বেগম রোকেয়া দিবস: সাম্যের পথচলায় অনন্য আলোর দিশারি
- মো. সাজ্জাদুল ইসলাম
- প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৫:৫৭ PM , আপডেট: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৬:০৪ PM
৯ ডিসেম্বর এ দিনটি বাঙালি সমাজে এক অনন্য প্রতীকের মতো উদ্ভাসিত। একই দিনে জন্ম ও মৃত্যু হওয়া বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন যেন সময়কে নিজের চারপাশে বৃত্তাকারে সাজিয়েছিলেন। তার জীবনসাধনা শুরু হয়েছিল যে আলো নিয়ে, সে আলো মৃত্যুর পর আরও তীব্র হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে আজকের সমাজের প্রতিটি স্তরে। রোকেয়া শুধু একজন ব্যক্তিত্ব নন; তিনি এক যুগের বিবেক, এক সাহসী উচ্চারণ, এক চিন্তার বিপ্লব।
যে সময়ে নারীশিক্ষা ছিল নিষিদ্ধ ভাবনা, সেই সময়ে রোকেয়া কলম ধরেছিলেন অত্যন্ত সচেতনভাবে। নারীর অন্ধকারময় বন্দিত্ব এবং পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভারী শেকল ভেদ করে তিনি আলোর রেখা টেনে দেন শিক্ষা ও সমতার পথে। তার গল্প সুলতানাস ড্রিম যেন এক ভবিষ্যৎ সমাজের কল্পচ্ছবি যেখানে নারীর ক্ষমতা অবাধ, যেখানে জ্ঞান-যুক্তি-মানবিকতার জয়। আর অবরোধবাসিনী তার প্রতিটি পৃষ্ঠা নারীর দমবন্ধ জীবনসংগ্রামের এমন সাক্ষ্য বহন করে যা আজও পাঠকের চেতনায় ঝাঁকুনি দিয়ে যায়।
শুধু লেখক হিসেবে নয়, শিক্ষাবিদ হিসেবেও রোকেয়া ছিলেন অসাধারণ দূরদৃষ্টির অধিকারী। ১৯১৬ সালে তিনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন, যা তৎকালীন সমাজে এক প্রকার বিপ্লবেরই সমান। তিনি জানতেন, নারীশিক্ষাই সমাজ পরিবর্তনের প্রধান হাতিয়ার। তাই সেখানে পড়াশোনা মানে শুধু পাঠ্যবই মুখস্থ করা নয়; ছিল আত্মসম্মান, আত্মবিশ্বাস এবং নিজেকে চিনে নেওয়ার চর্চা। তার স্কুল বহু নারীকে সামাজিক নেতৃত্বে ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ হওয়ার পথ দেখিয়েছে।
কিন্তু আজ, শত বছর পরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন জাগে রোকেয়ার স্বপ্ন কি সত্যিই পূরণ হয়েছে? সমাজের অনেক ক্ষেত্রে নারীরা এগিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের সামনে পথ এখনো মসৃণ নয়। শিক্ষার সুযোগ বাড়লেও বাল্যবিবাহ, সামাজিক মানসিকতা, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য এবং নিরাপত্তাহীনতা এখনও বাস্তবতা। আধুনিকতার মোড়কে নতুন নতুন অবরোধ তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে অদৃশ্য বাধা, গৃহশ্রমের অবমূল্যায়ন। রোকেয়া যে সমাজের কল্পনা করেছিলেন, সেখানে নারীকে ‘দয়া’ নয়, ‘অধিকার’ দেওয়া হয়; সে সমাজ এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
রোকেয়া দিবস তাই শুধু স্মরণ বা শ্রদ্ধার দিন নয়; এটি আত্মসমালোচনার দিন। আমরা কি সত্যিই এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি, যেখানে মেয়েরা ভয় ছাড়াই নিজেদের সম্ভাবনা প্রকাশ করতে পারে? যেখানে তারা শুধু পরিবারের ‘সহায়ক’ নয়, বরং সমাজের সমান অংশীদার? উন্নয়ন যতই হোক, নারীর অবস্থানের দৃশ্যমান অগ্রগতি তখনই পূর্ণতা পায়, যখন সমাজের মানসিকতাও সমান তালে পরিবর্তিত হয়।
আর সেই মানসিক পরিবর্তনই ছিল রোকেয়ার সংগ্রামের মূল কথা। নারীশিক্ষা, সমান সুযোগ, নিরাপদ পরিবেশ এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা এসব কোনো আলাদা বিষয় নয়; এগুলো মানবিক সমাজ নির্মাণের ভিত্তি। রোকেয়া আমাদের শিখিয়েছেন, নারীকে সমান মর্যাদা না দিলে উন্নয়নের গতি থমকে যায়। তার শিক্ষা আজও বলে নারীর মুক্তি মানে সমগ্র সমাজের মুক্তি।
আজকের দিনে তাই আমাদের দায় অনেক। শুধু বছরের একটি দিন পালন করে দায়িত্ব শেষ হয় না; রোকেয়ার আদর্শকে প্রতিদিনের চর্চায় রূপান্তর করাই তার প্রতি প্রকৃত সম্মান। আমাদের প্রত্যেকের পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে রাষ্ট্র সবখানে নারীর সম্ভাবনা উন্মুক্ত করার নৈতিক অঙ্গীকার থাকতে হবে।
বেগম রোকেয়া এমন এক আলো, যা কখনো নিভে যায় না। তিনি আমাদের দেখিয়েছেন, কীভাবে সীমাবদ্ধতার ভেতর থেকেও স্বপ্ন দেখার সাহস তৈরি হয়, কীভাবে প্রতিকূলতার ওপর দাঁড়িয়েও পরিবর্তনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া যায়। আজ তার দিবসে আমাদের প্রত্যয় হোক আমরা সেই আলোই বহন করব; এমন সমাজ গড়ব, যেখানে নারী-পুরুষ সমতার ভিত্তিতে পাশাপাশি হাঁটে, যেখানে প্রতিটি মেয়ে নিজের মতো করে আকাশ ছুঁতে পারে।
লেখক: কলামিস্ট ও কর্মকতা, জনসংযোগ বিভাগ, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়