ঢাবির সমাবর্তনে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
শিক্ষাব্যবস্থা পিরামিডের মতো হওয়া উচিত
- ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৮:২৭ PM , আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৮, ০৯:১৩ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ৫১তম সমাবর্তন বক্তা জাতীয় অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান বলেন, দেশের নিম্নস্তরের শিক্ষাকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা সহনশীল শিক্ষার জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি বলেন, শিক্ষাব্যবস্থা হওয়া উচিত পিরামিডের মতো। এর ভিত্তি হবে চওড়া, উচ্চ শিক্ষা হবে তার চূড়া। সকলে যাতে সাধারণভাবে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করতে পারে, তা সর্বাগ্রে দেখা দরকার।
শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তিনি এসব কথা বলেন।
সমাবর্তন বক্তা বলেন,‘আমি খুব জোর দেবো শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের বিকাশে। উচ্চশিক্ষা লাভ করে শিক্ষার্থীরা যদি ভালোমন্দ বিচার করতে না পারে এবং ভালোর পক্ষে দাঁড়িয়ে মন্দকে প্রতিরোধ করতে না পারে তাহলে তাদের উচ্চ শিক্ষা বৃথা। জীবনে আহরিত মূল্যবোধ সমাজের প্রচলিত মূল্যবোধ নাও হতে পারে। শিক্ষার্থীরা যদি মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া মূল্যবোধের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে, সর্বাগ্রে আমি তাকেই স্বাগত জানাবো।’
তিনি বলেন, ইংরেজিতে উচ্চশিক্ষার একটি সমার্থ হলো টারশিয়ারি এডুকেশন বা তৃতীয়স্তরের শিক্ষা। তার মানে, দুটি স্তর (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা- আমাদের দেশে প্রচলিত উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাও এর অন্তর্গত) অতিক্রম করে এই তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করতে হয়। উচ্চশিক্ষা স্বয়ম্ভূ নয়। এর ভিত্তি আগের দুই স্তরের শিক্ষা। সেই দুই স্তরের শিক্ষা সম্পর্কে কিছু না বলে শুধু উচ্চ শিক্ষার কথা বলা বাগ্বিস্তার মাত্র।
রাষ্ট্রের একাধিক ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতাকে দুর্ভাগ্যজনক উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের দেশে নিম্নস্তরের শিক্ষার যে অনেকগুলো ভাগ রয়েছে তা আমাদের দুর্ভাগ্য। বাংলাদেশ রাষ্ট্রই একাধিক ধরনের শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করে চলেছে। নির্ধন শিশু ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষায় প্রবেশ করার কথা কল্পনা করতে পারে না। অন্যদিকে ধনী পরিবারের সন্তান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়ার কথা ভাবতেই পারে না। যদিও সরকারিভাবে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাধারাও পাশাপাশি চলছে। তারপর রয়েছে দু-ধরনের মাদ্রাসা শিক্ষা। সাধারণত গরিব ছেলেমেয়েই সেখানে যায়। এমনকি যারা সওয়াব হাসিল করতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন, তারাও নিজেদের সন্তানকে সেখানে পাঠান না।
আনিসুজ্জামান বলেন, পৃথিবীতে জ্ঞানের যে বিস্ফোরণ ঘটছে তা অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে আমাদের লব্ধ জ্ঞানের অনেকটাই প্রতিনিয়ত বাতিল হয়ে যাচ্ছে। সেখানে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি হচ্ছে। জ্ঞানের সৃষ্টিতে আমরা তেমন অগ্রসর হতে পারিনি। তবে যে নতুন জ্ঞান সৃষ্ট হচ্ছে, তা আয়ত্ব করতে আমরা চেষ্টা করছি। সে প্রয়াস তীব্র না হলে আমাদের শিক্ষার্থীরা সত্যি সত্যি পিছিয়ে পড়বে।
ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে উপযুক্ত শিক্ষা না পাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রার্থিতা মানে উন্নীত হতে পারছে না মন্তব্য করে জাতীয় অধ্যাপক বলেন, আমাদের স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা যে হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, শিক্ষা বিস্তারের জন্য তা আবশ্যক। তবে এ ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধির সঙ্গে তাল রেখে উপযুক্ত শিক্ষা পাওয়া যায় না। ফলে শিক্ষার্থীরা অনেক ক্ষেত্রে বিশেষত- বাংলা ও ইংরেজি ভাষা শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রার্থিতা মানে উন্নীত হতে পারছে না। তারা যখন শিক্ষার তৃতীয় স্তরে অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রবেশ করে তখন এই দুর্বলতা আর দূর করার সম্ভাবনা থাকে না। অবশ্য ১৯ শতকের শেষ দিক থেকে বলা হতে থাকে যে, এদেশে শিক্ষার মান অবনমন ঘটছে। তবে উচ্চ শিক্ষার মানের অবনমন সম্পর্কে কর্মে নিয়োগকর্তারা এখন যেভাবে সমস্বরে কথা বলছেন তা আগে শোনা যায়নি। আমাদের উচিত বিষয়টি বিবেচনা করা এবং তার প্রতিকার খুঁজে পাওয়া।
গ্রাজুয়েটদের উদ্দেশে তিনি বলেন, তোমরা ভুলে যেও না তোমাদের আজকের কৃতিত্বের মূলে রয়েছে তোমাদের পরিবার, শিক্ষায়তন ও এই গরিব দেশ। পৃথিবীর যেখানেই তোমরা থাকো, যে অবস্থায় থাকো- পরিবার ও দেশের কাছে তোমাদের ঋণ ভুলে যেও না। সাধ্যমতো চেষ্টা করো সে ঋণ পরিশোধ করতে। এ কথা জেনো, তোমরা বাংলাদেশের সেই স্বল্প সৌভাগ্যের মানুষদের মধ্যে স্থান লাভ করেছো যারা উচ্চ শিক্ষা লাভের সুযোগ পেয়েছে। মনে রেখো দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ এখনও স্বাক্ষরতার সুযোগবঞ্চিত। পারলে তাদের জন্য কিছু করো। তারা তোমাদেরই ভাই-বোন।