ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিলেন মেডিকেল ছাত্রী সৌমা, রুমমেটকে ফাঁকি দিয়ে কয়েকদিন ধরে লিখছিলেন সুইসাইড নোট

শরিফা ইয়াসমিন সৌমা
শরিফা ইয়াসমিন সৌমা  © টিডিসি সম্পাদিত

ছোটবেলা থেকে মেধাবী শরিফা ইয়াসমিন সৌমা (২১) চেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে। কিন্তু পরিবারের সিদ্ধান্তে  পরীক্ষা দেন মেডিকেলে, চান্সও পান। ভর্তি হন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। তবে মেডিকেলের পড়ার সাথে খাপ খাওয়াতে পারেননি তিনি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন তিনি। একাডেমিক ও মানসিক চাপ সামলাতে না পেরে রুমমেটের চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েকদিন ধরে লিখেছেন সুইসাইড নোট। মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুর সোয়া ১টার দিকে ছাত্রী হোস্টেলের ৩১১ নম্বর কক্ষ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে সৌমা শরীরে ইনজেকশন প্রয়োগ করে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি সিরিঞ্জ ও ৪-৫ পৃষ্ঠার একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে।

সৌমা এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি খুলনার খালিশপুরের তায়েদুর রহমান ও ফাতেমা আক্তার দম্পতির মেয়ে।

তার সহপাঠীরা জানিয়েছেন, সৌমা ছোটবেলা থেকেই অত্যন্ত মেধাবী একজন শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি  ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে আগ্রহী ছিলেন।তাই শুরুতে মেডিকেলে পড়ার ইচ্ছা না থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতির কারণে যখন তাকে এই পথে আসতে হয় তখন সে আর মেডিকেলের এই কঠিন একাডেমিক ও মানসিক চাপের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারেননি। এজন্য দীর্ঘদিন ধরে হীনমন্যতায় ভুগছিলেন যা থেকে আর বের হতে পারেননি। অবশেষে এই যন্ত্রণার বোঝা সহ্য করতে না পেরে সে নিজের হাতেই জীবন শেষ করার সিদ্ধান্ত নেয়। 

সৌমার রুমমেট বলেন,সৌমা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে চেয়েছিলেন। মেডিকেলের একাডেমিক চাপের সাথে সে মানিয়ে নিতে পারে নি। গত কয়েকদিন ধরে সৌমাকে ডায়েরিতে লিখতে দেখেছি। কিন্তু তখন বুঝতে পারিনি যে সৌমা সুইসাইড নোট লিখছে। সৌমা অনেক ডিপ্রেশনে থাকত। ঠিকমতো ক্লাস করতো না। 

ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি মো. শিবিরুল ইসলাম জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে সৌমা শরীরে ইনজেকশন প্রয়োগ করে আত্মহত্যা করেছেন। ঘটনাস্থল থেকে একটি সিরিঞ্জ ও ৪-৫ পৃষ্ঠার একটি চিরকুট উদ্ধার করা হয়েছে, যেখানে তিনি মানসিক চাপ ও নানা কষ্টের কথা উল্লেখ করেছেন।

সুইসাইড নোটে সৌমা লেখেন লেখেন, তোমরা সবাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। দাদু, তুমি জানো আমি তোমাকে কতটা পছন্দ করি। আমি জানি তুমি আমাকে কত ভালোবাসো। তোমাকে হতাশ করায় আমি দুঃখিত।

ভাইয়া, তুমি সবচেয়ে চমৎকার, উদার মনের মানুষ। তোমার প্রতিটি ছোট্ট কাজ নজরে এসেছে। যখন প্রয়োজন হয়েছিল, তুমি উপদেশ দিয়ে আমাদের সবাইকে আগলে রেখেছো। মন শক্ত করো এবং দৃঢ় থাকো ভাইয়া। তুমি বড় হয়েছো। আর সব বাচ্চাদের জন্য অনেক ভালোবাসা—বাবাই, মিনি, বড় মাম্মা, আম্মা বুবি—তোমাদের সবাইকে আমি ভালোবাসি। তোমরা সবাই আমাদের জীবনের রঙধনু, আমাদের পরিবারের শক্তি।

অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করার উপায় খুঁজে বের করো, যদি পারো। এটা যেন আকাশের লাখো তারা থেকে একটিমাত্র আলোর চলে যাওয়ার মতো। আমি কোথাও একটা মজার কবিতা পড়েছিলাম, যার কয়েকটি লাইন আমাকে ছুঁয়ে গেছে—‘নক্ষত্রের মতো ঝলমলে মানুষরা নেমে আসে পৃথিবীতে আলো বিলাতে, কিন্তু কখনো কখনো তারা ফিরে যায়, যখন সময়ের আগে ডাক আসে।’

আম্মা, আপনার কাছে আসলে ক্ষমা চাওয়ার কোনো ভাষা নেই। আমি অত্যন্ত লজ্জিত আপনাকে এভাবে এই অবস্থায় ফেলতে। আপনি কোনো কমতি রাখেননি। পৃথিবীতে এর থেকে ভালো কোনো আম্মু আমি আশাও করতে পারি না। আমি শুকরিয়া আদায় করি যে আপনি আমার মা। আসলে আমি বোঝাতে পারব না আম্মু আমার কী অবস্থা। প্লিজ মাফ করে দিয়েন। নিজের যত্ন নিবেন আর ছাউগুলোর সাথে থাইকেন, মেলা কিছু শিখাতি হবে ওদের আপনার। Again I am sorry amma, I really am!

নিজের ভুল স্বীকার করা খুব কঠিন। আমি সবসময় চেষ্টা করেছি আপনাকে খুশি রাখতে, কিন্তু এই ব্যর্থতা মেনে নেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। আপনার জন্য আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়ে হতে পারিনি বলে নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমি জানি আপনি সবসময় আমার মঙ্গল চেয়েছেন, কিন্তু আমি আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু তাও আপনাকে হতাশ করেছি। দয়া করে আমার জন্য কাঁদবেন না, নিজের স্বাস্থ্যের যত্ন নেবেন। নিজের জীবনটা শান্তিতে কাটাবেন, কারণ কিছু ভুলের জন্য এত কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। আবারও বলছি, আমি দুঃখিত আম্মা, আমি সত্যিই দুঃখিত।

আমি ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। এমনকি এই তীব্র অবস্থা টানা এক সপ্তাহ চলেছিল। আমি খেতে পারতাম না, দিনে ৪–৫ বার বমি করতাম, মনে হতো আমার হৃদয় ফেটে যাবে। তবুও বেঁচে গেছি। ভেবেছিলাম এটা স্বাভাবিক—প্রথম ধাপ পার হলেই মানিয়ে নেব। হয়তো সময়ের সাথে পছন্দ করব। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।

আবার আমি ভোরে মাঠের মধ্যে দৌড়াচ্ছি, শ্বাস নেওয়ার জন্য হাপাচ্ছি। পড়াশোনায় ব্যর্থ হচ্ছি, কাজের বোঝা জমে যাচ্ছে, ফাঁকা চেয়ে থাকি পাতার দিকে ঘন্টার পর ঘন্টা। কখনো মনে হয় চিৎকার করে কেঁদে ফেলি, কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়। তাই আমি পায়ের দাগগুলোর দিকে তাকাই এবং মনে করি, জীবনে শুধু পড়াশোনা ছাড়াও অনেক কিছু আছে।

কিন্তু তারপরও মনে হয় আমি এখানে মানিয়ে নিতে পারছি না। সবসময় মনে হয় আমি যেন বহিরাগত—সবাইয়ের মধ্যে আলাদা, যেন কেউই আমাকে চায় না। আমি এত সাধারণ যে আলাদা করে চোখে পড়ি না—শুধুই অদৃশ্য। আমার মধ্যে কোনো বিশেষ গুণ নেই, নেই তীক্ষ্ণ বুদ্ধি, নেই অন্য প্রতিভা, এমনকি সুন্দর মুখও নয়। আমি প্রায় নীরব হয়ে যাই সপ্তাহের পর সপ্তাহ। আর বিশ্বাস করো, এই একাকীত্ব…

আমি আবেগে পড়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। বিগত কয়েকদিন ধরে আমার মধ্যে সুইসাইডের চিন্তা মাথায় ঘুরছিল। অবশেষে আজ আমি তা করলাম। 


সর্বশেষ সংবাদ