মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি
নিহত, নিখোঁজ ও অশনাক্তের সংখ্যার হিসাব নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না
- আশরাফ আন নূর
- প্রকাশ: ২৪ জুলাই ২০২৫, ০৮:১৩ AM , আপডেট: ২৮ জুলাই ২০২৫, ০৭:৫১ PM
ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা নিহত ও আহতদের সংখ্যা নিয়ে নানান ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এ নিয়ে নানান আলোচনা-সমালোচনাও চলছে। এর কারণে হিসেবে নানা ধরনের বক্তব্য সামনে এলেও ধোঁয়াশা কাটছে না। তবে হিসাব নিয়ে বিভিন্ন দপ্তর ও প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতার কারণে ভিন্ন সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে বলে অনেকে মনে করছেন।
বুধবার (২৩ জুলাই) সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে দেওয়া তালিকার তথ্যমতে, এ ঘটনায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৮ জন আহত আর প্রাণ হারিয়েছেন ২৯ জন। অন্যদিকে মঙ্গলবার (২২ জুলাই) বেলা ২টায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৩১ ও আহত হয়েছেন ১৬৫ জন।
অপরদিকে মাইলস্টোন কলেজ থেকে ভিন্ন ধরনের তথ্য দেওয়া হয়েছে। আবার স্বজন ও শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ধরনরে সংখ্যা জানাচ্ছেন। প্রথম দিন থেকেই এভাবে হতাহতের সংখ্যা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা রয়েছে। ফেসবুকে অনেকে এ সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
দুর্ঘটনায় হতাহতের প্রকৃত নাম ও নির্ভুল তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিপূরণসহ ছয় দাবিতে মঙ্গলবার দিনভর স্কুল ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তারাও হতাহতের সরকারি সংখ্যা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে। যদিও অধিকাংশ সূত্র বলছে, এ ঘটনার হতাহতের সংখ্যা দুইশ’র আশপাশে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সংখ্যার হিসাবে গরমিল নিয়ে নানা ধরনের ব্যাখ্যাও আছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও নিহত ব্যক্তিদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনায় ১৬৪ জন আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং ৩২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) তথ্যানুযায়ী, নিহত ৯ জনের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আর নিখোঁজ রয়েছেন ৫ জন।
গত ২১ জুলাই বেলা ১টা ১২ মিনিটে দিয়াবাড়ির স্থায়ী ক্যাম্পাসের বিদ্যালয় ভবনে আকস্মিকভাবে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়। ঘটনাস্থলে অনেক ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক-কর্মচারী, অভিভাবক আহত ও নিহত হন।
বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ও নিহত ব্যক্তিদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিমান দুর্ঘটনায় ১৬৪ জন আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এবং ৩২ জন মৃত্যুবরণ করেছেন। ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) তথ্যানুযায়ী, নিহত ৯ জনের মরদেহ এখনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। আর নিখোঁজ রয়েছেন ৫ জন।
নিহত ও আহতদের স্বজনরা বলছেন, নিহত, নিখোঁজ ও অশনাক্তের সংখ্যা অনেক বেশি। তাদের মতে, এ ঘটনায় নিহতের সংখ্যা শতাধিক। আর নিখোঁজ ৬০ থেকে ৭০ জন।
সিএমএইচে অজ্ঞাতনামা লাশ নিয়ে কাজ করছেন পরিদর্শক মামুনুর রশিদ। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এ পর্যন্ত অতিমাত্রায় পুড়ে যাওয়া ৯টি অজ্ঞাতনামা মরদেহ শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া নিখোঁজ রয়েছেন ৫ জন। আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে খুব দ্রুত কাজ করছি। আশা করছি, রিপোর্ট ৩-৪ দিনের মধ্যেই চলে আসবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকে বলছেন, নিখোঁজের সংখ্যা আরও বেশি। যদি তাই হয়, তাহলে স্বজনরা আমাদের হেল্প ডেস্কে এসে তথ্য দিতে পারতেন, কিন্তু তারা তা করেননি। বাইরে অনেক কিছুই শোনা যায়, তবে আমাদের কাজ করার জন্য যথাযথ কাগজপত্র ও প্রমাণ প্রয়োজন।’
.jpg)
জানতে চাইলে মাইলস্টোন স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল মোহাম্মদ মাসুদ আলম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিধ্বস্ত ভবনে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ৭৮৩ শিক্ষার্থী ক্লাস করে। ছুটি হয়ে যাওয়ার পর অপেক্ষমাণ ছিল কিছু শিক্ষার্থী। তিনি আরও জানান, ছুটির পর অপেক্ষমাণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১০০ থেকে ১৫০ জনের মধ্যে ছিল।
ভবনটিতে সাধারণত ১২ জন শ্রেণিশিক্ষক, দু’জন ক্লাস কো-অর্ডিনেটর এবং সাপোর্টিং স্টাফ থাকেন বলে জানতে পেরেছে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাস কো-অর্ডিনেটর লুৎফুন্নেসা লোপা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ওই দিনের উপস্থিতির (অ্যাটেনডেন্স) তথ্য এ মুহূর্তে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ, ওই দুটি কক্ষ এমনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যে, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি তালিকা, বোর্ডসহ অন্যান্য কাগজপত্রের কিছুই অবশিষ্ট নেই ‘
তিনি বলেন, ‘ওই দুটি কক্ষে শেষ মুহূর্তে কতজন শিক্ষার্থী ছিল, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত। একটি কক্ষে আট জন ও অন্যটিতে চারজন ছিল। মোট ১২ জন শিক্ষার্থী ওই দুটি কক্ষে ছিল, যারা মূলত বেলা ১টা থেকে ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করছিল।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা প্রতিটি শিশুর অভিভাবকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। এ পর্যন্ত আমাদের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই অভিভাবক ও তিন শিশু নিখোঁজ রয়েছেন। নিখোঁজ ও নিহত মিলিয়ে আমাদের তথ্য অনুসারে এ সংখ্যা এখনো ৩০ হয়নি।’
লুৎফুন্নেসা লোপা বলেন, ‘সরকার যে নিহতের সংখ্যা প্রকাশ করেছে, আমাদের হিসাব অনুযায়ী তা আরও কম হতে পারে। কারণ আমরা যে তালিকা পেয়েছি, তা নিশ্চিত এবং যাচাই করা।’
এদিকে, জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে (বার্ন ইউনিট) ভর্তি থেকে মঙ্গলবার রাতে মারা যাওয়া আবদুল্লাহ শামীমের বোন ফারজানা কনিকা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যখন দুর্ঘটনা ঘটে, তখন আমার ভাই ভেতরেই ছিল। সবাই যেভাবে পারছে বের হয়ে গেছে, আমার ভাইও এক পর্যায়ে বের হয়।’
আরও পড়ুন: ভাই-বোনের খুনসুটির ইতি, চিরনিদ্রায় পাশাপাশি তারা
আবদুল্লাহ শামীমের ভাই জাহিদুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মৃতের সংখ্যা ১০০-এর বেশি হতে পারে। কারণ ঘটনাস্থলেই অনেকেই মারা গেছেন (অন-স্পট ডেথ হয়েছে)। এ ছাড়া এখনো অনেকেই নিখোঁজ রয়েছে, যার সংখ্যা প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জনের মতো হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সেখানে একটি স্কাই সেকশন ছিল, যেখানে কেউ বাঁচেনি। ওই ধরনের একটি সেকশনে সাধারণত ১-২ জন নয়, বরং ৩০ থেকে ৩৫ জন থাকে। আমিও মাইলস্টোনের শিক্ষার্থী ছিলাম। একটি ভিডিওতে দেখেছি, ওই জায়গায় সবাই স্পট ডেড হয়ে গেছে—সরাসরি যেখানে বিমানটি হিট করেছে।’
বিমান দুর্ঘটনার পর আগুনে পোড়া অবস্থায় ৬১ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় জানিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মাসুদ রানা দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এর মধ্যে ৫৭ জন জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে এবং চারজন জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (ঢামেক) ভর্তি হয়। তাদের মধ্যে বার্ন ইউনিটে ১০ জন এবং ঢামেকে ১ জন রোগী মারা যান। বর্তমানে বার্ন ইউনিটে ৪৭ জন ও ঢামেকে তিন রোগী ভর্তি আছেন।
ব্লাড নিয়ে কাজ করা সংগঠন সন্ধানী সূত্রে জানা যায়, যেসব হাসপাতালে আগুনে পোড়া রোগী ভর্তি হয়েছেন, সেগুলো হলো জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ৪৭, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিন, সিএমএইচে ২১, কুয়েত বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে এক, শহীদ মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এক ও উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল একজন।
সংখ্যার গরমিল নিয়ে জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র জনসংযোগ কর্মকর্তা শাহাদাত হোসাইন বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, নানা ধরনের তথ্য পাওয়া গেলেও আমরা নিশ্চিত হয়েই তথ্যগুলো জানাচ্ছি। এখানে ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। অন্যদের তালিকার বিষয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।