এত ভয়ংকর ডেঙ্গু!

ডেঙ্গু
ডেঙ্গু  © সংগৃহীত

হঠাৎ করেই ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ বেড়ে গেছে। প্রতিদিনই শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যাও। ডেঙ্গু জ্বর মূলত এডিস এজিপ্টি (Aedes aegypti) মশার কামড়ে হয়। তবে সব মশার কামড়ে এ জ্বর হয় না। এই মশা তখনই ক্ষতিকর হবে যখন এই মশা ডেঙ্গু জ্বরে সংক্রমিত কোনো ব্যক্তিকে কামড় দেবে। ডেঙ্গু জ্বরের ভাইরাস তখন এই মশা বহন করবে এবং এই মশা যখন কোনো সুস্থ মানুষকে কামড় দেবে তখন ওই ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারেন।

ঢাকা শহরে ডেঙ্গুর প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত এবং হাসপাতালে ভর্তির পেছনে অন্যতম কারণ হলো আবহাওয়ার তারতম্য, সেই সাথে মুষলধারে বৃষ্টি, অপরিকল্পিত নগরায়ন, মশার বংশবিস্তার রোধের সঠিক ব্যবস্থা না নেয়া এবং সর্বোপরি সচেতনতার অভাব। সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এডিস মশার বিস্তার বেশি ঘটে। মানুষ থেকে মানুষে বা এক ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তিতে ডেঙ্গু ছড়ায় না। তবে ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিদের মশা এড়িয়ে চলা উচিত।

সাধারণত ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরের তাপমাত্রা অনেক বেড়ে যায়। শরীরে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা ছাড়াও আরও কিছু উপসর্গ দেখা যায়। যেমন, অত্যধিক অ্যাবডোমিনাল ব্যথা হয়। শ্বাস-প্রশ্বাস বেড়ে যায়। বমি বমি ভাব হয়। শরীরে অনেক সময় পানি জমে। প্লাটিলেট সংখ্যা কমতে থাকে।

কী করে বুঝবেন আপনার ডেঙ্গু হয়েছে
ডেঙ্গু আসলে একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যেটা এডিস মশার মাধ্যমে আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য ব্যক্তির শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। সাধারণতো ৪-১০ দিনের মধ্যে ডেঙ্গুর উপসর্গ বোঝা যায়। যার কারণে জটিলতাও বেশি হয়ে থাকে এবং রক্তের প্লাটিলেট কমে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়, বুকে পেটে পানি আসে, যকৃত আক্রান্ত হওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়।

ডেঙ্গু সাধারণত দুই ধরনের-ক্লাসিক্যাল এবং হেমোরেজিক তবে বেশি তীব্র হলে সেটাকে ‘ডেঙ্গু শক সিনড্রোম’ বলে। সাধারণতো ডেঙ্গু হলে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলো দেখা দেয়:

* ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণতো প্রচণ্ড জ্বর এবং সেই সাথে শরীর ব্যথা থাকে
* তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠতে পারে। সেই সাথে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে দিয়ে আবার জ্বর আসতে পারে
* মাথা ব্যথা, চোখের পেছনে ব্যথা হয়
* জ্বর হওয়ার ৪-৫ দিন পর শরীরে লালচে র‍্যাশ দেখা যায়
* বার বার গলা শুকিয়ে যাওয়া এবং অত্যাধিক পানি পিপাসা
* খাবারে অরুচি এবং এর সাথে বমি বমি ভাব, পাতলা পায়খানা, পেটে ব্যথা, মাঝে মাঝে খিচুনিও হতে পারে
* অতিরিক্ত ক্লান্তিবোধ এর মাঝে মাঝে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। 
* পানি আসার কারণে অনেক সময় পেট ফুলে যেতে পারে।

ডেঙ্গু জ্বর সৃষ্টিকারী এডিস মশা সম্পর্কে এই তথ্যগুলো জেনে রাখুন

ডেঙ্গু জ্বর হলে কী করবেন
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে রোগী সাধারণতো ৫-১০ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যায়। তবে রোগী যাতে ডেঙ্গুজনিত কোনো মারাত্মক জটিলতায় না ভোগে সেজন্য অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খাওয়াতে হবে এবং প্রয়োজন হলে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে। এক্ষেত্রে যে নিয়মগুলো মেনে চলা আবশ্যক।

* ডেঙ্গু ধরা পড়লে ভয় বা টেনশনের কিছু নেই। তবে কোনো ধরনের চিকিৎসা না করালে অনেক সময় ডেঙ্গু প্রাণঘাতী হতে পারে। এর চিকিৎসার ক্ষেত্রে ন্যাশনাল প্রটোকল বা গাইডলাইন রয়েছে।
* যাঁদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা ভালো, যাঁদের অন্য কোনো জটিল রোগ নেই—তাঁরা সাধারণত বিশ্রাম নিলে, ঠিকমতো পানি পান করলে, প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ছাড়া আর কোনো ওষুধ সেবন না করলে তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই ভালো হয়ে যান। 
* পর্যাপ্ত তরল খাবার যেমন- ডাবের পানি, খাবার স্যালাইন, গ্লুকোজের শরবত, জুস, সুপ এবং প্রচুর পানি পান করতে হবে।
* এই সময় কোনো ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক, স্টেরয়েড বা ব্যথানাশক ওষুধও ব্যবহার করা যাবে না। বমি করলে আইভি ফ্লুইড দিতে হবে চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে।
* জ্বর কমানোর জন্য ভেজা কাপড় দিয়ে শরীর বার বার মুছে দিতে হবে
* লক্ষণ তীব্র হলে যেমন- পেট ব্যথা, বমি করা, গায়ে লালচে দাগ, পায়খানা প্রসাবের সাথে বা শরীরের কোনো অংশ থেকে রক্তক্ষরণ, ক্ষুধামন্দা এসব লক্ষণ দেখা দিলে অবশ্যই রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
* ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তিকে জীবাণুবাহী এডিস মশা কামড় দিয়ে অন্য একজন সুস্থ মানুষকে কামড়ালে তাঁরও ডেঙ্গু হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ জন্য ডেঙ্গুতে কেউ আক্রান্ত হলে ৯-১০ দিন পর্যন্ত মশারি টানিয়ে তাঁকে আলাদা করে রাখুন।

আরও পড়ুন: কৃত্রিম মিষ্টি ক্যান্সারের কারণ, কোকসহ বিভিন্ন খাদ্যপণ্য চিহ্নিত করলো ডব্লিউএইচও

কখন হাসপাতালে?
* কারো শুধু জ্বর আছে, পাতলা পায়খানা নেই, বমি নেই, মুখে খেতে পারছে—এ রকম হলে হাসপাতালে ভর্তি না হলেও চলবে। বাসায় রেখেই তখন তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব।
* জ্বরের সঙ্গে পাতলা পায়খানা, পেট ব্যথা, বমি হলে, অর্থাৎ বিভিন্ন ওয়ার্নিং সাইন দেখা দিলে হাসপাতালে ভর্তি করাই শ্রেয়।
* শিশু, গর্ভবতী, বয়স্ক ব্যক্তি, কিডনি, হৃদরোগীদের ডেঙ্গু শনাক্ত হলে তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা দেওয়া উচিত।
* কারো কো-ইনফেকশন অর্থাৎ ডেঙ্গু ও টাইফয়েড একই সঙ্গে হয়েছে এমনটি হলে টাইফয়েডের চিকিৎসা করা যাবে। গুরুত্ব দিতে হবে প্রচুর তরল যেন দেহে ঢোকে সে বিষয়টির দিকে। এ জন্য বেশি করে পানি, ডাবের পানি, শরবত, গ্লুকোজ, স্যালাইন, স্যুপজাতীয় তরল ইত্যাদি খাওয়াতে হবে। রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে।
* গর্ভবতী নারী, হার্টের রোগী, এনকেফালাইটিস ইত্যাদি রোগীর ক্ষেত্রে সমন্বিত চিকিৎসার দরকার হয়

ডেঙ্গু প্রতিরোধ আপনার করণীয়- 
* বর্ষায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি থাকে এবং ডেঙ্গু রোধের মূলমন্ত্র হলো এডিস মশার বংশবিস্তার রোধ করা তাই বাড়ির আশপাশে জমে থাকা বৃষ্টির পানি, ফুলের টব, জঙ্গল, বদ্ধ জলাশয়, আগাছা পরিষ্কার করতে হবে যাতে এডিস মশা বংশবিস্তার করতে না পারে। 
* ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীকে অবশ্যই সারাক্ষণ মশারির মধ্যে রাখতে হবে
* দিনের বেলায় মশারি টানিয়ে, মশার কয়েল অথবা মশার নিধন স্প্রে ব্যবহার করতে হবে 
* অব্যবহৃত কৌটা, ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত টায়ার সরিয়ে ফেলতে হবে
* ফ্রিজ ও এসির পানি যাতে জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে
* শিশুদের ফুল হাতা জামা পরাতে হবে।
 
প্লাটিলেট কাঊন্ট নিয়ে উদ্বিগ্নতা
* ডেঙ্গু জ্বরে প্লাটিলেট কমে যাওয়া এটা স্বাভাবিক বিষয় তাই এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার কিছুই নেই। মানুষের দেহে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকার স্বাভাবিক মাত্রা হলো দেড় লাখ থেকে চার লাখ। রক্তক্ষরণ বন্ধে এর বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। ডেঙ্গুতে বেশির ভাগ রোগীর প্লাটিলেট কমে যায়, তবে সবার নয়। আবার প্লাটিলেট কমে গেলেই প্লাটিলেট দিতে হবে—এমন ধারণাও সঠিক নয়। তবে চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনবোধে ফ্রেশ রক্ত অথবা প্লাটিলেট দেয়া যেতে পারে।

* ডেঙ্গু বা অন্য কোনো ভাইরাস ইনফেকশনে প্লাটিলেটের সংখ্যা কমে গেলেও শরীর থেকে আপনা-আপনি প্লাটিলেট তৈরি হয়। প্রথম কয়েক দিন কম প্লাটিলেট নিয়েও রোগী যদি টিকে থাকেন, পরবর্তী সময়ে দেহ থেকেই আপনা-আপনি প্লাটিলেট তৈরি হয় এবং ঘাটতি পূরণ হয়ে রোগী সুস্থ হয়ে যান।
* যদি কারো প্লাটিলেট ৫০ হাজারের মধ্যে থাকে, তাহলে টেনশনের কোনো কারণ নেই। তবে ৫০ হাজারের নিচে প্লাটিলেট নেমে গেলে তখন হাসপাতালে ভর্তি করা যেতে পারে। প্লাটিলেট ২০ হাজারে নেমে এলেও কিন্তু রক্তক্ষরণ হয় না। ১০ হাজারের নিচে নেমে গেলে প্রয়োজনে প্লাটিলেট দেওয়া যায়।

যখন জটিলতা বাড়ে
* বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সংজ্ঞা অনুযায়ী, জ্বরের সঙ্গে প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম এবং রক্তে হেমাটোক্রিট (রক্তের পরিমাণের সঙ্গে লোহিত কণিকার পরিমাণের অনুপাত) ২০ শতাংশ কমবেশি হলে সেটা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। এর সঙ্গে রক্তবমি, রক্তনালি লিকের (প্লাজমা লিকেজ) উপসর্গ যেমন প্রোটিন কমা, পেটে বা ফুসফুসে পানি জমার মতো উপসর্গ থাকতে পারে।
* ডেঙ্গু থেকে মারাত্মক সমস্যা হলো প্লাজমা লিকেজ, ডিআইসি, মায়োকার্ডিটিস, রক্তপাত, তরল জমে যাওয়া, শ্বাসকষ্ট, কোনো অঙ্গের কার্যকারিতা নষ্ট হওয়া ইত্যাদি।
* ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি আলাদা সেরোটাইপ রয়েছে। কেউ একবার একটি সেরোটাইপে আক্রান্ত হলে তার আরো তিনবার ডেঙ্গু হতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে তীব্র ডেঙ্গু বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। তাই বলা হয়, দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হওয়া বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

সেরে ওঠার পর করণীয়
ডেঙ্গুর পর শারীরিক ও মানসিক অবস্থা ফিরে পেতে একটু (মাসখানেক) সময় লাগে। চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই সময়কে Convalescent period বলে। তবে ডায়াবেটিস, কিডনি, শ্বাসরোগ বা অন্য কোনো রোগীর স্বাভাবিক হতে আরো বেশি সময় লাগতে পারে। এই সময় কিছু করণীয় হলো—

* হাসপাতালে ভর্তি অবস্থায় রোগীর যদি কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা জ্বর না থাকে, কিছু ভাইটাল সাইন—বিশেষ করে তাঁর যদি রক্তচাপ ঠিক থাকে, ইউরিন আউটপুট ঠিক থাকে, রোগী যদি মুখে খেতে পারেন তখন হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিতে পারেন।
* ডেঙ্গু হলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কিছুটা হ্রাস পায়। এ জন্য ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পরও দুর্বল, অবসাদগ্রস্ততা, মাথা ঘোরা, চলাফেরায় কিছু ভারসাম্যহীনতা থাকে; গভীর ও নিবিড়ভাবে কাজে মনোনিবেশ করতে পারেন না। এ জন্য কমপক্ষে কয়েক সপ্তাহ বিশ্রামে থেকে এরপর আস্তে আস্তে নিয়মিত কাজে যোগ দিন।
* এই সময় কোনো ধরনের ব্যায়াম করবেন না। যাঁদের জিমে যাওয়ার অভ্যাস আছে, তাঁরা ডেঙ্গু থেকে সেরে ওঠার পর কিছুদিন জিম থেকে দূরে থাকুন। প্রয়োজনে এক বা দুই মাস অপেক্ষা করুন।

ডেঙ্গু মোকাবিলার জন্য জনগণকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে, সেই সাথে এডিস মশা নিধনে এখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। ডেঙ্গুর লক্ষণ থাকলে অবশ্যই পরীক্ষা করাতে হবে এবং ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ খেতে হবে। সর্বোপরি সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা আমাদের নিজেকে এবং আমাদের আশপাশের মানুষকে সুস্থ রাখতে সক্ষম হব।

ডেঙ্গু ভাইরাস মানবদেহে স্থায়ীভাবে থাকে না। শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার মাধ্যমে একসময় ওই ভাইরাস শরীর থেকে পুরোপুরি বের হয়ে যায়। কিন্তু ভাইরাসের জন্য যে অ্যান্টিবডি তৈরি হয় সেটা চিরকাল সুপ্ত অবস্থায় থেকে যায়।


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence