শিক্ষাকে আনন্দময় করতে মাল্টিসেন্সরি লার্নিংয়ের গুরুত্ব

আইরিন টিসা
আইরিন টিসা  © টিডিসি সম্পাদিত

একটি সাধারণ ক্লাসরুমের দৃশ্য কল্পনা করুন, যেখানে শিক্ষার্থীরা একটি সাদা বোর্ডের সামনে বসে আছে। সাদা বোর্ডটিতে শিক্ষক কিছু একট লিখে বা এঁকে বোঝাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের হাতে কলম, সামনে খোলা বই, তারা বোর্ড থেকে দেখে খাতায় নোট নিচ্ছে। শিক্ষার্থীরা মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকের কথা শোনা বা বোঝার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরেই আমাদের শিক্ষাগ্রহণ পদ্ধতিতে এই প্রক্রিয়াটি অনুসরণ করে আসা হচ্ছে। তবে এই ২১ শতকে এসে শিক্ষার ধরন যেমন- পরিবর্তিত হচ্ছে, ঠিক তেমনি বদলে যাচ্ছে আমাদের শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতি ও প্রযুক্তি।

আজকের দিনে শিক্ষার্থীরা কেবল শিক্ষা বা তথ্য গ্রহণ করবে এমনটা নয়। বরং তারা এই দেখা, শোনা বা চিন্তা করার পাশাপাশি, ক্লাসরুমে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করছে। এভাবে, একাধিক ইন্দ্রিয় কাজে লাগিয়ে বোঝাপড়া বা স্মৃতি ধারণের কাজটিকে অনেক বেশি সাবলীল ও সক্রিয় করে তোলার উপায়কেই বলা হয় ‘মাল্টিসেন্সরি লার্নিং’। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চোখ, কান, হাত ও শরীরের অন্যান্য অংশ ব্যবহার করে শেখে। একাধিক ইন্দ্রিয় যুক্ত হওয়ার ফলে মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশ সক্রিয় হয়, যা তাদের স্মৃতিশক্তি ও বোঝাপড়াকে শক্তিশালী করে। প্রথাগত শিক্ষার ক্ষেত্রে যেখানে একটি সাধারণ মাধ্যম ব্যবহার করে শেখানো হয়, সেখানে মাল্টিসেন্সরি লার্নিং শিক্ষার্থীদের জন্য একটি সমৃদ্ধ ও গভীর অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করে।

বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী, মাল্টিসেন্সরি ইনপুট মস্তিষ্কের নিউরাল কানেকশনকে শক্তিশালী করে এবং শিশুদের শেখার গতি বৃদ্ধি করে। শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক দুই বয়সের শিক্ষার্থীরাই এধরনের পরিবেশ থেকে উপকৃত হয়। এখানে তারা ছবি দেখার মাধ্যমে শেখে, শব্দ শোনা বা কোনো কিছু ধরার মাধ্যমে শেখে; এবং একইসাথে, চিন্তার পরিধি বৃদ্ধি করার সুযোগ পায়। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, মাল্টিসেন্সরি লার্নিং পদ্ধতি অনুসরণ করছে এমন শিক্ষার্থীরা গতানগতিক পদ্ধতির তুলনায় বেশি তথ্য মনে রাখতে পারে এবং তাদের বিশ্লেষণ ক্ষমতাও উন্নত হয়। 

মাল্টিসেন্সরি লার্নিং ডেমো

 
শিক্ষকদের মাল্টিসেন্সরি লার্নিং কার্যকর করতে ইন্টারেক্টিভ ফ্ল্যাট প্যানেল (আইএফপি) সাহায্য করে। সাদা বোর্ডের বিপরীতে এই ডিজিটাল বোর্ডটি অনেক বেশি কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এই ডিভাইসে শিক্ষক ও শিক্ষার্থী একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পায়। যেখানে তারা সরাসরি টাচ করে ছবি আঁকতে পারে, প্রশ্ন সমাধান করতে পারে এবং মাল্টিমিডিয়া শিক্ষণ উপকরণ ব্যবহার করতে পারে। আইএফপি শিক্ষার্থীদের সক্রিয় করে তোলে। তারা নিজেরা বিষয়বস্তু স্পর্শ ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যা বিষয়গুলোকে আরও সহজ ও বাস্তবমুখী করে তোলে।

বিশ্বের বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষে আইএফপি ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও শিক্ষার মান বাড়ছে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞান ক্লাসে অণু কাঠামো অ্যানিমেট করা যায়, ইতিহাস পাঠে ইন্টারেক্টিভ টাইমলাইন ব্যবহার করা যায়, ভাষা শিক্ষায় উচ্চারণ উন্নতির জন্য রিয়েল-টাইম ফিডব্যাক পাওয়া যায়। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করার মাধ্যমে শেখার প্রক্রিয়াকে অনেক বেশি আনন্দময় ও কার্যকর করে তোলা সম্ভব। শুধুমাত্র শ্রেণীকক্ষে নয়, আইএফপি অনলাইন ও হাইব্রিড শিক্ষার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত কার্যকর। শিক্ষকরা দূরে থেকেও শিক্ষার্থীদের ইন্টারেক্টিভ পাঠ করানোর সুযোগ পান; আর শিক্ষার্থীরাও ঘরে বা যেকোনো জায়গা থেকে বসে মাল্টিসেন্সরি শিক্ষার সুবিধা নিতে পারে।

আইএফপি ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাপদ্ধতির সাথে আধুনিক প্রযুক্তিকে একত্রিত করে আগামীর উপযোগী শ্রেণিকক্ষ তৈরি করে। এটি শিক্ষার সামগ্রিক মানকে অক্ষুণ্ণ রাখে; আবার অন্যদিকে আধুনিক প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে, মাল্টিসেন্সরি শিক্ষার সর্বোচ্চ সুফল পেতে হলে, আইএফপির ব্যাপক ব্যবহার নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকার, বেসরকারি খাত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। বিশেষ করে, স্কুলগুলোতে এই প্রযুক্তি পৌঁছে দেওয়া ও এর যথাযথ প্রয়োগের ক্ষেত্রে সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকারি স্কুলগুলোতে এই প্রযুক্তি প্রচলন করতে হলে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি, এ বিষয়ে শিক্ষকদের সময়োপযোগী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করতে হবে।  

পরিশেষে বলা যায়, মাল্টিসেন্সরি শিক্ষার মাধ্যমে ইন্টারেক্টিভ ফ্ল্যাট প্যানেল আমাদের শিক্ষাগ্রহণের পদ্ধতিকে একটি নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। একাধিক ইন্দ্রিয়কে ব্যবহার করে শেখার এই পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের সম্পূর্ণ সক্ষমতা বিকাশে সহায়তা করে; শিক্ষণ পদ্ধতি আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। 

 

লেখক: হেড অব কম্পিউটার সায়েন্স
গ্লেনরিচ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল, উত্তরা (জুনিয়র শাখা)।
airin.tisha@uttara.glenrich.edu.bd 


সর্বশেষ সংবাদ