জুলাই হত্যাকাণ্ডে দল হিসেবে আ. লীগের দায় ও বিচার প্রসঙ্গ

   কল্লোল মোস্তফা
কল্লোল মোস্তফা  © টিডিসি সম্পাদিত

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সবচেয়ে বেশি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে সম্ভবত ৪ আগস্ট ২০২৪। ওই দিন সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ কর্মসূচি চলছিল। ওই কর্মসূচিকে ঘিরে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে রাজধানী ঢাকাসহ ২০টি জেলা-মহানগরে ৯৮ জন নিহত হন। 

প্রথম আলোর সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে, বেশির ভাগ জায়গায় বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালান মূলত ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও দলটির সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্রের পাশাপাশি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আন্দোলনকারীদের প্রতিরোধে রাস্তায় নেমেছিলেন তারা। তাদের অনেকের হাতে পিস্তল, শটগান, বন্দুক, কাটা রাইফেলের মতো আগ্নেয়াস্ত্র দেখা গেছে বলে জানিয়েছিলেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। 

আগের দিনগুলোতে বিক্ষোভকারীদের হত্যায় সরকারের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায় থাকলেও ৪ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মূল দায় ছিল আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের। কারণ প্রথম আলোর রিপোর্ট অনুসারে ওই দিন বেশির ভাগ স্থানে সংঘর্ষের সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সেভাবে দেখা যায়নি। তারা মূলত সরকারি স্থাপনা রক্ষায় বেশি মনোযোগী ছিলেন। (সূত্র: সারা দেশে ব্যাপক সংঘর্ষ, নিহত ৯৮, প্রথম আলো, ৫ আগস্ট ২০২৫) ।

এখন প্রশ্ন হলো, এই যে ৪ আগস্ট আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা অস্ত্রসস্ত্রসহ সারা দেশে বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালিয়েছিল, এটা কি নেতাকর্মীদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে হয়েছিল নাকি সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েই তারা এই হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছিল? এর উত্তর পাওয়া যায় ৫ আগস্ট প্রথম আলোতে প্রকাশিত আরেকটি রিপোর্ট থেকে। ‘আরও শক্তি দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ’ শিরোনামের রিপোর্ট অনুসারে, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এমনকি সেনাবাহিনী নামিয়েও যখন আন্দোলন দমন করা যাচ্ছিল না, ৩ তারিখ শনিবার যখন সরকারের পদত্যাগের এক দফা উঠে, তখন পরিস্থিতি সামাল দিতে ৩ আগস্ট শনিবার আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক বৈঠকে রাজনৈতিক শক্তিপ্রয়োগের মাধ্যমে এ আন্দোলন দমনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ীই ৩ আগস্ট শনিবার মধ্যরাতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা মাঠে নামার প্রস্তুতি নেন এবং ৪ তারিখ আন্দোলন প্রতিরোধের নামে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটান। শুধু ৪ তারিখই নয়, সামনে আরো তিন দিন দলের নেতা-কর্মীদের এভাবে শক্তিপ্রদর্শনের নির্দেশনা ছিল বলে আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা জানিয়েছিলেন। (আরও শক্তি দেখাতে চায় আওয়ামী লীগ, প্রথম আলো, ৫ আগস্ট, ২০২৫)।

ফলে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ যে দল হিসেবে অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। ফলে দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার করে আইন অনুসারে উপযুক্ত সাজা দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। এই সাজা সংশ্লিষ্ট আইনের বিধান অনুসারে নিবন্ধন বাতিল করা থেকে শুরু করে নিষিদ্ধ করা যে-কোন কিছুই হতে পারে। 

একটি কথা স্পষ্ট বলে রাখা ভাল। আমি মনে করি কোন রাজনৈতিক দল যখন সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়ে মাস কিলিয়ে যুক্ত হয়, তখন সেই দলের আর রাজনীতি করবার অধিকার থাকে না। যেমন, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী সাংগঠনিকভাবে মাস কিলিংয়ে যুক্ত ছিল বলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করবার অধিকার নাই বলে মনে করি, ঠিক একইভাবে মাস কিলিংয়ে যুক্ত থাকবার কারণে আওয়ামী লীগেরও রাজনীতি করবার অধিকার নাই বলে মনে করি। জুলাই অভ্যুত্থানে জামাত অংশ নিয়েছিল বলে তাদের কাফ্ফারা হয়ে গেছে বলে যে তত্ত্ব দেওয়া হয়েছে, আমি তার সাথে একমত নই। তবে দল হিসেবে এসব বিচার যথাযথ প্রক্রিয়া মেনে সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতেই হওয়া উচিত। নির্বাহী আদেশে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে যেমন লাভ হয়নি, নির্বাহী আদেশে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করেও কোন লাভ হবে না।

আরেকটা কথা। হত্যাকাণ্ডে জড়িত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের বিচার চাওয়ার অর্থ এই নয় যে, আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী হলেই তাকে মারধর করা বা পুলিশে দেওয়া গ্রহণযোগ্য। বিচার হতে হবে সুনির্দিষ্ট অপরাধের ভিত্তিতে৷ যিনি অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন তার অর্থনৈতিক অপরাধের বিচার করতে হবে। যিনি হত্যাকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন, তার হত্যাকাণ্ডের অপরাধের বিচার করতে হবে৷ আওয়ামী লীগ সমর্থক হলেই তাকে ঢালাও মামলা দিয়ে জেলে পাঠানো যাবে না। তাহলে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীদের যেমন ঢালাও মামলা দিয়ে, গ্রেফতার করে, বিচার বহির্ভূত হত্যা করে মজলুমে পরিণত করা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঘটনা ঘটবে এবং তারা জামায়াতে মতই কয়েক বছর পর জনসহানুভূতি নিয়ে রাজনৈতিক ভাবে পুনর্বাসিত হবে। তখন যেমন জামায়াত-শিবিরের নেতা কর্মীদের উপর চালানো ঢালাও নিপীড়নের বিরোধিতা করেছিলাম, এখন আওয়ামী লীগের নেতা কর্মী সমর্থকদের উপর ঢালাও নিপীড়নের বিরোধিতা করছি৷ আবারও বলি সুনির্দিষ্ট অপরাধে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্বচ্ছতার সাথে বিচার করতে হবে৷

লেখক: লেখক ও গবেষক


সর্বশেষ সংবাদ