
এখানে কাঠামোগত বৈষম্যের পাশাপাশি কাঠামোগত চিন্তা করা হয় যে, শিক্ষার উচ্চ-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে প্রাথমিক অর্থাৎ যত নিচে আসবে শিক্ষকদের তত কম যোগ্যতা লাগবে—এমনটা মনে করা হয়। ফলে এখানে বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিক্ষকদের মাঝে চলমান এ বৈষম্য দূরীকরণ প্রয়োজনে ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো এবং শিক্ষকদের যোগ্যতা কাঠামো ঠিক করে দেওয়া যেতে পারে—অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রাথমিক বিদ্যালয় সহকারী শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. শামসুদ্দিন মাসুদ। তিনি বলেন, এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এখনও বাংলাদেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হিসেবে দেখা হয়—আক্ষেপ জানান এই শিক্ষক নেতার।
দেশে প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় ৯৭ শতাংশই সম্পন্ন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন হলেও সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে এ খাত। বর্তমানে এমপিওভুক্ত প্রায় ২৮ হাজার, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং স্বীকৃতিবিহীন প্রায় ১০ হাজারের মতো নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে এমপিওভুক্ত প্রায় ৫ লাখ। নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানগুলোয় শিক্ষক হিসেবে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ১ লাখ শিক্ষাগুরু। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষকদের সমান শ্রম ও কর্মঘণ্টা তাদের থাকলে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধায় পিছিয়ে ‘আকাশের মতো হৃদয়ধারী’ এসব মহান মানুষদের।
শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করছেন একজন শিক্ষক
দেশে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন সরকারি শিক্ষালয়গুলোর শিক্ষক-কর্মচারীরা। বেতন, পূর্ণাঙ্গ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা-ভাতা, পদোন্নতি, পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি—এসব সুবিধা রয়েছে তাদের প্রাপ্তির তালিকায়। তাদের বদলির পাশাপাশি রয়েছে অবসরের পর পরিপূর্ণ অবসর ভাতাসহ মাসিক পেনশনসহ নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা। এর সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র লক্ষণীয় হচ্ছে বেসরকারি খাতের মানুষ গড়ার কারিগরদের ক্ষেত্রে।
বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা স্কেলের মূল বেতন পান মাস শেষে। বাকি সব ভাতা ও সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে রয়েছেন তারা। সরকারি শিক্ষকরা মূল বেতনের ৫০-৬০ শতাংশ বাড়িভাড়া পেয়ে থাকেন। অন্যদিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বাড়িভাড়া ও চিকিৎসা-ভাতা পান মাত্র ১ হাজার টাকা ও ৫০০ টাকা করে। উৎসব ভাতা হিসেবে পান মূল বেতনের মাত্র ২৫ ভাগ আর কর্মচারীরা ৫০ ভাগ অর্থ। অবসর ভাতা যা এককালীন পাওয়া কথা, তা পান অবসরে যাওয়ার চার বছর পর। এর বাইরে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই মানুষ গড়ার এ কারিগরদের।
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের চাকরির ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার ওপর। কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক লাভ-লোকসান, ইচ্ছা-অনিচ্ছায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের নিয়োগ ও চাকরিচ্যুত করা হয়। এছাড়াও দেশের বেশির ভাগ কিন্ডারগার্টেনে একজন শিক্ষক মাসে ৫ হাজার, কোথাও ২ হাজার অথবা কোনো বেতন ছাড়াই নিয়োগ পান।
বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যথাযথ মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এখানে সবচেয়ে বেশি অবহেলিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। এখনও বাংলাদেশে প্রাথমিকের শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির রাষ্ট্রীয় কর্মচারী হিসেবে দেখা হয়—মো. শামসুদ্দিন মাসুদ
প্রাইভেট টিউশনির আশায় কম বেতনে বা বিনা বেতনে শিক্ষকতা পেশায় নাম লেখান অনেকে। আয় না থাকলে মাস শেষে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরতে হয় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের অন্তত ১ লাখ শিক্ষক।এর মধ্যে বেসরকারি কলেজের শিক্ষকরাও রয়েছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে। আর অনার্স মাস্টার্স পর্যায়ে শিক্ষকরা সরকারি সুযোগ-সুবিধা ছাড়াই রয়েছেন বিগত প্রায় তিন দশক ধরে। খুব কম প্রতিষ্ঠানই এই স্তরের শিক্ষকদের নিজ আয় থেকে বেতন দিয়ে থাকেন। ফলে শুধু আর্থিকভাবে নয়, সামাজিকভাবেও পিছিয়ে আছেন প্রচলিত শিক্ষাস্তরগুলোর শিক্ষকরা।
বর্তমানে সরকারি, এমপিও এবং নন-এমপিও শিক্ষক নিয়ে চলমান এ ব্যবস্থাকে ‘অমানবিক কাঠামো’ বলে মনে করেন বাংলাদেশ নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার। তিনি বলেন, পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক কাঠামোয় বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু, শিক্ষকরা পিছিয়ে আছেন। তার মতে, এটি চলা উচিত না। এ শিক্ষক নেতা মনে করেন, চলমান বৈষম্যের অবসান হতে পারে পুরো কাঠামোর জাতীয়করণের মাধ্যমে।
শিক্ষকদের দক্ষতা উন্নয়নে তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়াতে হবে প্রশিক্ষণও
বর্তমান বিশ্বে যে সব দেশ শিক্ষায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছে—সেসব দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ ব্যয় করা হয় শিক্ষাখাতে এবং এর একটি বড় অংশই ব্যয় হয় শিক্ষকদের পেছনে। ফলে এসব দেশে কাঙ্ক্ষিত পেশা হয়েছে শিক্ষকতা এবং দেশগুলোর তরুণরা আগ্রহী হচ্ছেন এ পেশায়। বর্তমান পৃথিবীতে শিক্ষকতা করে সবচেয়ে বেশি বেতন পান লুক্সেমবার্গের শিক্ষকরা। তারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের শিক্ষকদের তুলনায় সবচেয়ে বেশি বেতন পান। বেতনের দিক থেকে এগিয়ে থাকা দ্বিতীয় দেশ সুইজারল্যান্ড এবং তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জার্মানি। আর সবচেয়ে নিম্ন বেতন প্রদানকারী দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে স্লোভাকিয়া দ্বিতীয় অবস্থানে চেক প্রজাতন্ত্র এবং তৃতীয় পোলান্ড।
শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিয়ে ২০১৩ সালে ভার্কি ফাউন্ডেশনের করা একটি গবেষণা হতে প্রাপ্ত ফলাফলে জানানো হয়েছে, এশিয়ার দেশগুলোর সমাজ কাঠামোয় বিশেষ করে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুরে শিক্ষকদের বৃহৎ সম্মানের চোখে দেখা হয়। তবে পশ্চিমা দেশগুলোয় শিক্ষকদের মর্যাদা এশিয়ার দেশগুলোর তুলনায় কম। আর এর ব্যতিক্রম রয়েছে চীনে। দেশটি পৃথিবীর একমাত্র উদাহরণ, যেখানে যেখানে একজন অভিজ্ঞ শিক্ষককে ডক্টর উপাধিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের সমান বিবেচনা করা হয়।
দেশে প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোয় ৯৭ শতাংশই সম্পন্ন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন হলেও সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে রয়েছে এ খাত। বর্তমানে এমপিওভুক্ত প্রায় ২৮ হাজার, স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এবং স্বীকৃতিবিহীন প্রায় ১০ হাজারের মতো নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে।
বিশ্ব শিক্ষক সূচকের লেখক অধ্যাপক পিটার ডালটন তখন ২১ দেশের শিক্ষক, সামাজিক অবস্থান ও তাদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির তুলনামূলক পর্যালোচনা করেন। তার মতে, শিক্ষকদের মর্যাদা ইতিহাস, নৈতিকতা, মূল্যবোধ বিশেষত সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে।
এখানে কাঠামোগত বৈষম্যের পাশাপাশি কাঠামোগত চিন্তা করা হয় যে, শিক্ষার উচ্চ-মাধ্যমিক, মাধ্যমিক থেকে প্রাথমিক অর্থাৎ যত নিচে আসবে শিক্ষকদের তত কম যোগ্যতা লাগবে—এমনটা মনে করা হয়। ফলে এখানে বৈষম্য প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক ড. এস এম হাফিজুর রহমান। এই শিক্ষাবিদ মনে করেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। যেহেতু প্রাথমিকের শিক্ষকদের বেশি পরিশ্রম করতে হয়—তাই তাদের সুযোগ-সুবিধা ও বেতন বেশি হওয়া উচিত। এছাড়াও শিক্ষকদের মাঝে চলমান এ বৈষম্য দূরীকরণ প্রয়োজনে ‘স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু’র মতো উদ্যোগে সমাধান আসতে পারে। তবে তার আগে নির্ধারণ করতে হবে শিক্ষকদের যোগ্যতা কাঠামো।