বোনাস ছাড়ে দেরি, ৫ লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর ঈদ আনন্দ মাটি
- মুনতাসির রহমান
- প্রকাশ: ১৬ জুন ২০২৪, ০৯:৫৪ PM , আপডেট: ১৬ জুন ২০২৪, ১০:২৩ PM
বগুড়ার ফয়েজুল্বা উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হানিফ (ছদ্মনাম)। মাসিক বেতন ১২ হাজার ৭৫০ টাকা। তা দিয়ে কোরবানি তো দূরের কথা বাড়ি ভাড়া এবং বাজার খরচ মেটানোয় দায়। সন্তানকে এই ঈদে নতুন জামা কিনে দিতে না পারার আক্ষেপে পুড়ছেন তিনি। ঈদ বোনাসের অর্থ ব্যাংক থেকে তুলতে না পারায় এবারের ঈদ ম্লান হয়েছে তার। তার মতোই সারাদেশের এমপিওভুক্ত প্রায় পাঁচ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী ঈদে উৎসব ভাতা বা বোনাসের টাকা তুলতে না পারায় বিপাকে পড়েছেন।
সরকারি, আধা সরকারিসহ সব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বোনাসের অর্থ নিয়ে বাড়ি যেতে পারলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারীদের এবার বোনাস ছাড়াই ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে।
শিক্ষকদের ঈদ বোনাসের চেক দেরিতে ছাড় করায় এই বিড়ম্বনার সৃষ্টি বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা। অভিযোগ করে তারা জানান, ঈদের ছুটি শুরুর দুইদিন আগে বোনাসের চেক ছাড় হয়েছে। সেই অর্থ ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে গত বৃহস্পতিবার (১৩ জুন)। এদিন বিকাল ৩টার পর বোনাসের মেসেজ শিক্ষকদের মুঠোফোনে পাঠানো হয়েছে। সময় সল্পতার কারণে অধিকাংশ শিক্ষক ব্যাংকে গিয়ে টাকা উত্তোলন করতে পারেননি।
এ বিষয়ে আব্দুল্লা নয়ন নামে এক শিক্ষক বলেন, ৩টা ১৭ মিনিটে আমার মুঠোফোনে মেসেজ এসেছে। এলাকায় ব্যাংক সুবিধা নেই। গ্রাম থেকে জেলা শহরে গিয়ে টাকা উত্তোলন করার মতো সময় পাইনি। বোনাসের টাকা ছাড়াই আমাদের ঈদ উদযাপন করতে হচ্ছে শিক্ষকদের প্রতি এমন অবহেলা মোটেও কাম্য নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা সরকারের কাছ থেকে উৎসব ভাতা পেতেন না। ২০০৩ সালের জুলাইয়ে তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ড. এম ওসমান ফারুকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ওই বছরের অক্টোবরে তা কার্যকর হয়। তখন সিদ্ধান্ত হয়, শিক্ষকদের দেওয়া হবে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ। তবে দুই ঈদে (অথবা পূজায়) ২৫ শতাংশ করে ভাগ করে তা দেওয়া হবে। সেই থেকে প্রতি ঈদে শিক্ষকরা ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পাচ্ছেন। আর কর্মচারীদের জন্য ওই সভায় শতভাগ বোনাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দুই ঈদে ৫০ শতাংশ করে তা দেওয়া হচ্ছে। এই অর্থ কখনো কখনো উৎসব শেষ হওয়ার পর হাতে পান তারা।
১৯৯৬ সাল পর্যন্ত এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মূল বেতনের ৮০ শতাংশ দিত সরকার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর তা ৯০ শতাংশে উন্নীত করে। ২০০৫ সালে চারদলীয় জোট সরকার তা শতভাগে উন্নীতের ঘোষণা দিলেও বাজেটে ৯৫ শতাংশ বাস্তবায়ন করে। পরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা শতভাগে নিয়ে যায়।
শিক্ষকদের শতভাগ বেতন সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হলেও আগের সেই নিয়মেই দেওয়া হচ্ছে বোনাস। ঈদুল ফিতরেও ২৫ শতাংশ উৎসব ভাতা পেয়েছেন বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। তবে ঈদুল আযহায় বোনাসের অর্থ ছাড়ের চেক দেরিতে ব্যাংকে পাঠানোয় ঈদের আগে অধিকাংশ শিক্ষক-কর্মচারী টাকা তুলতে পারেননি।
বেসরকারি শিক্ষকদের নানা দাবি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন ইনডেক্সধারী শিক্ষকদের বদলি-গনবিজ্ঞপ্তি প্রত্যাশী ঐক্য পরিষদের সভাপতি ও শিক্ষক নেতা মো. সরোয়ার। তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা বোনাস পান মূল বেতনের ২৫ শতাংশ। সে হিসেবে একজন সহকারী শিক্ষকের ঈদ বোনাস ৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। এই টাকায় কীভাবে ঈদ উদযাপন সম্ভব? একে তো নামমাত্র বোনাস, সেটি পেতেও যদি ঈদ পার হয়ে যায়; তাহলে শিক্ষকরা যাবে কোথায়?
বেসরকারি এমপিওভুক্ত চাকরির মত অভিশপ্ত আর কোন চাকরি নেই জানিয়ে এই শিক্ষক নেতা আরও বলেন, ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেতনে নিজ বাড়ি থেকে শত শত কিলোমিটার দূরের প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে হচ্ছে শিক্ষকদের। অন্যের কাছে হাত পেতে চলতে হয় শিক্ষকদের। শিক্ষকদের বদলি নেই, আরও নানান সমস্যা রয়েছে৷ এর মধ্যে বোনাসের বিড়ম্বনা শিক্ষকদের ঈদের আনন্দ ম্লান করেছে। শিক্ষকদের বোনাসের নামে সিকি পরিমাণ অর্থ দেওয়া। সেটিও যদি ঠিক সময় না দেওয়া হয় তাহলে শিক্ষকদের কষ্টের শেঢ থাকে না। শিক্ষকদের বোনাস নিয়ে এমন টাল বাহানা বন্ধের দাবি জানাচ্ছি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) পরিচালক (মাধ্যমিক) সৈয়দ জাফর দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শিক্ষকদের ঈদের আগে বোনাসের অর্থ না পাওয়ার বিষটি অমানবিক। কী কারণে শিক্ষকরা ঈদের আগে বোনাসের অর্থ তুলতে পারেনি তা খতিয়ে দেখা দরকার।
জানা গেছে, এবার ৩০ হাজারের বেশি এমপিওভুক্ত বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীকে ২৪০ কোটি টাকা উৎসব ভাতা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে মে মাসের বেতন হিসাবে তারা পাবেন ৭৮৩ কোটি ৫১ লাখ ৪ হাজার ৭৫০ টাকা। বেতনের অর্থ শিক্ষকরা তুলতে পারলেও বোনাসের অর্থ হাতে পাবেন ঈদের পর।
মূল বেতনের ২৫ শতাংশ বোনাস পাওয়া শিক্ষকদের মধ্যে কলেজের অধ্যক্ষদের বেতন স্কেল ৫০ হাজার টাকা, উপাধ্যক্ষ ও উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের অধ্যক্ষদের ৪৩ হাজার টাকা, সহকারী অধ্যাপকের ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা, টাইম স্কেলপ্রাপ্ত প্রভাষক ও স্কুলের প্রধান শিক্ষকের ২৯ হাজার টাকা, সহকারী প্রধান শিক্ষক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকদের ২৩ হাজার টাকা, প্রভাষক/গ্রন্থাগারিক, সহকারী শিক্ষকদের (টাইম স্কেলপ্রাপ্ত) ২২ হাজার টাকা, প্রদর্শক/সহকারী গ্রন্থাগারিক/শরীরচর্চা শিক্ষক/সহকারী শিক্ষকদের (টাইম স্কেল ব্যতীত) ১৬ হাজার টাকা এবং সহকারী শিক্ষকদের (বিএড ব্যতীত) ১২ হাজার ৫০০ টাকা।