সংবিধান রক্ষার শপথে ফ্যাসিবাদকে রক্ষার আয়োজন কতদূর?
- আশরাফুল ইসলাম নির্ঝর
- প্রকাশ: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:৫১ PM , আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০১:২৭ PM

জুলাইয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্ম থেকে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের আন্দোলন ছিল শুধু সরকারি চাকরিতে কোটার পুনর্বহালে সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে। কিন্তু হাসিনার পেটুয়া পুলিশ ও সন্ত্রাসী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের সন্ত্রাসীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর নগ্ন হামলা চালানোর পর থেকে ফুঁসে ওঠে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।
ছাত্রলীগ ও তাদের দোসর জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রসমাজ ব্যতিত সকল রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশে তীব্র আন্দোলনের রূপ ধারণ করে কোটা সংস্কারের আন্দোলন। একের পর এক আন্দোনকারী শিক্ষার্থী, শ্রমিক, রাজনৈতিক কর্মীরা শহীদ হবার পর আন্দোলন ধাবিত হয় সরকার পতনের আন্দোলনে। এখানে আন্দোলনই তার গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিল।
আন্দোলন শুরু করা সমন্বয়কদের মধ্যে ছয়জন যখন ডিবি হেফাজতে এবং বাকিদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা অধিকাংশ আত্মগোপনে থেকে ভিডিও বার্তা এবং ফেসবুক পোস্ট করে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন। তখন মাঠের আন্দোলনকারীরা খুনী হাসিনা সরকারের পতনকে টার্গেট করেই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে বুলেটের সামনে নিজেদের বুক পেতে দিয়ে।
বাড্ডা, রামপুরা, মিরপুর, যাত্রাবাড়ী, ইসিবি, উত্তরা রূপ নেয় স্ট্যালিনগ্রাদের। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা একের পর এক জীবন দিতে থাকেন স্বৈরাচার সরকারের নির্বিচার বুলেটের আঘাতে। ছাদের উপর খেলতে থাকা শিশু রিয়া গোপ, জানালার পাশে থাকা গর্ভবতী মা হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া গুলিতে শহীদ হন। আন্দোলনটা তখন সকল মুক্তিকামী জনতার অংশগ্রহণে এক ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের হাতে তখন কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। তারা চাইলেও তখন আন্দোলনের লাগাম টানতে পারতেন না। স্বৈরাচারবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের কর্মী, রিকশা শ্রমিক, গার্মেন্টস শ্রমিক, বেসরকারি চাকরিজীবী, কুলি-মজুর, কৃষক, ডাক্তার থেকে শুরু করে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ নিজেরাই সোৎসাহ থেকে স্বৈরাচার সরকারের বিরুদ্ধে রাস্তার প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেন।
সবার দাবির জায়গাটা তখন এক বিন্দুতে মিলিত হয়, খুনী হাসিনার স্বৈরাচার সরকারের পদত্যাগ করতেই হবে। দুই সহস্র কিংবা তার থেকেও অনেক বেশি নাম জানা-অজানা অনেক শহীদের সর্বোচ্চ ত্যাগ এবং অর্ধ লক্ষ আহতদের রক্তের বিনিময়ে ৩৬ জুলাই (৫ আগস্ট) গণ-অভ্যুত্থানের কাঙ্ক্ষিত বিজয় অর্জিত হয়।
গণভবন থেকে সামরিক বাহিনী ও এসএসএফের সহযোগিতায় ভারতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন দানবীয় স্বৈরাচার সরকারের প্রধান ও অসংখ্য গণহত্যার প্রধান আসামি খুনি হাসিনা। তৈরী হয় নতুন রাজনৈতিক সংকটের, কে ধরবেন দেশের হাল। সেনাবাহিনী নাকি রাজনৈতিক দলগুলো। কিন্তু তখনই সমন্বয়করা বিজয়ের পূর্ণ স্টেক দখলে নেন। সারাদেশে তখন বিজয়োৎসব চলছে, ঠিক তখনই রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এবং বঙ্গভবনে চলছে দীর্ঘ মিটিং।
থানাগুলো থেকে গুলি করতে করতে অসংখ্য জনগণকে হতাহত করে পালিয়ে যায় খুনী হাসিনার পেটুয়া পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। অতঃপর আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছাত্রসংগঠন, মাদরাসা শিক্ষার্থীদের এলায়েন্স সংগঠন ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এলায়েন্স সংগঠনগুলোর সাথে কোনরূপ আলোচনা ছাড়া দৈব ইশারায় গঠিত হয় অন্তবর্তীকালীন নামে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার।
শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে সমন্বয়কদের মধ্যে দুইজন সেই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেন, পরে আন্দোলনের বুদ্ধিবৃত্তিক পরামর্শদাতা মাহফুজ আলম যুক্ত হন উপদেষ্টা পরিষদে। যে দৈব ইশারায় এই উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হয়, সেই দৈব ইশারাটি ছিলো গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী বিপ্লবের স্বপ্ন ছিনতাই করার এক হীনমন্য সুশীল ধারার দুষ্ট চক্র।
যে সংবিধানকে থোড়াই কেয়ার করে সংসদ ও গণভবন দখলে নিয়েছিলো বিপ্লবী জনতা, সেই সংবিধানের দোহাই দিয়ে অবৈধ সরকারের রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ পড়ে সংবিধান রক্ষা করার দায়িত্ব নেয় হাজারো শহীদের রক্তে অর্জিত গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাগণ। ছিলেন শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে স্বনিয়োজিত গণ-অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয়া দু'জন ছাত্র উপদেষ্টাও।
যে সংবিধান রক্ষার শপথ তারা নিয়েছেন, সেই সংবিধান রক্ষা করতে হলে প্রথমে তাদেরকেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলতে হতো।তাদের সহযোগী হিসেবে আবির্ভূত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়করা। অথচ গণঅভ্যুত্থানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ত্যাগের তুলনায় অন্যান্য কলেজ, মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান কতটুকু কম বা বেশি ছিলো বিচার করার দায়িত্ব সম্মানিত পাঠকদের দিলাম।
তারপর সংবিধান বাতিল না করায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক ক্যু ঠেকানোর দায়িত্ব শিক্ষার্থীদের ঘাড়ে চাপে। কোন নূন্যতম সংস্কার ছাড়াই খুনী পুলিশকে পুনর্গঠন করা হয়। গণ-অভ্যুত্থানের স্টেকহোল্ডার ছাত্রসংগঠনগুলো হয়ে উঠেন উদ্ধারকারী জাহাজ রুস্তম। রিকশাওয়ালা, আনসারদের আন্দোলন, প্রতিবিপ্লব ঠেকানো, জুডিশিয়াল ক্যু, এডমিনিস্ট্রেটিভ ক্যু ঠেকানোর সময়ই কেবল ছাত্রসংগনগুলোর ডাক পড়ে।
কিন্তু সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ কিংবা সংস্কার কাজে শুধুমাত্র বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক ও তাদের টিম মেম্বার ছাড়া কারও অন্তর্ভুক্তি নেই। এতে করে নিজেদেরকে বিপ্লবের স্পিরিট ধারণকারী একক স্টেকহোল্ডার হিসেবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বিপ্লবকে চুরি হতে সহায়তা করতে থাকেন। অথচ যেসব উপদেষ্টা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে সরকারে গিয়েছেন তারাও এই সমন্বয়ক গ্রুপ ব্যাতিত গণ-অভ্যুত্থানের অন্য স্টেক হোল্ডারদের সাথে মতবিনিময় করার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেননি।
এই কারণেই তৈরি হয় গণঅভ্যুত্থানে নিজেদের অবদান তুলে ধরার প্রবণতা এবং ক্রেডিট ভাগাভাগি। এর সম্পূর্ণ দায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ঢাবির সমন্বয়কদের। তাদের একরোখা একক স্টেকহোল্ডারকে ডিফেন্ড করতেই সবাই নিজেদের অবদান জানান দেয়। তৈরী হয় গণ-অভ্যুত্থানের সকল শক্তির সাথে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মনস্তাত্ত্বিক দূরত্ব। এই দূরত্ব বৃদ্ধির দায় গণঅভ্যুত্থানকালীন সর্বজনীন প্লাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়কদের।
গণঅভ্যুত্থানের পর সকল স্টেকহোল্ডারদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করলেই বরং এই প্লাটফর্মটি তার সমর্থন সুসংহত রাখতে পারতো এবং কোনরূপ অনৈক্য হতো না। এই পরামর্শের বিকল্প হিসেবে জাতীয় ছাত্র কাউন্সিল গঠন করা যেতো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের তত্ত্বাবধানে। সেটাও করা যখন দৈব ইশারায় বন্ধ হয়, তখনই চূড়ান্ত অনৈক্য দেখা দেয়। যেখানে প্রফেসর ইউনুস বললেন শিক্ষার্থীরা তাকে নিয়োগ করেছেন, সেই নিয়োগকর্তা শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিদের কথা শোনার বা মতবিনিময় করার কোনরূপ শিষ্টাচার তিনি দেখাননি।
এই মতানৈক্য ধীরে ধীরে ক্যাম্পাসগুলোতে পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে উসকে দিয়ে রাজনৈতিক সহাবস্থানকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। অপরদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্লাটফর্মের অপরিপক্ক কতিপয় সমন্বয়করা শিক্ষার্থীদের যেকোনো আন্দোলন কিংবা কর্মসূচিকে ‘মব’ হিসেবে অবহিত করছেন। যাদেরকে তারা ‘মব’ হিসেবে অবিহিত করছেন, সেই মবদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণেই সংগঠিত হয়েছিল জুলাইয়ের ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থান।
তাদেরকে বিপ্লবী বা বিপ্লবের অংশ হিসেবে না দেখে ‘মব’ হিসেবে দেখা সমন্বয়করা ধীরে ধীরে নিজেদেরকে শিক্ষার্থীদের থেকে বিচ্ছিন্ন করছেন। এতে করে সর্বত্র তাদের নিজেদের মধ্যে অন্তঃকলহ দেখা দিচ্ছে এবং কমিটিগুলো নিয়ে মারামারি হচ্ছে। এটাই হচ্ছে তাদের স্বেচ্ছাচারীতা এবং একক স্টেকহোল্ডার হওয়ার পরিণতি।
এই সুযোগ নিয়ে পতিত স্বৈরাচার তৃণমূলে সংগঠিত হয়ে পুনরায় ফ্যাসিবাদকে মাথাচাড়া দিয়ে উঠার পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছে।সরকার জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করছে কিনা, কেন তারা খুনী পুলিশ এবং ফ্যাসিবাদের দোসরদের বিচারকার্য করতে পারছে না, সেদিকে কারও নজর আমার দৃষ্টিগোচর হয়নি। অথচ জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম দাবি খুনীদের বিচার করা এবং রাষ্ট্রের বিপ্লবী সংস্কার করার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সকল অধিকারগুলো নিশ্চিত করতে অনতিবিলম্বে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেয়া।
সর্বোপরি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছাত্র উপদেষ্টাগণের কাছে আমার প্রশ্ন, সংবিধান রক্ষার নামে ফ্যাসিবাদকে রক্ষা করার আয়োজন কতদূর হে ইন্টেরিম উপদেষ্টাগণ?
লেখক: সদস্য সচিব, বাংলাদেশ ছাত্রপক্ষ