বাবা ছিলেন আইনজীবী, ডাক্তারের স্বপ্ন রেখে মেয়ে হলেন সহকারী জজ
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের ১৬তম (বিজেএসসি) নিয়োগ পরীক্ষায় সহকারী জজ পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন ফারজানা দিবা লিসা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) আইন বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। বাবার মৃত্যুর আগে তাকে দেওয়া কথা রাখতেই বিচারক হয়েছেন তিনি। সম্প্রতি তিনি তার সাফল্য ও শিক্ষা জীবন নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের মুখোমুখি হয়েছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন—আমান উল্যাহ আলভী।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ১৬তম বিজেএসসি পরীক্ষায় আপনিও সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। আপনার জন্ম, শৈশবকাল সম্পর্কে জানতে চাই।
ফারজানা দিবা লিসা: আমার জন্ম সাতক্ষীরাতে। সেখানেই আমার বেড়ে ওঠা। সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এখন তো আপনি সহকারী জজের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। আপনার এ অনুভূতিটা সম্পর্কে বলুন।
ফারজানা দিবা লিসা: মা, ভাই ও বোনের সাথে আমি ঢাকায় থাকি। ফল প্রকাশের সময় বড় ভাইয়ের কনফিডেন্স ছিল আমি সফল হবো। তাই সে তখন আগে থেকে মোবাইলে ভিডিও অন করে রাখে। পরে ভাইয়া রেজাল্ট দেখার পর যখন বলে তুই ৭৮তম হয়েছিস, তখন আমি রেজাল্ট চেক না করে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বাসার চারজন মানুষই জড়িয়ে ধরে কান্না করতে ছিলাম। তখন খুশিতে কান্না চলে আসছিল। সেই মুহূর্তটা আসলে অন্যরকম অনুভূতি।
আমি যখন আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন বাবা প্যারালাইজড ছিলেন। তখন বাবাকে দুটো আঙুল দেখিয়ে বলেছিলাম, প্রথমটাতে বিচারক আর দ্বিতীয়টাতে আইনজীবী। তখন তিনি ইশারায় বলেছিলেন, আমি যেন বিচারক হই।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিচারক হওয়ার স্বপ্নদ্রষ্টা কে, কীভাবে এ স্বপ্নের শুরু হয়েছিল?
ফারজানা দিবা লিসা: আমি যখন স্কুলে পড়ি তখন বিজ্ঞান নিয়ে পড়ালেখা করেছিলাম। স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হওয়ার। যখন ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিচ্ছি তখনও আমার ইচ্ছে ছিল ডাক্তার হবো। তখন সাতক্ষীরা মেডিক্যাল থেকে একটা বড় ভাই আমাকে মেডিক্যালের বই ও দিয়ে ছিল প্রিপারেশনের জন্য। কিন্তু আমার ভাইয়া বলেছিলো ডাক্তার হতে অনেকদিন সময় লাগবে। তাই সে আমাকে আইন নিয়ে পড়ার পরামর্শ দেয়।
তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য টার্গেট রেখে প্রস্তুতি শুরু করি। তখন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় আইনে ২১তম স্থান অর্জন করি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনে পড়ার সুযোগ পাই। তখন ভাইয়া আমাকে বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে ভর্তি হতে। সেখান থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল আমি জুডিশিয়ারিতে আসবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিচারক হওয়ার পেছনে কার অবদান সবচেয়ে বেশি?
ফারজানা দিবা লিসা: সবচেয়ে বেশি অবদান ছিলো আমার বাবা-মায়ের। আমার বাবাও ছিলেন একজন আইনজীবী। আমি যখন আইনের প্রথম বর্ষের ছাত্রী তখন বাবা প্যারালাইজড ছিলেন। কথা বলতে পারতেন না। উনার ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছিল। তখন বাবাকে দুটো আঙুল দেখিয়ে বলেছিলাম, প্রথমটাতে বিচারক আর দ্বিতীয়টাতে আইনজীবী। তখন তিনি ইশারায় বলেছিলেন, আমি যেন বিচারক হই। আমার বাবা ২০১৬ সালে মারা যান। কিন্তু বাবাকে যে একটা কথা দেওয়া ছিল, সে কথাটা আমার রাখতেই হবে। আর এখানে আমার ভাইয়েরও স্বপ্ন ছিল, তার বোন যেন বিচারক হয়। ভাইয়ার দিক নির্দেশনায় আজ আমি সফল।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার সাফল্যের পেছনে কোন বিষয়গুলো কাজ করেছে?
ফারজানা দিবা লিসা: আমি কখনোই খারাপ স্টুডেন্ট ছিলাম না। কিন্তু আমি অনেক পরিশ্রম করে এসে যখন ঢাবির আইনের প্রথম বর্ষে বাবাকে হারাই তখন ঠিক মতো ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিতে পারিনি।
আমার ফার্স্ট ইয়ারের রেজাল্ট ছিল ২.৮০। যেখানে আমার স্বপ্ন ছিল আমি অনেক ভালো রেজাল্ট করবো। প্রথমবারই জুডিশিয়ারিতে আসবো। কিন্তু আমার বাবা যখন হাসপাতালে ছিলো তখন আমাকেই সবকিছু দেখাশোনা করতে হয়েছে। আমি বেশিরভাগ সময় সেখানেই থাকতাম। এ কারণে ঠিক মতো ক্লাস করতে পারতাম না।
আমার যখন টিউটরিয়াল পরীক্ষা আমি একটা পরীক্ষাও অংশ নিতে পারিনি। এটার কারণে আমি অনেক ভেঙে পড়ি। তখন আমার একটা প্রতিজ্ঞা ছিলো, আমি যে মানের স্টুডেন্ট সেটা সবাইকে দেখাতে হবে। আর বিচারকের জায়গা তো একটা একটা সম্মানের। তাই নিজের মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে। আর বড় ভাইয়া-আপুরা যখন সফল হয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পোস্ট করতেন, ওই আলহামদুলিল্লাহর ভালো লাগা থেকেই আজকের বিচারক হওয়া।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছেন, দিনে কত ঘণ্টা করে পড়ালেখা করেছেন?
ফারজানা দিবা লিসা: পড়ার তেমন কোনো নির্দিষ্টতা ছিলো না। অনেক সময় এমনও হয়েছে যে রাতে পড়তে পড়তে ফজরের আজান দিয়ে দিয়েছে। তখন ভাইয়াও অবাক হতেন। এমনও হয়েছে আমি ফজরের নামাজ পড়ে ঘুমাতে গিয়েছি। এমনও হয়েছে আমি বাইরে কোথাও গিয়েছি, আমার সাথে বই আছে বা ফোনে কিছু পড়তেছি। মানে বোঝাতে চাচ্ছি, একটা সময়ও আমি নষ্ট করিনি, সময়গুলো খুব গুরুত্ব সহকারে নিয়েছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: কতবার ভাইবা দিয়েছেন এবং কততম ভাইভাতে সফল হয়েছেন?
ফারজানা দিবা লিসা: প্রথমবার আমি প্রিপারেশন অনেক দেরিতে শুরু করার কারণে সে বার হয়নি। দ্বিতীয়বারের ভাইবাতে আমি সফল হয়েছি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: যারা বিচারক হতে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?
ফারজানা দিবা লিসা: নবীনদের উদ্দেশে একটাই কথা, যার যে লক্ষ্য থাকুক সময় নষ্ট না করে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। সৃষ্টিকর্তার প্রতিও বিশ্বাস রাখতে হবে। সাফল্য আসবেই ইনশাল্লাহ।
দুনিয়াতে বসেই কাউকে বিচার করতে পারছি, এই সম্মানটা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এ সম্মানটা নষ্ট করবো না। আমি কখনোই চাইবো না, আমার মাধ্যমে কোনো দুর্নীতি বা কোনো মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হোক।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিচারক হিসেবে দেশের জন্য আপনি কি অবদান রাখতে চান?
ফারজানা দিবা লিসা: দুনিয়াতে বসেই কাউকে বিচার করতে পারছি, এই সম্মানটা আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। এ সম্মানটা নষ্ট করবো না। আমি কখনোই চাইবো না, আমার মাধ্যমে কোনো দুর্নীতি বা কোনো মানুষ ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হোক।
যখন মানুষ বিচার পেতে আদালতে যায়, সে মানুষটার অবস্থা আমরা বুঝতে পারলে আমরা তাদেরকে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করতাম না। তাদের একটা শেষ আশার জায়গা হলো আদালত। সে আদালতে যদি আমি ন্যায় বিচারটা না দিতে পারি তাহলে এই জীবনেও আমি তাদের কাছে দায়ী থাকবো এবং পরকালেও আল্লাহর কাছে আমি এটার জন্য দায়ী থাকবো।
তাই আমি ন্যায়বিচারটা সর্বপ্রথম নিশ্চিত করতে চাই। সব জায়গায় যেন ন্যায় বিচার নিশ্চিত হয় আমার হাতের মধ্যে যতটুকু থাকবে, সেটা নিয়ে আমি কাজ করবো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ভাইবার সময় কোন বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে, আপনি কীভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন?
ফারজানা দিবা লিসা: আইন তুমি কত অল্প জানো এটা ব্যাপার না। কিন্তু যে আইনটা জানো সে আইনটা যেন নাড়ি-নক্ষত্র জানো। যে এই বিষয়টা আমি জানি এই বিষয়টা থেকে দশটা প্রশ্ন আসলেও যেন পারি। ভাইবাতে নরমালি একটা বিষয়ে ঢুকলে সেখান থেকেই একাধিক প্রশ্ন করা হয়। এমন পরিস্থিতিতে যে প্রশ্নটাই করা হোক না কেন তুমি যেন উত্তর করতে পারো সে কনিফিডেন্টটা থাকতে হবে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনার গুরুত্বপূর্ণ সময়ের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
ফারজানা দিবা লিসা: দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের জন্য শুভকামনা রইলো।