শুধু ‘লাশ কাটা ঘর’ নয়, হাসপাতালে দরকার আধুনিক ফরেনসিক বিভাগ

লাশ কাটা ঘর ও লেখক
লাশ কাটা ঘর ও লেখক  © সংগৃহীত ও সম্পাদিত

বাংলাদেশে ‘লাশ কাটা ঘর’ শব্দটি শুনলেই মানুষের মনে ভয়, কৌতূহল আর ঘৃণার মিশ্র অনুভূতি জেগে ওঠে। অথচ এই শব্দটির পেছনে লুকিয়ে আছে আধুনিক চিকিৎসা ও ন্যায়বিচারের এক গুরুত্বপূর্ণ শাখা, ফরেনসিক মেডিসিন। ময়নাতদন্ত বা পোস্টমর্টেম কোনো মৃতদেহ কেটে দেখা নয়, বরং এটি এক বৈজ্ঞানিক ও আইনি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে মৃত্যুর প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা হয়। প্রশিক্ষিত ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের হাতে প্রতিটি কাট, প্রতিটি অঙ্গ পরীক্ষা, প্রতিটি টিস্যু সংগ্রহ, সবই এক একটি সত্যের খোঁজ। এতে প্রকাশ পেতে পারে খুনকে আত্মহত্যা হিসেবে চালানোর চেষ্টা, চিকিৎসা গাফিলতি কিংবা বিষক্রিয়া লুকিয়ে রাখার ঘটনা।

কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর বাস্তব চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। অনেক জায়গায় ফরেনসিক বিভাগ বা ‘লাশ কাটা ঘর’ দেখতে যেন এক পরিত্যক্ত স্টোররুম, নোংরা, দুর্গন্ধযুক্ত, আলো-বাতাসহীন, ভাঙা যন্ত্রপাতি আর মরিচা ধরা টেবিল। সবচেয়ে বড় দুঃখের বিষয় হলো, অধিকাংশ হাসপাতালেই প্রশিক্ষিত ফরেনসিক টেকনিশিয়ান নেই। বরং এই দায়িত্ব পালন করে তথাকথিত ‘ডোম’ নামে পরিচিত কিছু অপ্রশিক্ষিত ব্যক্তি, যাদের অধিকাংশই অশিক্ষিত। তারা ডাক্তার নয়, টেকনিশিয়ান নয়, মেডিকেল সহকারীও নয়। অথচ তারাই বাস্তবে মৃতদেহ কেটে দেখে, অঙ্গ বের করে, আবার সেলাই করে দেয়। অনেক সময় ডাক্তার কেবল বাইরে থেকে দেখেন বা রিপোর্টে সই করেন।

এমন অনিয়ম শুধু অনৈতিক নয়, এটি ন্যায়বিচারের জন্য মারাত্মক হুমকি। একটি ময়নাতদন্তের রিপোর্টই ঠিক করে দেয় কেউ অপরাধী হবে নাকি নির্দোষ, মৃত্যুটি স্বাভাবিক নাকি হত্যাকাণ্ড। অযোগ্য লোকের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দেওয়া মানে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অবিচার করা এবং মৃতের মর্যাদা নষ্ট করা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদাহরণই ধরা যাক। এখানে ‘ডোম’রা পুরো প্রক্রিয়াটাই চালায়, দেহ আনা থেকে কাটা ও সেলাই করা পর্যন্ত। অনেক ক্ষেত্রে ডোমই ডাক্তারকে বলে দেয় কী লিখতে হবে রিপোর্টে! মাত্র ১৫ মিনিটে পোস্টমর্টেম শেষ হয়ে যায়, যা প্রকৃতপক্ষে ঘন্টাব্যাপী বিস্তারিত পর্যবেক্ষণ হওয়া উচিত। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একই অবস্থা। লাশ ঠান্ডা রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই, একটার উপর আরেকটা দেহ স্তূপ করে রাখা হয়, যন্ত্রপাতি ধোয়া হয় ট্যাপের পানি দিয়ে, রক্ত-মাংস খোলা পড়ে থাকে, দুর্গন্ধে টেকা যায় না।

২০২৩ সালের এক জেলা হাসপাতালের ঘটনাই ধরা যাক। এক তরুণীর মৃত্যু প্রথমে ‘আত্মহত্যা’ বলে রিপোর্ট করা হয়। ময়নাতদন্ত করেন একজন ডোম, কোনো যোগ্য ডাক্তার তদারকি করেননি। পরে ঢাকায় পুনরায় ময়নাতদন্তে প্রমাণিত হয়, ওই তরুণীকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল। প্রথমবারের ভুল ময়নাতদন্তের কারণে তার পরিবার প্রায় ন্যায়বিচার হারাতে বসেছিল। এই ঘটনাগুলো ব্যতিক্রম নয়; এগুলো এক পুরো ব্যবস্থার ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।

আধুনিক চিকিৎসা যেমন ইমেজিং, সার্জারি ও ডায়াগনস্টিকসে এগিয়ে গেছে, তেমন ফরেনসিক মেডিসিন রয়ে গেছে এক শতাব্দী আগের পুরনো পদ্ধতিতে, যেখানে বিজ্ঞানের জায়গায় শুধু কাটাছেঁড়া। সরকারি চিকিৎসকদের মধ্যেও অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি দুঃখজনকভাবে অবহেলামূলক। ফরেনসিক বিভাগকে অনেকেই অনিচ্ছুক দায়িত্ব হিসেবে দেখে থাকেন। মেডিকেল ছাত্রদের মধ্যেও এই বিষয়ে আগ্রহ কম, কারণ এটিকে নোংরা, মানহীন ও মানসিকভাবে কষ্টকর পেশা হিসেবে দেখা হয়। ফলে দক্ষ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞের সংখ্যা খুবই সীমিত। অধিকাংশ হাসপাতালে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য রেফ্রিজারেশন ব্যবস্থা নেই। পুরনো, নষ্ট কুলারেই চলে কাজ। গ্লাভস, মাস্ক, গাউন, এসব সুরক্ষা সামগ্রী প্রায়ই পুনর্ব্যবহার করা হয় বা অনুপস্থিত থাকে। ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, ভোঁতা ছুরি, মরিচা ধরা করাত, ফাটা মাপযন্ত্র, যেন পুরনো যুগের অবশেষ। কোনো ডিজিটাল ইমেজিং, টক্সিকোলজি সহযোগিতা, কিংবা হিষ্টোপ্যাথলজি সাপোর্ট নেই।

অন্যদিকে, ভারতের মতো প্রতিবেশী দেশ বা মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত রাষ্ট্রে ফরেনসিক বিভাগ এখন এক উন্নত বিজ্ঞান। সেখানে পোস্টমর্টেম করা হয় ডিজিটাল এক্স-রে, ৩ডি স্ক্যানিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই-সহায়িত ভার্চুয়াল অটপসি (Virtopsy) প্রযুক্তি ব্যবহার করে, যেখানে মৃতদেহ না কেটেও অভ্যন্তরীণ আঘাত, ভাঙন বা অঙ্গের ক্ষতি নির্ধারণ করা যায়। এতে একদিকে সঠিকতা বজায় থাকে, অন্যদিকে মৃতের মর্যাদাও রক্ষা হয়। ওই দেশগুলোতে ফরেনসিক মেডিসিনকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা হয়। প্রতিটি অটপসি হয় নিয়ম মেনে, পরিচ্ছন্ন পরিবেশে, প্রশিক্ষিত টেকনিশিয়ান ও অভিজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে। অথচ বাংলাদেশে এই আধুনিক পদ্ধতির কোনো বাস্তবায়ন নেই।

বরং দেশের অধিকাংশ ফরেনসিক ইউনিট চলে শূন্য বাজেটে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আলাদা তহবিল দেয় না ফরেনসিক উন্নয়নের জন্য। ফলে এই শাখাটি টিকে আছে কেবল অভ্যাসে, বিজ্ঞান বা নীতি নয় , ‘ডোম’ আর উদাসীন প্রশাসনের হাতে। প্রশ্ন জাগে, আর কতদিন বাংলাদেশ ফরেনসিক মেডিসিনকে ‘লাশ কাটা ঘর’ বলেই চালিয়ে যাবে? এখনই সময় ফরেনসিক মেডিসিনকে হাসপাতালের অবহেলিত কোনা থেকে বের করে এনে বিজ্ঞান ও ন্যায়বিচারের সম্মানজনক স্থানে প্রতিষ্ঠা করার। প্রতিটি মেডিকেল কলেজে গড়ে তুলতে হবে আধুনিক ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, যেখানে থাকবে উন্নত অটপসি রুম, দেহ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি, ডিজিটাল রিপোর্টিং ও রেকর্ড সিস্টেম।

সবচেয়ে জরুরি বিষয় হলো নিয়োগ কাঠামো পরিবর্তন। অযোগ্য ‘ডোম’ ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে বন্ধ করে দিতে হবে। এর পরিবর্তে গড়ে তুলতে হবে সার্টিফায়েড ফরেনসিক টেকনিশিয়ান,যারা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও পেশাগতভাবে যোগ্য। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (BMDC) আওতায় ‘ব্যাচেলর অব ফরেনসিক মেডিসিন’ নামে একটি নতুন শিক্ষা কর্মসূচি চালু করা যেতে পারে। এছাড়া ফরেনসিক চিকিৎসকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক কর্মশালা এবং আধুনিক টক্সিকোলজি ও এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শিখতে হবে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের তদন্ত ব্যুরোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, যাতে প্রতিটি মৃত্যুর তদন্ত হয় বৈজ্ঞানিক ও নৈতিক দায়িত্বের সঙ্গে।

একটি সভ্য দেশ তার মৃতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমেই বিচারবোধের পরিচয় দেয়। যেখানে অশিক্ষিত হাত দিয়ে মানুষের দেহ কেটে দেখা হয়, সেটি কেবল চিকিৎসা নয়, মানবতারও পরাজয়। ‘লাশ কাটা ঘর’ থেকে ‘ফরেনসিক সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট’- এই পরিবর্তন শুধু ভাষার নয়, বিবেকের। সত্য, মর্যাদা ও পেশাদারিত্বকে প্রতিষ্ঠা করার এটাই সময়। বাংলাদেশের দরকার আধুনিক ফরেনসিক বিভাগ, যেখানে ছুরি হাতে ‘ডোম’ নয়, থাকবে বিজ্ঞান, যোগ্যতা এবং সহানুভূতিশীল মানবতা। তবেই প্রতিটি মৃত্যুর গল্প সত্যভাবে বলা সম্ভব হবে এবং প্রতিটি জীবন পাবে তার প্রাপ্য ন্যায়বিচার।

লেখক:
সহকারী অধ্যাপক ও গবেষণা ফেলো
ফ্যাকাল্টি অব হেলথ অ্যান্ড লাইফ সায়েন্সেস
ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া।


সর্বশেষ সংবাদ