শিক্ষার্থীদের বরণে প্রস্তুতি চলছে স্কুলে স্কুলে, অপেক্ষার প্রহর শেষ হচ্ছে
- আরিফুল ইসলাম তামিম
- প্রকাশ: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ০৯:৫৫ AM , আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১১:২১ AM
করোনায় প্রায় দেড় বছর বন্ধের পর অবশেষে খুলছে স্কুল-কলেজের দুয়ার৷ দীর্ঘ বন্ধ কাটিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সংবাদে শিক্ষার্থীদের মনে এখন বইছে স্বস্তির হাওয়া। স্বস্তি প্রকাশ করেছেন অভিভাবকরাও। একনাগাড়ে দেড় বছর বন্ধে চরম বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে দেশের শিক্ষাখাত। সেইসাথে বেড়েই চলেছে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার আশঙ্কা। বিপর্যয় এড়াতে মাঝে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে ব্যপক আলোচনা-সমালোচনা থাকলেও শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিবেচনায় খোলেনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
শিক্ষাখাত ও শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে দীর্ঘদিন ধরেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানিয়ে আসছিলেন শিক্ষার্থীরাও। তবে এবার সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে খুলছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার খবরে ইতিমধ্যে মুখর হয়ে উঠেছে দেশের শিক্ষাঙ্গন। দীর্ঘছুটি কাটিয়ে ফের নব আঙ্গিকে ক্লাসে ফেরার অপেক্ষায় এখন প্রায় ৪ কোটি শিক্ষার্থী।
এদিকে, সরকার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্মচারী ও পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা প্রতিটি ক্লাসের টেবিলের কোনায় কোনায় পরিষ্কার-পরিছন্নতার কাজে লেগে গেছেন। আর মাত্র চারদিন বাকি, এরইমধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক, কর্মকতা-কর্মচারীদের যেন দম ফেলার সময় নেই। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা দিতে নিচ্ছে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ।
তথ্যমতে, প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকেই খোলার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। শুরুতে এ বছর ও আগামী বছরের এসএসসি-এইচএসসি পরীক্ষার্থীরা এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে ছয় দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আসবে। এ ছাড়া প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সপ্তাহে এক দিন আসবে। তবে শ্রেণিকক্ষে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম আপাতত বন্ধই থাকছে।
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সংবাদ নিঃসন্দেহে সরকারের একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে শিক্ষক, শিক্ষার্থী,অভিভাবকসহ সবাই উদ্বিগ্ন ছিলো। করোনায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে শিক্ষা খাত৷একনাগাড়ে বন্ধের ফলে ব্যপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে যা গণমাধ্যমের খবরেও স্পষ্ট। শিক্ষার্থীদের ঝরে পরা রোধ ও শিক্ষায় গতি ফিরয়ে আনতে দেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সশরীরে ক্লাস-পরীক্ষার বিকল্প নেই।
চট্টগ্রামের কে.বি গ্রামার স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া শিক্ষার্থী ত্রিদিব দাশ অর্জুন বলেন, আমি ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হই। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসের বারো তারিখ থেকে স্কুলে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু কিছুদিন যেতেই শুরু হয় করোনা মহামারি। মাধ্যমিক স্কুল জীবন বুঝে ওঠার আগেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণার পর একপ্রকার গৃহবন্দী হয়ে যাই। দীর্ঘদিন বন্ধে পড়াশোনার প্রতি মনোযোগ হারিয়ে ফেলছিলাম।
“বাইরে করোনা আতংক, ঘরে একঘেয়েমী জীবন ফলে হতাশা ও বিষন্নতায় ভুগেছি। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সংবাদে এখন বেশ উচ্ছ্বসিত লাগছে। দীর্ঘদিন পরে শিক্ষক, বন্ধু-বান্ধব সবার সাথে আবারো প্রাণের মিলনমেলা তৈরি হবে৷”
চট্টগ্রাম রেলওয়ে হাসপাতাল কলোনি সিটি কর্পোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণি পড়ুয়া শিক্ষার্থী সুর্বণা রাণী বলেন, করোনায় দীর্ঘবন্ধে অনলাইনভিত্তিক পড়াশোনা কিংবা ঘরোয়া পরিবেশে পড়াশোনার পূর্ব কোনো অভিজ্ঞতা থাকায় অনলাইন মুখী পাঠদানে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়া ছিলো বেশ কষ্টসাধ্য। যতই বন্ধের দিন দীর্ঘ হচ্ছিলো ততই দমবন্ধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি আমার ক্লাসের সেই পড়াশোনা, আড্ডা এগুলো খুব মিস করি, বন্ধুদের সাথে সময় কাটানো দিনগুলো অন্যরকম। স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়ার সংবাদে এখন বেশ আনন্দ লাগছে। আবার সেই চিরচেনা আঙ্গিনায় ফিরে যাবো।
পাবনা সরকারি মহিলা কলেজ পড়ুয়া এইচএসসি পরীক্ষার্থী তাবাসসুম মেহজাবিন অহনা বলেন, করোনায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে পড়াশোনায় মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটছে। অনলাইন ক্লাসে পাঠদান হলেও সারাক্ষণ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের পর্দায় চোখ রাখতে রাখতে আগ্রহ ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিলো । এছাড়া দীর্ঘক্ষণ ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসের দিকে তাকিয়ে ক্লাস করায় মানসিক অবসাদ চলে আসে। শুধু তাই নয়, স্কুল-কলেজ বন্ধে সারাক্ষণ ঘরে থাকা একটা বন্দি জীবনের মতো হয়ে গেছে।
“দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা পেয়ে ভালো লাগছে। ফের সুন্দর একটা পরিবেশে ফিরে যেতে পারবো। তবে আমাদের অবশ্যই স্বাস্থ্যবিধি মেনে জীবনযাপন করা উচিত।কারণ, আগামী দিনের করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাঙ্গনের হালচাল কি হবে তা পুরোপুরি আমাদের উপরই নির্ভর করছে।”
পাবনা পি.ডি.বি মাধ্যমিক স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থী মো.মারুফুল ইসলাম বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সংবাদ নিঃসন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক ও স্বস্তির বার্তা ।দীর্ঘদিন বন্ধে শিক্ষাঙ্গণ ইতিমধ্যে বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন। আশার কথা,১২ই সেপ্টেম্বর থেকে স্বল্প পরিসরে হলেও ধাপে ধাপে ক্লাস, পরীক্ষা শুরু হবে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত আরো আগেই নেওয়া উচিত ছিলো।
চট্টগ্রাম সরকারী মডেল কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম বলেন, বিগত দেড় বছর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে পাঠদানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের খুব একটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হয়না৷কারণ শিক্ষাক্ষেত্রে শ্রেনীকক্ষে পাঠদান, পরীক্ষা দেয়া, সশরীরে উপস্থিতি- শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীর সহজাত প্রবৃত্তি। অনলাইনে পাঠদানে শিক্ষকরাও অনভিজ্ঞ। দেশের অনেক প্রত্যন্ত এলাকায় অনলাইন শিক্ষা এখনো খুব একটা সহজ হয়নি। তাই এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত।তবে করোনা এখনো চলে যায়নি। এখনো সব শিক্ষার্থী ভ্যাকসিনের আওতায় আসেনি। এমতাবস্থায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার মতো ঝুঁকি নিয়ে একটি বড়সড় পরীক্ষার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। আমাদের সকলের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থা সেভ দ্য চিলড্রেনের একটি গবেষণা বলছে, কোভিড-১৯, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন, আন্তঃসম্প্রদায় সহিংসতাসহ নানা সমস্যায় ‘শিক্ষার্থীদের একটি হারিয়ে যাওয়া প্রজন্ম’ তৈরি হওয়ার আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশসহ আরও ৪০টি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড.আনোয়ারা আলম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, প্রায় দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ফলে ইতিমধ্যে শিক্ষাখাতে বিরাট ক্ষতি হয়ে গেছে। তবে ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন পর স্কুলে যাবে,বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখা হবে, খেলাধুলা, সামাজিকীকরণ হবে, এতে করে শিক্ষার্থীদের এতদিন চার দেয়ালে বন্দি থেকে যে মানসিক যন্ত্রণা, চাপ, হতাশা বেড়েছে তা অনেকটাই কমে আসবে। এছাড়া যেসকল শিক্ষার্থী এতদিন অনলাইন ক্লাসের সাথে সংযুক্ত হতে পারেনি তারা বেশিরভাগই ঝড়ে পড়ার পরিক্রমায়, সেক্ষেত্রে সেসকল শিক্ষার্থী কিছুটা হলেও শিক্ষার আওতায় ফিরে আসবে।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত একদিকে যেমন ইতিবাচক অন্যদিকে শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ভ্যাকসিন ছাড়াই স্কুল-কলেজে যাবে শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে সংশয়ে অনেক অভিভাবকই হয়তো সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেনা। এছাড়া আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি বজায় রেখে ক্লাস করা প্রায় অসম্ভব কঠিন।
“করোনার আগেও আমাদের দেশের অধিকাংশ প্রাথমিক বিদ্যালয়, প্রত্যন্ত এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে বেশিরভাগ বিদ্যালয়েই দুর্বল স্যানিটেশন ব্যবস্থা দেখা গেছে, এছাড়া সুপেয় পানির অভাব, অবকাঠামো গত সমস্যা জর্জরিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব নেই। সেক্ষেত্রে করোনাকালে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষার যথাযথ পরিবেশ তৈরি করে পাঠদান কর্মসূচি পালনে বিরাট চ্যালেঞ্জ থেকেই যাচ্ছে।”