পরামর্শের তোয়াক্কা না করে আমূল পরিবর্তনই শিক্ষাক্রমের কাল
- রুম্মান তূর্য
- প্রকাশ: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:২৮ AM , আপডেট: ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:১১ PM
নতুন শিক্ষাক্রমে রাতারাতি বদলে ফেলা হয়েছিল শিখন-শেখানোর প্রচলিত পন্থা। ব্রিটিশ শাসনামল থেকে চলে আসা পরীক্ষা নির্ভর মূল্যায়ন পদ্ধতি থেকে হুট করে অভিজ্ঞতা নির্ভর মূল্যায়ন শুরু হয়েছিল। গঠনমূলক সমলোচনা বা পরামর্শও গ্রহণ করা হয়নি। এ বিষয়গুলো নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য কাল হয়ে এসেছে বলে মনে করছেন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের।
দায়িত্ব নেয়ার ২৩ দিনের মাথায় অভিভাবক মহলে তুমুল সমালোচিত নতুন শিক্ষাক্রম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। শিক্ষকদের প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়, মূল্যায়ন নিয়ে অস্পষ্টতা, প্রতিষ্ঠানিক সক্ষমতার অভাব ইত্যাদিকে দায় দিয়ে এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একযুগ আগে ২০১২ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমকে ‘ব্যাকডেটেড’ আখ্যা দিয়ে নতুন এ শিক্ষাক্রম বিস্তরণ শুরু হয়েছিল।
পরীক্ষা নির্ভর ওই শিক্ষাক্রম থেকে আধুনিক ও যুগোপযোগী শিক্ষার স্বপ্ন দেখিয়ে তৎকালীন সরকার এ শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন শুরু করেছিল। নতুন শিক্ষাক্রমে শিখন শেখানোর পন্থা, মূল্যায়ন ব্যবস্থাসহ শিক্ষা প্রচলিত পদ্ধতিই বদলে ফেলা হয়েছিল। সাধারণ ধারার স্কুল, মাদরাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দেড় কোটির বেশি শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবনের এ পরিবর্তন অভিভাবকরা মেনে নিতে পারেননি। নতুন এ শিক্ষাক্রমকে শুরু থেকেই ভালোভাবে নেয়নি অভিভাবক মহল।
শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’ নামের একটি সংগঠনের ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনের মত কর্মসূচি পালন করছেন একদল অভিভাবক। গত বছরের নভেম্বরে নতুন কারিকুলাম বাতিলের দাবিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির আহ্বায়ক ও লেখক রাখাল রাহা বলেন, নতুন শিক্ষা কারিকুলাম শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের সঙ্গে এক ধরনের প্রতারণা। প্রতিনিয়ত টেক্সট বইয়ের কারিকুলাম নিয়ে এক ধরনের খেলা খেলছে। অথচ শিক্ষার মান কমে যাওয়া নিয়ে সারাদেশে প্রশ্ন হচ্ছে। মানোন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষিত শিক্ষক প্রয়োজন, ক্লাসরুমের মানোন্নয়ন, শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি দরকার। অথচ সরকার সেখান থেকে দূরে থাকছে।
নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতি বন্ধ করায় এর ব্যাপক বিরোধিতা করেছিলেন অভিভাবকরা। তারা বলছিলেন, পরীক্ষা ছাড়া প্রকৃত শিক্ষা হবে না।
শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, শতাব্দীর পর শতাব্দী চলা শিক্ষা ব্যবস্থায় হুট করে আমূল পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারেনি জাতি। সংশ্লিষ্ট কারো কারো দাবি, পরামর্শ দেয়া হলেও তা শুনেননি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গঠনমূলক সমালোচনার চেয়ে তোষামদীকে প্রাধান্য দিয়েছেন তিনি। পরমর্শ দিয়ে বিপাকেও পড়েছেন কেউ কেউ। সঙ্গে নানা বিতর্ক, অস্পষ্টতা, বিভ্রান্তি ক্ষেত্রবিশেষে ভুল তথ্য ছড়ানোর ফলে অভিভাবক মহলের বিরোধিতা নতুন শিক্ষাক্রমের কাল ডেকে এনেছে। অপচয় হয়েছে জনগণের শত শত কোটি টাকার।
আরও পড়ুন : বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বই পৌঁছানো নিয়ে শঙ্কা
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) তত্ত্বাবধানে এ শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রস্তুত করা হয়। শিক্ষাক্রমের রূপরেখায় এনসিটিবির পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রচলিত শিক্ষার শুধু পরিবর্তন নয়, প্রয়োজন রূপান্তর।
শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হয় ধাপে ধাপে। মাধ্যমিকের কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল। মাধ্যমিকের কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন ওই চ্যালেঞ্জকেও অনেক বড় করে তুলেছিল। -এনসিটিবির বর্তমান চেয়ারম্যান ও তৎকালীন সদস্য অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান
এনসিটিবির বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান নতুন শিক্ষাক্রম রূপরেখা প্রণয়নের সময় এনসিটিবির প্রাথমিক কারিকুলাম উইংয়ের সদস্য ছিলেন। জানতে চাইলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যখন কোন কারিকুলাম পরিবর্তন করা হয়, তখন অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের সঙ্গে সেটি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতেই শিক্ষাক্রম পরিবর্তন নয়, পরিমার্জন করা হয়। এজন্য আগের কারিকুলামগুলোর সঙ্গে পরিমার্জিত শব্দটি আছে। শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হয় ধাপে ধাপে। মাধ্যমিকের কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছিল।
আরও পড়ুন : নতুন বইয়ে বার্ষিক পরীক্ষা পুরনো পদ্ধতিতে!
তিনি আরও বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তনকে সমাজে গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজন দীর্ঘ সময়। শিক্ষাক্রম পরিমার্জন করে ধাপে ধাপে এ রূপান্তর করতে হবে। সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০ শতাংশ নতুনত্বের ছোঁয়ায় শিক্ষাক্রমের পরিমার্জন করা যায়। এর চেয়ে বেশি পরিবর্তন সমানুপাতিক হারে ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জকেও বাড়ায়। তাই মাধ্যমিকের কারিকুলামের আমূল পরিবর্তন ওই চ্যালেঞ্জকেও অনেক বড় করে তুলেছিল।
আরও পড়ুন : মাধ্যমিকের কোটি শিক্ষার্থীর বার্ষিক পরীক্ষা হবে যে নিয়মে
শিক্ষাক্রমের রূপরেখা প্রণয়নে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিক্ষা ও আইন রাতারাতি পরিবর্তন কোন সভ্যতাই গ্রহণ করতে পারে না। এজন্য ব্রিটিশরা চলে গেলেও তাদের আইনকাঠামো আজও দেশে ব্যবহার হচ্ছে। তাদের হাত ধরে আসা শিক্ষা পদ্ধতি স্বাধীনতার পরও অর্ধশতাব্দীচর্চা করা হয়েছে। তাই শিক্ষাক্রমের রূপান্তর সমাজ যে গ্রহণ করবে না-তা অনেক আগেই অনুধাবন করেছিলেন এনসিটিবি সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ। রূপরেখা প্রণয়ণের সময় ও পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট অনেকেই বিষয়টি তৎকালীন মন্ত্রীকে বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন। তবে, বিনিময়ে পেয়েছেন বঞ্চনা আর তিরষ্কার।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে বোর্ডের শীর্ষ কর্তারাও বিপাকে পড়েছেন। অন্যান্যদের সামনেই তাদের শুনতে হয়েছে তিরষ্কার। কেউ কেউ এনসিটিবি থেকে বিতাড়িতও হয়েছেন।
এনসিটিবির কর্মকর্তারা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ দিয়ে বোর্ডের শীর্ষ কর্তারাও বিপাকে পড়েছেন। অন্যান্যদের সামনেই তাদের শুনতে হয়েছে তিরষ্কার। কেউ কেউ এনসিটিবি থেকে বিতাড়িতও হয়েছেন।
সূত্র বলছে, প্রাথমিকের নতুন শিক্ষাক্রমে প্রণয়নে রূপান্তরের রাস্তায় না হেটে পরিমার্জনের পথে ছিল প্রাথমিক শিক্ষাক্রম উইংয়। ফলে প্রাথমিকের নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে সমালোচনাও তুলনামূলক কম। তবে এর জন্য ওই উইংয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসানকে তিরষ্কার শুনতে হয়েছে দফায় দফায়। যার জেরে গত বছর ১০ জুলাই এনসিটিবির সদস্য পদ থেকে প্রেষণ প্রত্যাহার করে তাকে ওএসডি করা হয়। তবে এনসিটিবি সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ শিক্ষামন্ত্রীর তোষামোদী করে বারংবার প্রশংসিত হয়েছেন।
শিক্ষাক্রমের পরিবর্তনের সময় ধাপে ধাপে পরিমার্জনের বিষয়ে বিভিন্ন ফোরামে মন্ত্রী-সচিব সব ফোরামেই পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানান এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম রিয়াজুল হাসান। তাঁর ভাষ্য, সরকারি বিধি-নিষেধের আওতায় থাকায় মিডিয়াতে না বললেও শিক্ষা প্রশাসনের ফোরমগুলোতে বলেছি।
তিনি বলেন, প্রাথমিকের কারিকুলমটা আমরা পরিমার্জন করেছি। তাই সেটি নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হয়নি। তবে পরিবর্তন না করে কেন পরিমার্জন করা হয়েছে সে প্রশ্নও শুনতে হয়েছে। আমি আগের কারিকুলাম চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছি বলে অভিযোগও তোলো হয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের দাবি জানিয়ে গতবছরের শেষ দিকে ৫ জন অভিভাবক গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ‘বিকৃত, বিভ্রান্তকর, উসকানিমূলক তথ্য ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে জনগণের মনে ভীতি সঞ্চারের’ অভিযোগে এনসিটিবির পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করা হয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রম সংশোধনের দাবি জানিয়ে গত বছরের শেষ দিকে ৫ জন অভিভাবক গ্রেফতারও হয়েছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে ‘বিকৃত, বিভ্রান্তিকর, উসকানিমূলক তথ্য ভার্চুয়াল মাধ্যমে ছড়িয়ে জনগণের মনে ভীতি সঞ্চারের’ অভিযোগে এনসিটিবির পক্ষ থেকে তাদের বিরুদ্ধে সাইবার নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা করা হয়েছিল।
নতুন শিক্ষাক্রম প্রণয়নের সময় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ডা. দীপু মনি একাধিক মামলায় গ্রেফতার হয়েছে বেশ কয়েকদিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে আছেন। তাই এসব বিষয়ে তার মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।