বিশ্ব খাল, কুমির ব্যাংক

  © টিডিসি ফটো

আবদুল গনি। এলাকায় গনি মিয়া নামে পরিচিত তিনি। কাজকর্মের চাইতে কথায় বেশি পারদর্শী বলে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতাও আছে তার। গনি মিয়ার সাথে দোকানে প্রায় সময় সবুর উদ্দিনের কথা কাটাকাটি হয়। কারণটাও চিরচেনা। দেশ, দেশের আইনশৃঙ্খলা, আইনের প্রয়োগ অপপ্রয়োগ, মানুষের দুর্দশা, দেশের ঋণ এসব নিয়েই প্রতিদিন নিজের যুক্তি তুলে ধরেন তিনি গনি মিয়া। আর কথা শুনতে শুনতে কারও বিরক্তি ভাব আসলে সবার উদ্দেশ্যে বলেন, ‘বাঁচতে হলে জানতে হবে’।

অপরদিকে সবুর উদ্দিন গনি মিয়ার প্রতিপক্ষ হয়ে প্রতিদিন যথাসময়ে হাজির হন। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বও আছে উভয়ের মধ্যে। কোনো কারণ না পেয়ে প্রতিদিন তর্কের জন্য দোকানে এসে হাজির হন সবুর উদ্দিন। আর গনি মিয়ার সকল জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ভেটো দেন। বিনিময়ে পান একরাশ তৃপ্তি।

সেদিন গনি মিয়া দেশের অর্থনীতির অদূরভবিষ্যৎ নিয়ে মন্তব্য করে বলেছিলেন, বিশ্ব ব্যাংক থেকে ধার করা হাজার হাজার কোটি টাকা খাল কেটে কুমির আনা ছাড়া আর কিছুই না। হ্যাঁ, অতঃপর কুমিরের চরিত্রে হাজির হলেন সবুর উদ্দিন। বললেন, খালে কুমির না আনলে আজকে সাধারণ এই খালটা পর্যটন কেন্দ্র হতো না। এখান থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার টাকা ইনকামও হতো না, বুঝছো গনি মিয়া?

গনি মিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর বললেন, কুমির চাষ করতে গিয়ে গরিবের শেষ ভরসা খালের মাছগুলো কুমিরকে খাওয়ানোর দরকারটা কি? খালের মধ্যে থাকা কয়েক লক্ষ টাকার মাছ ইতিমধ্যে শেষ করেছে কুমিরটা। প্রতিদিন কুমিরের খাদ্যের জন্য খরচ হচ্ছে আরও কয়েক হাজার টাকা। না হয় তো কুমিরটা খাল থেকে উঠে আপনাকেই চাবানো শুরু করবে।

তার উপর কুমিরের ভয়ে খাল দিয়ে চলাচল করা ছোট ছোট নৌকাগুলো এখন বিলীন হওয়ার পথে। প্রতিবছর খাল থেকে মাটি কেটে রাস্তার পাশটা ভরাট করা হতো। এখন মাটি কিনে আনতে হচ্ছে। প্রতিবছর রাস্তার এই কাজের জন্যই আবার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। খাল পরিষ্কার করার কোনো উপায় নেই। তাই খালের মধ্যে বেড়ে ওঠা কচুরিপানাগুলো অনেকদিন পরিষ্কার করা যাচ্ছে না। কচুরিপানার নিচে মাটিও জমতে শুরু করেছে। যেকোনো সময় খালের পানি চলাচল অস্বাভাবিক হয়ে যেতে পারে।

বাজারের উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে খালের উপর পানি চলাচল ঠিক রাখার শর্তে দোকানপাট করার অনুমতি দিয়েছে সরকার। কুমিরের জন্য সেটাও করতে পারছে না ব্যবসায়ীরা।

সবুর উদ্দিন এতক্ষণ চুপ করে সব শুনলেন। এবার তাচ্ছিল্যের স্বরে বললেন, মোল্লার উছিলায় শিন্নি খাইলা, কিন্তু মোল্লা চিনলা না। এই জন্যই তোমরা বাঙালী। শুনো গনি মিয়া, কুমিরটা আমাদের জন্য আল্লাহর রহমত। শুকরিয়া আদায় করো। মানুষ কুমির দেখতে চিড়িয়াখানায় যাওয়া লাগে। কিন্তু কুমিরের উছিলায় আশপাশের সবাই এই গ্রামে আসে। এই গ্রামের নাম এখন মানুষের মুখে মুখে।

গনি মিয়া বললেন, কয়জন মানুষ প্রতিদিন কুমির দেখতে আসে, কোনো তালিকা আছে? চিনেন তাদেরকে? সবুর উদ্দিন বললেন, আরে ১০/১৫ জনের সঙ্গে তো কুমির দেখতে আসার উছিলায় ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছে আমার। এমনকি আনোয়ার মুন্সি আর শাহিন একরামের সঙ্গে তো আমার অনেক দ্বন্দ্ব ছিলো। প্রায় সময় দেখা-সাক্ষাতে এখন তাদের সাথেও ভালো সম্পর্ক আমার।

গনি মিয়া একটু মুখ বেঁকিয়ে সবুর উদ্দিনের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘তোমার প্রিয় পর্যটকবৃন্দ কোনো আনোয়ার মুন্সি আর সাহিন একরামের প্রেরিত লোক নয় তো আবার? বাড়ির সামনের এত সুন্দর খালটাতে এত বড় কুমির ওরা এনে ছেড়ে দেইনি তো আবার?’ এই বলে গনি মিয়া মুচকি হাসলেন।

সবুর উদ্দিনও হাসলেন, তারপর গনি মিয়াকে পর্যটক বিরোধী, উন্নয়ন বিরোধী হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। এরপর নিজ দায়িত্বে সবার কাছে হেটে হেটে গনি মিয়ার মন্তব্যটা পৌঁছে দিতে লাগলেন। একদিন পূর্বের শত্রু আনোয়ার মুন্সিকেও হাসতে হাসতে গনি মিয়ার মন্তব্যটা বলে ফেললেন।

আনোয়ার মুন্সি এবার সবুর উদ্দিনের বিশ্বাস নামক গাছের গোড়ায় জল ঢালতে শুরু করেন। বললেন, আপনার উন্নয়নমুখী চিন্তাভাবনার জন্য এতবড় অপমান! আর সহ্য হচ্ছে না আমার। শুনেন সবুর উদ্দিন, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার স্বপ্ন পূরণে আপনাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। কারণ, গনি মিয়া শুধু আপনাকে নয়, আমাদেরও ছোট করেছে এই ধরনের কথা বলে।

এটা হবে কুমিরের খাল। মানুষ এখানে প্রতিনিয়ত ভিড় জমাবে কুমির দেখতে। শুধু একটা কুমির কেন? এখানে কমপক্ষে দশটা কুমির থাকবে। খাল দিয়ে কি আর হবে। গরিবের দু’এক বেলার মাছের জন্য এত বড় খালটা ফেলে রাখবো কেন? চলেন এটাকে পর্যটন কেন্দ্র বানাই। সবুর উদ্দিনও টাকার গরমে রাজি হয়ে গেলো। সবুর উদ্দিন পর্যটন কেন্দ্রের জন্য খালের বেশকিছু অংশ সরকারের কাছ থেকে ইজারা নিলো। বছরে ইজারা টাকা পরিশোধ করতে হবে ২ লক্ষ টাকা।

প্রথমদিকে জায়গা প্রস্তুত আর কুমির সংগ্রহ করতে খরচ হলো প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এরপর প্রতিদিন দশটা কুমিরের খাদ্য, কর্মচারীদের বেতন আরো কত কত খরচ বহন করতে হয়। অবশ্য খাদ্য, কর্মচারী এসবকিছু আনোয়ার মুন্সি দিয়ে থাকেন। মাস শেষে শুধু গুনে গুনে টাকাটা নিয়ে যান। এতে করে সবুর উদ্দিনের আর এসব নিয়ে টেনশন করতে হয় না। শুধুমাত্র টাকার টেনশনটা করলেই হয়।

এদিকে পর্যটকদের ভিড় জমেছে ভালোই। তবে কুমির ছাড়া অন্য তেমন কিছু না থাকাতে মানুষ ধীরে ধীরে আগ্রহ হারাতে থাকে। একবার কেউ আসলে পরেরবার আর আসে না। তাই দু'একবছর পর পর্যটক একেবারেই কমে এলো। ইদানীং আনোয়ার মুন্সির পরামর্শে বিভিন্ন ইভেন্টের ব্যবস্থা করেন সবুর উদ্দিন। যার ফলে মানুষ পুরস্কারের আশায় ঘুরে যান। কিন্তু এতে করে উল্টো ভর্তুকি গুনতে হচ্ছে সবুর উদ্দিনকে। তাই ভাগ্যের উপরে ছেড়ে দিলেন পর্যটকদের আসা যাওয়ার ব্যাপারটা।

এর বছরখানেক পর সবুর উদ্দিনের হাতে থাকা টাকা কড়ি প্রায় সব শেষ। ধারদেনা করে চলেন এখন তিনি। যদিও কুমিরের খাদ্য আর কর্মচারীর বেতন যথাসময়ে পৌঁছে দিতে হয় আনোয়ার মুন্সির নিকট। আনোয়ার মুন্সি অবশ্য আগেই চুক্তির সময় বলে রেখেছিলেন, ‘সম্পর্ক সম্পর্কের জায়গায়, কিন্তু টাকা পয়সায় যাতে গড়মিল না হয়’। তাই সবুর উদ্দিনও টাকা পয়সার বিষয়টা এদিক সেদিক করেন না।

ধারদেনা বাড়তে থাকে সবুর উদ্দিনের। অনেকের কাছ থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে থাকেন তিনি। একদিন সবুর উদ্দিন খালের কুমিরগুলোকে খাওয়াতে খাওয়াতে নিজের এই অধঃপতনের আদ্যোপান্ত আওড়াচ্ছিলেন। হঠাৎ গনি মিয়ার সেই কথা মনে পড়ে তার। ‘তোমার প্রিয় পর্যটকবৃন্দ কোনো আনোয়ার মুন্সি আর সাহিন একরামের প্রেরিত লোক নয় তো আবার? বাড়ির সামনের এত সুন্দর খালটাতে এত বড় কুমির ওরা এনে ছেড়ে দেইনি তো আবার?’ সবুর উদ্দিনের এসব মনে উঠতেই স্ট্রোক করেন তিনি। গড়িয়ে পড়েন খালের মধ্যে। ক্ষুধার্ত কুমিরগুলো সবুর উদ্দিনকে কামড়ে কামড়ে খেয়ে নিঃশেষ করে দিয়েছে দুই মিনিটেই।

সবুর উদ্দিনের এমন মৃত্যুর কথা শুনে আনোয়ার মুন্সি আর সাহিন একরাম জঘন্য অট্টহাসি হাসলেন। পরদিন সবুর উদ্দিনের সহচর হিসেবে কুমিরগুলোকে খাল থেকে সরিয়ে নিলেন আনোয়ার মুন্সি। পাশাপাশি গত কয়েক বছরের জমে থাকা সরকারের বাৎসরিক ট্যাক্সের বিনিময়ে সবুর উদ্দিনের সায় সম্পত্তি সবকিছু সরকারের হাতে তুলে দিলেন। নিজেরাও বড় একটা অংশ লুপে নিলেন।

সবুর উদ্দিনের ভাগ্যে কোনো কবরও জোটেনি। কুমিরের পেটেই তো মৃত্যু হয়েছে। তাই আত্মাটা ঘুরে বেড়াচ্ছিলো বাড়ির আশেপাশেই। আনোয়ার মুন্সি আর শাহিন একরাম একদিন কোনো এক রেষ্টুরেন্টে বসে হো হো করে হাসতে হাসতে বলছিলেন, বোকা সবুর উদ্দিন জানেই না, প্রথম কুমিরটাও খালে আমরাই ঢুকিয়ে ছিলাম। আরে আমরাই তো সেই বিশ্ব ব্যাংক। আর ঋণগুলো হচ্ছে একেকটা কুমির। সবুর উদ্দিনের আত্মাটা সবকিছু শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। চিৎকার করতে লাগলেন। হঠাৎ সবুর উদ্দিনের ঘুম ভাঙ্গে। কি যেন দেখলেন? এলোমেলো করে স্ত্রীকে বলেই ফেললেন, বিশ্ব খাল, কুমির ব্যাংকের আদ্যোপান্ত জানলাম আজ।

সবুর উদ্দিনে আজ বিশ্ব ব্যাংক সম্পর্কে ধারণা হলো। তড়িঘড়ি করে দোকানে গিয়ে গনি মিয়াকে খুঁজতে লাগলেন। হঠাৎ শুনতে পেলেন, কেউ একজন গনি মিয়ার অনুপস্থিতিতে তাচ্ছিল্য করে বলছিলো ‘গনি মিয়া প্রতিদিন খাবারের সময় যে বিষয়ে আলোচনা করেন, তা হলো, খেতে বসে কথা বলা ঠিক না’। আরে পারলে নিজে কিছু করেন। না হয় চুপ থাকলেই তো হয়। এটা বলেই সবাইকে নিয়ে হাসাহাসি করছিলেন।

সবুর উদ্দিন এবার গনি মিয়ার পক্ষ নিলেন।প্রতিবাদ করে বললেন, গনি মিয়াদের মুখ আটকানো উচিৎ না। কারণ, গনি মিয়ার মত যদি সবাই সমসাময়িক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা পর্যালোচনা করতো। তাহলে আজ খাবারের প্লেট থেকে শুরু করে বিশ্ব ব্যাংক পর্যন্ত সবই জানা হতো আমাদের। আমরা জানতে পারতাম প্রকৃত বন্ধু আর শত্রুর পার্থক্য। হয়তোবা আমরা আরও সমৃদ্ধ হতাম। আমাদের সমাজে গনি মিয়াদের কদর নেই। এমনকি আমাদের স্বপ্নেও না!


সর্বশেষ সংবাদ