নদ্দা ওভারব্রিজের নিচে পড়ে ছিল মাছ বিক্রেতা আমজাদের লাশ
- জাবির আহম্মেদ জিহাদ, জামালপুর প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৩ জুলাই ২০২৫, ১১:২৫ AM , আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৫, ০২:০১ PM
২০২৪ সালের রক্তাক্ত জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন তখন ঢাকাজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে। উত্তাল রাজধানীর রাজপথে যখন তরুণদের স্বপ্ন ও স্লোগানে ভেসে যাচ্ছিল আকাশ, তখনই নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে একে একে নিভিয়ে দেওয়া হচ্ছিল বহু জীবন। এমন এক দুপুরে, ঢাকার নদ্দা ওভারব্রিজের নিচে পড়ে ছিল এক নীরব মানুষের নিথর দেহ। যিনি রাজনীতির লোক নন, আন্দোলনের নেতা নন, ছিলেন একজন মাছ ব্যবসায়ী—তার নাম আমজাদ হোসেন।
১৯৮০ সালের ১০ অক্টোবর জামালপুর জেলার মেলান্দহ উপজেলার পশ্চিম শ্যামপুর গ্রামে জন্ম নেওয়া আমজাদ হোসেন ছিলেন পরিবারটির বড় সন্তান। বাবা আকি মোল্লার মৃত্যুর পর মাতা আয়শালী হক একাই সন্তানদের বড় করেন। সংসারের হাল ধরতে ছোটবেলা থেকেই এগিয়ে আসেন আমজাদ। পড়াশোনা করেছিলেন গ্রামের স্কুলে। শিক্ষক-সহপাঠীদের কাছে ছিলেন প্রিয়, কিন্তু দারিদ্র্যের কাছে হার মানতে হয় পড়ালেখাকে।
অল্প বয়সেই ঢাকায় এসে শুরু করেন মাছের ব্যবসা। বাজারে দাঁড়িয়ে ঘাম ঝরিয়ে যে মাছ বিক্রি করতেন, তা দিয়েই চলতো পরিবারের রোজগার। কিন্তু ব্যবসা করাও সহজ ছিল না। পুলিশি হয়রানি, বাজার সিন্ডিকেট, অবৈধ চাঁদাবাজির ভেতরেও আমজাদ চালিয়ে গেছেন তার সংগ্রাম—নীরবে, কিন্তু মাথা উঁচু করে।
আরও পড়ুন: বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন হওয়া ১২০ শহীদের পরিচয় এখনও মেলেনি
সেই আমজাদ হোসেনও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি পুলিশের গুলির মুখ থেকে। ২০২৪ সালের ২০ জুলাই। রাজধানীর নদ্দা ওভারব্রিজ এলাকায় তখন চলছিল শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ। হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাজপথে। আমজাদ তখন কাছেই মাছ পৌঁছে দিয়ে ফিরছিলেন। সময়টা দুপুর ১টা ৪৫। হঠাৎ পুলিশের গুলিতে এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ছাত্র-জনতা দৌড় দেয়, অনেকে পড়ে যায়। সেই সময়ই একটি গুলি বিদ্ধ করে আমজাদের বুক। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।
পরিবারের কাছে খবর পৌঁছায় অনেক পরে। তার মা আয়শালী হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার ছেলে তো কাউকে কিছু বলতো না। নিজের পরিশ্রমে সংসার চালাতো। রাজনীতি করতো না। ওর কি দোষ ছিল? কেন ওকে গুলি করে মারলো? এই প্রশ্নের জবাব এখনো মেলেনি।’
তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয় সেই রাতে। একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে মা শুধু চোখের পানি ফেলেন। আমজাদের প্রতিবেশীরা বলেন, ‘আমরা অনেক নেতা-মন্ত্রী দেখেছি। কিন্তু আমজাদ ছিল নিঃস্ব, কিন্তু চরিত্রে বড়। সে ছিল একজন সৎ মানুষ।’
পরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে আমজাদের ছবি, তার মৃতদেহ পড়ে থাকার দৃশ্য, এবং মায়ের বুকফাটা কান্না। অনেকেই লেখেন— ‘এই মানুষটার কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল না, তবুও তাকে হত্যা করা হলো শুধু অন্যায়ের প্রতিবাদী জনতার পাশে দাঁড়ানোর অপরাধে।’
গ্রামের যুবসমাজ মিলে একটি স্মৃতিফলক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। তারা বলে— আমজাদ ভাই রাজনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু তিনিই ছিলেন ন্যায়ের একজন শহীদ।
আরও পড়ুন: ‘রিয়াদ বাঁচলে বিসিএস ক্যাডার হতো, সব স্বপ্ন এক নিমিষে শেষ’
আজও তার মা প্রতিদিন ফজরের নামাজ শেষে ছেলের কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকেন। শীত, বর্ষা, ঈদ—সব চলে যায়, কিন্তু মায়ের চোখে এখনো থেমে আছে সেই এক দুপুর, নদ্দার ওভারব্রিজের নিচে পড়ে থাকা নিঃশব্দ লাশটার সময়।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে কোটা সংস্কারের দাবিতে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা ন্যায্য অধিকার আদায়ের দাবিতে আন্দোলনে নামেন। শুরুতে এই আন্দোলন ছিল শান্তিপূর্ণ, কিন্তু সরকার তা দমন-পীড়নের মাধ্যমে প্রতিহত করার চেষ্টা করে। এতে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকার এই শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে দমন-পীড়নের মাধ্যমে থামাতে গিয়ে সরকারই আরও প্রবল প্রতিরোধের মুখে পড়ে। ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমনে সরকারের সহিংস হস্তক্ষেপে প্রায় হাজারো নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারান, আহত হন হাজার হাজার। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে আন্দোলন পরিণত হয় গণঅভ্যুত্থানে। পতন ঘটে টানা ১৫ বছর ক্ষমতায় থেকে দীর্ঘদিন নিপীড়ন নির্যাতন চালানো আওয়ামী লীগ সরকারের। ক্ষমতাসীন দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন।