অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে আমাদের সাহসী হতে হবে
- হোসাইন মোহাম্মদ হাই জকী
- প্রকাশ: ১১ মে ২০২৫, ০৭:৪০ AM , আপডেট: ১২ মে ২০২৫, ০৪:৩৪ AM
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। কমিশনের সব প্রস্তাব এই মুহূর্তে বাস্তবায়নযোগ্য নয়, আমার বিশ্বাস কমিশনের অনেক সদস্যগণও এটা বুঝেন। তবে তারা বেশকিছু জিনিস আলোচনায় আনতে সক্ষম হয়েছেন এটা কমিশনের প্রাথমিক সফলতা। আমার মতে কমিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, সময়োপযোগী ও আলোচিত প্রস্তাব হচ্ছে—সব ধর্মের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন, যার আওতায় বিয়ে, তালাক, ভরণপোষণ ও উত্তরাধিকারের মতো মৌলিক অধিকার সমানভাবে নিশ্চিত করা হবে। প্রতিবেদনটি প্রকাশের পরপরই সমাজের একটি অংশ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, বিশেষ করে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল গুলোর পক্ষ থেকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের সামাজিক বাস্তবতা বিবেচনায় তাদের উদ্বেগের যথার্থতা রয়েছে, তবে অনেক ক্ষেত্রেই ধর্মীয় গোঁড়ামি আমাদের সাধারণ বিবেচনাবোধকে ছাড়িয়ে যায়। প্রশ্ন হচ্ছে এ দেশে পারিবারিক আইন সংস্কারের প্রয়াস নিলেই কেন ধর্মের প্রসঙ্গ বারবার উঠে আসে, যেখানে অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বহু আইন আমরা অনেক বছর ধরেই মেনে চলছি।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্র ধর্মনিরপেক্ষ হবে এবং সব নাগরিকের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করবে; একইসঙ্গে প্রত্যেক নাগরিকের ধর্ম পালনের অধিকার স্বীকৃত। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়, পারিবারিক আইন, বিশেষ করে বিয়ে, তালাক, উত্তরাধিকার ও ভরণপোষণের মতো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ধর্মীয় নিয়মকানুনই বলবৎ থাকে। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের প্রত্যেকের জন্য রয়েছে আলাদা পারিবারিক আইন। এই আইনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক এবং বর্তমান সামাজিক বাস্তবতার সাথে অসামঞ্জস্যপূর্ণ । যেমন: মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে মেয়ের অংশ ছেলের চেয়ে অর্ধেক, অন্যদিকে হিন্দু নারীরা বাবার সম্পত্তিতে অধিকার পান না। হিন্দু আইনে বিবাহবিচ্ছেদের কোন সুযোগ নেই অথচ অনেক ক্ষেত্রেই বিচ্ছেদ অপরিহার্য হয়ে দাঁড়ায়, এই জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হন। হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী বিবাহ হল সাত জন্মের বন্ধন! এখন আপনার স্ত্রী বা স্বামী সম্পর্ক যদি এমন টক্সিক পর্যায়ে চলে যায় যে একজন আরেকজনকে একেবারে সহ্য করতে পারছেন না, বহুবছর ধরে সেপারেশনে আছেন—তাতেও হিন্দু আইনে আপনার কোন মুক্তি নেই। এই বৈষম্যগুলো মূলত ধর্মীয় ব্যাখ্যার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখা হয়েছে, যদিও এদের বেশিরভাগই প্রাচীন ও বর্তমান সময়ের সাথে একেবারে মানানসই না।
সম্প্রতি একজন উচ্চশিক্ষিত ভদ্রমহিলা মুসলিম উত্তরাধিকার আইনের সমর্থনে বলেছেন মেয়েরা বাবার অর্ধেক সম্পত্তি এখনো আদায় করতে পারেনি, তাই ভাইয়ের সমান সম্পদ চাওয়া অযৌক্তিক। আমি মনে করি এই অর্ধেক এর বিধান থেকেই এমন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে বোনদের সম্পদ না দিলে চলে! সমান সম্পত্তির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে তখন আর কাউকে বঞ্চিত করার চিন্তা মাথায় আসবে না। অনেকে বলার চেষ্টা করেন মুসলিম নারীরা স্বামীর কাছ থেকে সম্পদ পেয়ে থাকেন তাই বাবার সম্পত্তি থেকে কম পাবার বিধান যৌক্তিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো একজন মুসলিম নারী সন্তান থাকলে তার স্বামী মারা গেলে স্বামীর সম্পদের আট ভাগের এক ভাগের মালিক হন, অন্যদিকে স্ত্রী মারা গেলে স্বামী তার রেখে যাওয়া সম্পদের চার ভাগের এক ভাগ পান। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও মুসলিম পুরুষরা নারীদের চেয়ে দ্বিগুণ সম্পত্তি লাভ করেন। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কারো ছেলে সন্তান না থাকলে তার সম্পদের একটি বড় অংশ ভাইবোনেরা পান। তবে মৃত ব্যক্তির একটি ছেলে সন্তান থাকলে তাদের আর সেই সম্পত্তির উপর কোন অধিকার থাকে না। দেড় হাজার বছর আগের আরবের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বিধান হয়তো প্রাসঙ্গিক ছিল। তখন মানুষ গোত্রবদ্ধ হয়ে বসবাস করতো এবং চাচা বা চাচাতো ভাইদের মতো পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরকে তাদের নিরাপত্তা এবং ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে হতো। আধুনিক পরিবার ব্যবস্থার কারণে এখনকার চাচা বা চাচাতো ভাইদের এই দায়িত্ব নিতে হয় না। তবে ছেলে সন্তান না থাকার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে পারিবারিক ভাগবাটোয়ারার আগেই মৃত ব্যক্তির স্ত্রী-কন্যাদের কাছ থেকে কৌশলে সবচেয়ে দামি জমিগুলো আগে দখল করার কাজটি তারা ভালো করেই করে।
সকল ধর্মের প্রতি সম্মান রেখেই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে—রাষ্ট্র যদি পারিবারিক আইনে ধর্মের বিধান ধরে রাখে, তাহলে কেন অন্যান্য ক্ষেত্রে সেই বিধান মানা হয় না? বাংলাদেশে এমন অনেক প্রচলিত আইন রয়েছে যেগুলো ধর্মীয় বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ধর্মে চুরির শাস্তি হিসেবে শরীরের অঙ্গ কর্তনের বিধান রয়েছে, কিংবা ব্যভিচারের জন্য পাথর নিক্ষেপ করে হত্যার মতো কঠোর শাস্তির উল্লেখ আছে। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে চুরির শাস্তি জেল বা জরিমানা, কোনো শারীরিক শাস্তি নেই। ব্যভিচার এখন “সামাজিক অপরাধ” হিসেবে থাকলেও এর আইনি কাঠামো অনেকটাই সীমিত। বাস্তবতা হলো যখন ধর্মীয় আইন রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে সাংঘর্ষিক হয় এবং তা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর অনুকূল হয়, তখন সেটিকে চ্যালেঞ্জ করা হয় না। কিন্তু যখন তা নারীর অধিকারের পক্ষে যায়, তখন ধর্মের দোহাই দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়। কোন যুক্তি দিয়ে না পারলে শেষ পর্যন্ত ধর্মান্ধদের যুক্তি দাঁড়ায়—ঈশ্বরের বিধান তাই এটাই শ্রেষ্ঠ এবং এটাই মেনে চলতে হবে! একবার ভেবে দেখুনতো, পৃথিবীর হাজার হাজার ধর্মের লক্ষ লক্ষ অনুসারী যদি যার যার ঈশ্বরের বিধান সমাজে প্রতিষ্ঠা করতে চান তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? রাজা রামমোহন রায়ের উদ্যোগে ১৮২৯ সালে যখন সতীদাহ প্রথা বিলুপ্ত করা হয় তখনও অনেক ধর্মান্ধ মানুষ এই সমাজ সংস্কারকে ঈশ্বরের উপর হস্তক্ষেপ আখ্যা দিয়ে এর তীব্র বিরোধিতা করেছিল!
ধর্মীয় আবেগকে অনেক সময় ব্যবহৃত হতে দেখা যায় - আইন সংস্কার রোধ করার একটি হাতিয়ার হিসেবে। বিশেষ করে আমাদের পারিবারিক আইনে এটি বেশি পরিলক্ষিত হয়। কারণ, এই আইনের মাধ্যমেই পরিবারে নিয়ন্ত্রণের কাঠামো নির্ধারিত হয়। যেকোনো পরিবর্তন মানে বিদ্যমান ক্ষমতার ভারসাম্যে প্রভাব পড়া। একজন মুসলিম নারী যদি তালাকের ক্ষেত্রে পুরুষের সমান অধিকার পান, কিংবা উত্তরাধিকার অংশ সমান হয় - তাহলে সেই পরিবারে ‘পুরুষ কর্তৃত্ব’ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। সমাজের বহুক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গিই প্রবল থাকে এবং এই জায়গায় ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অনেক মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশেও পারিবারিক আইনকে যুগোপযোগী করে নারী অধিকারের দিক থেকে এগিয়ে নেওয়া হয়েছে। যেমন তিউনিসিয়ায় পুত্র ও কন্যার সমান উত্তরাধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মরক্কো ২০০৪ সালের নতুন পারিবারিক আইনে নারীর তালাক, সম্পত্তি ও সন্তান পালনে অধিক অধিকার নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে, ভারত ২০০৫ সালে হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংশোধন করে নারী-পুরুষের সমান অধিকারের আইন চালু করেছে যা দেশটির নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের এক বড় অর্জন।
একটি রাষ্ট্রের আইন তার নাগরিকদের সমান অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করার জন্য। এটি কখনোই কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা সম্প্রদায়ের সুবিধার্থে তৈরি হতে পারে না। ধর্মীয় বিশ্বাস থাকবেই, কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন হবে যুক্তি, ন্যায় ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে—এটাই হওয়া উচিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মূলনীতি। অভিন্ন পারিবারিক আইন মানে কারও ধর্ম পালনের অধিকার কেড়ে নেওয়া নয়; বরং এটি হবে এমন একটি কাঠামো, যেখানে ধর্ম নির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিকের অধিকার রক্ষা করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশের পারিবারিক আইন সংস্কার এখন সময়ের দাবি। ধর্মীয় অনুভূতিকে সম্মান দিয়ে, কিন্তু যুক্তিবোধ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। পুরোনো ব্যাখ্যার সঙ্গে নতুন বাস্তবতার মিল ঘটাতে না পারলে, একটি মানবিক ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। পারিবারিক আইনের প্রশ্নে আমাদের সাহসী হতে হবে। আমাদের জানতে হবে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় আবেগকে সম্মান জানানোর পাশাপাশি, নাগরিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব থেকে রাষ্ট্র সরে আসতে পারে না।
লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব। মাস্টার অব ইকনোমিকস এন্ড পাবলিক পলিসি (ডিস্টিংশন), দ্যা ইউনিভার্সিটি অব কুইন্সল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া।