১৪ জুলাই : রাজাকার বলে সম্বোধন হাসিনার, ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম শিক্ষার্থীদের
গণপদযাত্রা, রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি ও শেখ হাসিনার মন্তব্যের পর শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ১৪ জুলাই ২০২৫, ১১:১৫ AM , আপডেট: ১৫ জুলাই ২০২৫, ০৮:২৮ PM
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে চলমান আন্দোলনের ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই (রোববার) ঢাকায় পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। সেই সঙ্গে সারাদেশে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একই দিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে সম্বোধন করলে শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটে এবং মধ্যরাতে ঢাবি ক্যাম্পাসজুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
এর আগের দিন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে বঙ্গভবন অভিমুখে পদযাত্রা ও রাষ্ট্রপতির উদ্দেশ্যে স্মারকলিপি প্রদানের কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। এই কর্মসূচিতে অংশ নিতে রোববার বেলা ১১টা থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১২টায় পদযাত্রা শুরু করে তারা শাহবাগ, মৎস্য ভবন পেরিয়ে হাইকোর্টের সামনে পৌঁছালে পুলিশ বাধা দেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের দিক দিয়ে অগ্রসর হলে গুলিস্তানে পুলিশ ফের ব্যারিকেড দেয়। সেখানে বসে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। একপর্যায়ে জিরো পয়েন্টের ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যান তারা।
গুলিস্তান পাতাল মার্কেটের কাছে পৌঁছালে আবারও পুলিশ তাদের আটকানোর চেষ্টা করে। বিপুলসংখ্যক পুলিশ সদস্য, জলকামান ও সাঁজোয়া যান প্রস্তুত রাখা হয়। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে হাজারো শিক্ষার্থী সেখানে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দেন।
আরও পড়ুন: ‘বাবা আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না’— মেয়ের চিঠি পড়া হল না শহীদ রিয়াজুলের
অবশেষে বেলা আড়াইটার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল বঙ্গভবনে প্রবেশ করে রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন। বিকেল ৩টার দিকে তারা ফিরে এসে জানান, স্মারকলিপিতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার প্রতিবাদ, তাদের বিরুদ্ধে করা মামলা প্রত্যাহার এবং কোটা সংস্কারের একদফা বাস্তবায়নের সুপারিশ জানানো হয়েছে।
স্মারকলিপিতে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের মাধ্যমে নবম থেকে ত্রয়োদশ গ্রেড পর্যন্ত কোটা বাতিল করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তখন থেকেই সব গ্রেডে যৌক্তিক কোটা সংস্কারের দাবি জানিয়ে আসছে। স্মারকলিপিতে অনগ্রসর ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন গোষ্ঠীর জন্য সর্বোচ্চ ৫% কোটাসহ আইনি সংস্কারের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।
প্রতিনিধিদল থেকে ফিরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আমরা রাষ্ট্রপতির কাছে ২৪ ঘণ্টার সুপারিশ দিয়েছি। এই সময়ের মধ্যে সংসদে অধিবেশন ডেকে এক দফা বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে কর্মসূচি আরও কঠোর হবে।” তিনি জানান, মামলার বিষয়েও ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছিল, যা আরও ২৪ ঘণ্টা বাড়ানো হচ্ছে।
বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে শিক্ষার্থীদের একাংশ মিছিল নিয়ে তাঁতীবাজার হয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে যায়, আরেকাংশ ফিরে যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
আরও পড়ুন: মায়ের স্বপ্নভঙ্গ: গ্রামে মাকে নিয়ে আর ফেরা হলো না শহীদ জামাল উদ্দিনের
এদিন ঢাকার বাইরে দেশের প্রায় সব বিভাগীয় ও জেলা শহরে স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি পালিত হয়। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দুপুর ১টায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকের (রাজস্ব) কাছে স্মারকলিপি দেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিকেল ৩টায় ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্মারকলিপি দেন। সেখানে আনন্দ মোহন কলেজসহ বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শহরের পুলিশ লাইন্স থেকে পদযাত্রা করে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। এই কর্মসূচিতে জেলার বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও অংশ নেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বেলা সাড়ে ১১টায় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে যান এবং সেখানে সংহতি সমাবেশ করেন।
বরিশালে সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজ, সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, বরিশাল সিটি কলেজ, পলিটেকনিক কলেজ ও বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পৃথক মিছিল নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে স্মারকলিপি জমা দেন। কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সকাল সাড়ে ১০টায় জেলার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে স্মারকলিপি প্রদান করেন।
পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি দেন। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রংপুর সরকারি কলেজ, কারমাইকেল কলেজসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে জেলা প্রশাসকের কাছে স্মারকলিপি জমা দেন।
ঝিনাইদহ, নাটোর, নেত্রকোনার দুর্গাপুর, টাঙ্গাইল ও কুড়িগ্রামের চিলমারীতেও স্মারকলিপি প্রদানসহ পদযাত্রা, মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। এই দিনেই সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে সরকারি চাকরিতে কোটা বহাল রেখে হাইকোর্টের ২৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
আরও পড়ুন: প্রাণভিক্ষা চেয়েও গুলি থেকে শেষ রক্ষা পাননি কোরবান
এদিকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা না বুঝেই আন্দোলন করছে। উসকানিদাতা আছে। মেরিট দেখে মামলা করা হয়েছে, যত আল্টিমেটামই দিক তদন্ত চলবে।’ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জানান, ‘মন্ত্রিসভায় আলোচনা করে কোটা নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে।’
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিএনপি ও সমমনাদের হাত ধরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রূপ দিতে চাচ্ছে।’
সবচেয়ে বিতর্কিত ও উত্তাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্তব্য ঘিরে। বিকেলে গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা নিয়ে আমার কিছু করার নেই, সমাধান হবে আদালতে।’ পরে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিরা পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা চাকরি পাবে?’
শেখ হাসিনার এ বক্তব্যে শিক্ষার্থীরা প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল থেকে শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে বের হয়ে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের সামনে জড়ো হন। প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন রোকেয়া হল, বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হল, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল, শামসুন্নাহার হলসহ ছাত্রী হলের শিক্ষার্থীরাও। বিক্ষোভে তারা স্লোগান দেন— ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার! রাজাকার!’, ‘মেধা না কোটা, মেধা মেধা!’ স্লোগানে মধ্যরাতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেঁপে ওঠে।
টিএসসিতে বিক্ষোভ শেষে রাত দেড়টার দিকে শিক্ষার্থীরা হলে ফিরে যান। কিছুক্ষণ পর বুয়েটের কয়েকশ’ শিক্ষার্থী মিছিল নিয়ে টিএসসি এসে সংহতি জানান এবং নিজেদের ক্যাম্পাসে ফিরে যান। এরপর শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হকের সামনে বিক্ষোভ ও মশাল মিছিল করেন আন্দোলনকারীরা।
এদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা চালায়। একই রাতে ছাত্রলীগের তিনজন নেতা সংগঠন থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।