অঙ্কুরিত আলু, পেঁয়াজ ও রসুন খাওয়া কি ঠিক?
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১১ জুন ২০২৫, ১২:৪৫ PM , আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০৯:৫৮ PM
রান্নাঘরে খাবার তৈরির সময় হয়তো আপনি গিয়ে দেখলেন আলু অঙ্কুরিত হয়ে গেছে। তখন কী করবেন? সন্দেহ হতে পারে এই আলু কি খাওয়ার যোগ্য কি না, নাকি না ভেবেই সোজা ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দেবেন?
শুধু আলু নয়, পেঁয়াজ ও রসুনের মতো অঙ্কুরোদগম শুরু করা সবজির কথাও যখন আসে, তখন উত্তরটি সব সময় সহজ ও সোজা হয় না।
এগুলো নিয়ে আসলে কী করা উচিত এর উত্তর যদি মিশ্র হয়, তাহলে সিদ্ধান্ত নেওয়া আরও জটিল হয়ে ওঠে।
আলু অঙ্কুরিত হলে কী ঘটে?
অন্য যেকোনো মূলের মতো একটি আলু থেকেও নতুন উদ্ভিদ জন্মানোর প্রচেষ্টাই অঙ্কুরোদগমের স্বাভাবিক লক্ষণ। এ প্রক্রিয়া চলাকালে আলুতে বিষাক্ত গ্লাইকোঅ্যালকালয়েড জন্মাতে শুরু করে। প্রাকৃতিক এই বিষাক্ত উপাদান উদ্ভিদকে ছত্রাক ও পোকামাকড় থেকে রক্ষা করে।
এ রকম যৌগগুলোর মধ্যে একটি হলো সোলানাইন, যে বিষাক্ত উপাদানটি প্রায় বেশির ভাগ উদ্ভিদ যেমন আলু, টমেটো, বেগুন ও মরিচের মতো উদ্ভিদেও পাওয়া যায়। ফসল কেটে সংরক্ষণ করলে এই যৌগগুলোর ঘনত্ব বাড়িয়ে তুলতে পারে। তাই মানুষ ও প্রাণী উভয়ের জন্যই অঙ্কুরিত বা এই অবস্থায় দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা আলু ঝুঁকিপূর্ণ।
অঙ্কুরিত এই সবজি কি খাওয়া যাবে?
‘পটেটোস পোস্টহারভেস্ট’ বইয়ের লেখক এবং ইউনিভার্সিটি অব লিংকনের পোস্টহারভেস্ট প্রযুক্তির শিক্ষক ও গবেষক ড. ক্রিস বিশপ বলেন, ‘অঙ্কুরিত আলুর সবচেয়ে বড় বিপদ হলো এতে থাকা গ্লাইকোঅ্যালকালয়েড। এটি আলুকে তিক্ত স্বাদের করে তোলে এবং আরও গুরুতর কিছু হওয়ার চেয়ে বরং বেশির ভাগ সময়ই বমির কারণ হতে পারে।’
আরও পড়ুন: জবির সব ইউনিটে কোটার সাক্ষাৎকারের তারিখ ঘোষণা
ড. বিশপ বিবিসিকে বলেন, ‘আলুতে এই প্রাকৃতিক রাসায়নিকটি থাকা খুব স্বাভাবিক, বিশেষ করে সবুজ রঙের আলুতে। আর এই কারণেই আমাদের সবুজ আলু খাওয়া উচিত নয়। অঙ্কুরিত আলুতে এই রাসায়নিক উচ্চমাত্রায় থাকতে পারে, তাই এগুলো পুরোপুরি ফেলে দেওয়া উচিত। যদি কোনো সন্দেহ থাকে তবে আলুতে যে স্থানে অঙ্কুরোদগম হয়েছে সে স্থান থেকে মূল শেকড় উপড়ে ফেলতে হবে। আমার মতে আলুর বাকি অংশটুকু খাওয়ার যোগ্য।’
যুক্তরাজ্যের ফুড স্ট্যান্ডার্ডস এজেন্সির (এফএসএ) মতে, কিছু বিষয় মাথায় রেখে অঙ্কুরিত আলু খাওয়া যেতে পারে।
এফএসএ পরামর্শ দিয়েছে, অঙ্কুরিত স্থান ফেলে দেওয়ার পর যদি আলুতে পচনের লক্ষণ না থাকে, শক্ত থাকে তবে তা খাওয়া নিরাপদ। তবে যদি কোনো আলুতে সবুজ বর্ণ দেখা যায় তবে তা ফেলে দেওয়াই ভালো। কারণ সবুজ অংশগুলো বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতি নির্দেশ করে।
সংস্থাটি বলছে, অঙ্কুরিত আলু খাওয়া নিরাপদ হতে পারে যদি আলু ধরার পর তা শক্ত বোঝা যায়, শুকিয়ে না যায় বা কুঁচকে না যায়। অথবা অঙ্কুরোদের স্থানটা যদি ছোট হয় তবেই তা খাওয়া যেতে পারে। তবে যদি আলু খুব নরম বা খুব শুষ্ক হয় বা কুঁচকে যায় তাহলে এটি তার পুষ্টিগুণ হারিয়ে ফেলবে এবং স্বাদও ভালো হবে না বলে জানাচ্ছে সংস্থাটি।
সোলানাইন বিষাক্ততা কী?
কয়েকজন বিশেষজ্ঞ অবশ্য এ বিষয়ে আরও সতর্কতা অবলম্বনের কথা বলেন। ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যাথি মার্টিন সতর্ক করে বলেন, ‘আপনার অঙ্কুরিত সবুজ আলু একেবারেই খাওয়া উচিত নয়।’
তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, আলোর সংস্পর্শে (যেটা আলুতে অঙ্কুরোদগম বৃদ্ধি করে) স্টেরয়েডাল গ্লাইকোঅ্যালকালয়েড, সোলানিন বৃদ্ধি করে যা মানুষ এবং প্রাণীদের জন্য বিশেষ করে বিড়াল এবং কুকুরের জন্য মারাত্মক হতে পারে।
প্রফেসর মার্টিন আরও জানান, সবুজ নয় এমন আলুতে সোলানাইনের মাত্রা কম থাকে। সোলানাইনের বিষক্রিয়ার ঝুঁকির কারণে কাঁচা আলু খাওয়া একেবারেই কারো উচিত নয়।
আরও পড়ুন: জুলাই শহীদদের বাড়িতে ফল দিয়ে ফেরার পথে বৈষম্যবিরোধী নেতাদের ওপর হামলা
এ ধরনের ঘটনা বিরল হলেও সোলানাইনে বিষক্রিয়ার কিছু ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। যেটি সবচেয়ে পরিচিত ঘটনা সেটি ১৯৭০ সালের শেষের দিকের যুক্তরাজ্যের, সেসময় সবুজ আলু খাওয়ার পর ৭৮ জন স্কুল শিক্ষার্থীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল। তবে খুব নগণ্য পরিমাণে আলু খেলে কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম।
সোলানাইনে বিষক্রিয়ার হালকা লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে ডায়রিয়া, বমি ও তীব্র পেটে ব্যথা। এই বিষক্রিয়ার গুরুতর লক্ষণগুলোর মধ্যে ঝিম ঝিম ভাব, অনীহা, বিভ্রান্তি, দুর্বলতা এবং দৃষ্টির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমন গুরুতর কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি অজ্ঞান হয়ে যাওয়া এবং মারা যাওয়ার নজিরও রয়েছে। বিষাক্ত আলু খাওয়ার পর লক্ষণগুলো কয়েক মিনিট বা দুই দিনের মধ্যে দেখা দিতে পারে।
কীভাবে অঙ্কুরিত আলু খাবেন?
>> যদি অঙ্কুর ছোট হয় তবে খাওয়ার আগে তা কেটে নিন।
>> অঙ্কুর যদি দীর্ঘ, অর্থাৎ এক ইঞ্চির বেশি হয় অথবা আলু নরম হয় তাহলে তা ফেলে দেওয়া উচিত।
>> সব সময় আলুর সবুজ অংশ কেটে ফেলতে হবে, কারণ এটি যে অতিরিক্ত বিষাক্ত তা প্রমাণ করে।
>> যদি আলুতে পচন বা ছত্রাকের লক্ষণ দেখা দেয়, তাহলে তা ফেলে দেওয়াই ভালো।
>> যদি আপনি গর্ভবতী হন, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দুর্বল থাকে অথবা আপনার দুগ্ধপোষ্য শিশু থাকে, তাহলে এ ধরনের আলু খাওয়া থেকে বিরত থাকাই ভালো।
>> বীজ হিসেবে যদি আপনি অঙ্কুরিত আলু রোপণ করেন তবে তা সঠিকভাবে পরিচালনা করুন। অঙ্কুরিত আলু কেটে ফেলার ফলে এমন একটি ক্ষত সৃষ্টি হয়, যেখানে রোগ প্রবেশ করতে পারে, ঠিক আমাদের ত্বকে যেমন কাটা দাগের ক্ষত থাকে।
কীভাবে সঠিকভাবে আলু সংরক্ষণ করবেন?
আলুর অপচয় রোধ এবং দীর্ঘদিন আলুকে সতেজ রাখতে যা করতে হবে:
>> আলু ঠাণ্ডা, শুষ্ক এবং অন্ধকার স্থান যেমন আলমারি বা প্যান্ট্রিতে সংরক্ষণ করতে হবে। আর ৩ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে তাপমাত্রা রাখতে হবে।
>> সংরক্ষণের আগে আলু ধোয়া উচিত নয়। কারণ পানি পচন বৃদ্ধি করে।
আরও পড়ুন: জাতীয় নির্বাচনের ডামাডোলে পরীক্ষায় বসবে ২০ লাখ এসএসসি শিক্ষার্থী?
>> পেঁয়াজের থেকে দূরে রাখতে হবে আলু। এই দুই সবজিই আর্দ্রতা ও গ্যাস নির্গত করে যা কিনা অঙ্কুরোদগমকে ত্বরান্বিত করে।
>> পেঁয়াজ ও রসুন অঙ্কুরিত হলে কী হবে?
>> তবে অঙ্কুরিত পেঁয়াজ ও রসুনের গল্পটি কিন্তু একেবারেই আলাদা।
ইউনিভার্সিটি অব ইস্ট অ্যাংলিয়ার উদ্ভিদ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ক্যাথি মার্টিন বলেন, পেঁয়াজ ও রসুন সাধারণত আলুর চেয়ে নিরাপদ মনে করা হয়। কারণ এগুলোয় একই ধরনের বিষক্রিয়ার ঝুঁকি থাকে না। এগুলোর অঙ্কুরোদগম সাধারণত কোয়ায় সঞ্চিত পুষ্টি থেকে জন্মায়। তবে তবে অঙ্কুরিত পেঁয়াজ ও রসুন আরও তেঁতো স্বাদের এবং নরম হতে পারে।
পেঁয়াজ ও রসুনকে ৩ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও শুষ্ক জায়গায় সংরক্ষণ করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।
সিল করা প্লাস্টিকের ব্যাগে পেঁয়াজ ও রসুন সংরক্ষণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে। এগুলোকে বায়ু চলাচল করে এমন জাল বা কাগজের ব্যাগে সংরক্ষণ করতে হবে।
আলুর মতো, কোনো পেঁয়াজ বা রসুনে ছত্রাক, নরম বা দুর্গন্ধের লক্ষণ দেখা গেলে তা সব সময় ফেলে দিতে হবে।
তথ্যসূত্র : বিবিসি বাংলা