জুলাইযোদ্ধা সেই মাওলানা শফিককে প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগ

জুলাই আন্দোলনে মাওলানা শফিকের সক্রিয়তা
জুলাই আন্দোলনে মাওলানা শফিকের সক্রিয়তা  © সংগৃহীত

চব্বিশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন রাজধানীর ভাটারার এক মাদ্রাসা শিক্ষক মাওলানা শফিকুর রহমান। তার পরিচালিত মাদ্রাসাটি যে বাসায় ছিল, সে বাসার মালিক মিজান খন্দকার ছিলেন ভাটারা থানা শ্রমিক লীগ সভাপতি। ফলে আন্দোলন করার কারণে তার রোষানলের শিকার হয়ে এই মাওলানা মাদ্রাসা অন্যত্র সরিয়ে নিলে, সেখানেও প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসাটি ফের সরাতে বাধ্য করেন ওই আওয়ামী লীগ নেতা। পরে আর আর্থিক অভাবের কারণে সেই মাদ্রাসা চালু করতে পারেননি এই শিক্ষক।

এরই মধ্যে, সেই শ্রমিক লীগ নেতার ছেলে রাব্বী খন্দকার অবিরত তাকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ মাওলানা শফিকের। এ প্রেক্ষিতে গত ২০ নভেম্বর ভাটারা থানায় একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন। যেটি এখনো রুজুই হয়নি বলে জানা গেছে।

এদিকে, মাওলানা শফিকুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, প্রায় প্রায়ই রাব্বী খন্দকার তাকে কল দিয়ে তার অবস্থান জানতে চাচ্ছেন এবং তাকে দেখে নেওয়া ও মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছেন। তার আশঙ্কা, যে-কোনো সময় ওই শ্রমিক লীগ নেতা ও তার ছেলে যে-কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে।

এ বিষয়ে থানায় করা অভিযোগপত্রে মাওলানা শফিকুর রহমান উল্লেখ করেন, আমি আমার নিজ পরিচালিত মাদরাসাতুল ফুনুন আল-ইসলামিয়্যার জন্য মিজান খন্দকারের (বিবাদী) বাসায় ২০২৩ সালের ৫ মে থেকে ২০২৫ সালের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত দুই বছরের চুক্তিতে বাসা ভাড়া নিই। আমার প্রতিষ্ঠানে তখন ৭০ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত ছিল। গত জুলাই আন্দোলনের সময় আমি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ নিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে রাজপথে আন্দোলন করি। যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ গণমাধ্যমেও প্রতিফলিত হয়।

তিনি লেখেন, বিবাদীগণ (মিজান খন্দকার ও তার ছেলে রাব্বী খন্দকার) আওয়ামী লীগের রাজনীতি করায় উক্ত ভিডিও ফুটেজগুলো দেখে আমাকে চব্বিশের ১৭ জুলাই বাসা ছাড়ার জন্য রাজনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি করে এবং আমাকে ছাত্রলীগের মাধ্যমে মারারও হুমকি দেয়। ফলে আমি মাদ্রাসার দায়িত্বে থাকা অন্য শিক্ষকদের দিয়ে নিরাপদ স্থানে সরে যাই। ৫ আগস্টের পর আমি মাদ্রাসায় ফিরে আসি, কিন্তু বিবাদীরা বিভিন্ন বহিরাগতদের মাধ্যমে বাসা ছাড়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করে (উল্লেখ্য, ৫ আগস্টের পর তারা বিদেশে চলে যায়)। 

আরও পড়ুন: পিএসসির চেয়ারম্যানসহ পুরো কমিশন পদত্যাগ না করলে আন্দোলনের হুঁশিয়ারি

এই মাদ্রাসা শিক্ষক অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, ২০২৪ সালের নভেম্বরে আমাকে জোরপূর্বক বাসা ছেড়ে দিতে বাধ্য করায় আমি আমার প্রতিষ্ঠানটি ওই এলাকারই অন্য একটি বাসায় প্রতিস্থাপিত করি। কিন্তু সেটিও বিবাদীদের আত্মীয়ের বাসা হওয়ায় তাদের ইন্দনে আমাকে একমাসের মাথায় সেই বাসাটিও ছেড়ে দিতে বাধ্য করে। আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আমি মাদ্রাসাটি পুনরায় চালু করতে পারিনি। এক বছর পর রাব্বী খন্দকার বিদেশ থেকে এসে আমার বিষয়ে খোঁজখবর নিতে থাকে। আমার অবস্থান জানার পর সে প্রতিনিয়ত আমাকে নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। আমাকে গুম করার হুমকি দিচ্ছে। যে-কোনো সময় আমার ক্ষতি করবে বলে জানাচ্ছে। আমি এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।

জানতে চাইলে মাওলানা শফিকুর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শ্রমিক লীগ নেতা মিজান খন্দকারের ছেলে রাব্বী খন্দকার প্রতিনিয়ত হুমকি দিচ্ছে। তাছাড়াও, কাওছার নামে একজন প্রায় প্রায়ই আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। এর বাইরে অপরিচিত আরও কিছু নম্বর থেকেও হুমকি আসছে। যে-কোনো সময় আমার কিছু হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়টি এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতাদেরকে জানিয়েও তাদের পক্ষ থেকে সাড়া পাইনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অভিযোগটির তদন্ত কর্মকর্তা ও ভাটারা থানার এসআই (সাব-ইন্সপেক্টর) হাসান জামান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিষয়টি নিয়ে আমরা খোঁজ-খবর নিয়েছি। অভিযুক্তরা জানিয়েছে, তারা হুমকি দেয়নি এবং ভবিষ্যতেও দেবে না। আর এখন কেউ হুমকি দিলে সে বিষয়েও আমরা খোঁজ নেব। মামলা রুজু হয়েছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, হুমকি দেওয়া হয়নি বলে জানা গেছে, এজন্য মামলা হয়নি।

মাওলানা শফিকুর রহমানের অভিযোগ সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কর্মকর্তা (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) হামিদুজ্জামান রানা বলেন, বিষয়টির তদন্ত করবে থানা। আমাদের কাজ একটু খোঁজ নেওয়া। তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে এ ব্যাপারে কাজ করব। 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ভাটারা থানার ওসি ইমাউল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি দুইদিন হলো এই থানায় জয়েন করেছি। এটা বেশকিছুদিন আগের অভিযোগ। এ বিষয়ে আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাব। 

আরও পড়ুন: মাধবপুরে অপহরণের পাঁচ দিন পর নবম শ্রেণির ছাত্রী উদ্ধার

জানা যায়, রাজধানীর ভাটারার ছোলমাইদ এলাকায় আব্দুল লতিফ খন্দকার বাড়ির মোড়ের একটি দোতলা ভবনে তিনটি কক্ষ ভাড়া নিয়ে মাদ্রাসা পরিচালনা করতেন প্রিন্সিপাল মাওলানা শফিকুর রহমান। ভবনটির মালিক ছিলেন ভাটারা থানা শ্রমিক লীগের সভাপতি মিজান খন্দকার।

গত বছরের ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ীর কাজলা সেতুতে পুলিশের সঙ্গে মাওলানা শফিকুর রহমানের বাকবিতণ্ডার একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। ওইদিনই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে শহীদ আবু সাঈদের গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। সন্ধ্যায় মাদ্রাসায় ফিরে আসার পর বাড়িওয়ালা মিজান খন্দকারের ছেলে রাব্বী খন্দকার ৪-৫ জনকে নিয়ে এসে তাকে হুমকি দেন এবং দ্রুত বাসা ছাড়ার নির্দেশ দেন।

এর পরদিন ১৮ জুলাই মাওলানা শফিকুর রামপুরায় ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেন। সেখানে পুলিশের ছোড়া রাবার বুলেট ও ছররা গুলিতে তার হাত ও পা আহত হয়। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির দোতলায় স্থাপিত অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। একই সময়ে মাদ্রাসার শিক্ষকরা ফোনে বারবার বাড়িওয়ালার চাপের কথা তাকে জানান।

১৯ জুলাইও তিনি রামপুরা সেতুর আন্দোলনে যোগ দেন। পরবর্তীতে মাদ্রাসায় ফিরে আসার পর আবারও বাড়ির মালিক মিজান খন্দকারের ভাই মনির খন্দকারের হুমকি-ধমকির মুখে পড়তে হয় তাকে।

মাওলানা শফিকুর রহমানের দেওয়া তথ্যমতে, শ্রমিক লীগ নেতার দোতলা বাড়িটির দোতলায় তিনটি কক্ষে ২৪ হাজার টাকা ভাড়ায় পরিচালিত হতো তার মাদরাসাতুল ফুনুন আল ইসলামিয়া, ঢাকা। সেখানে শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত নূরানী, নাজেরা ও হেফজ পড়ানো হতো। ৭০ জন শিক্ষার্থী এবং সাতজন শিক্ষক ছিল মাদ্রাসাটিতে। জুলাই-আগস্টে বাড়িওয়ালার চাপ বুঝতে পেরে অভিভাবকরাও সন্তানদের নিয়ে চিন্তায় পড়ে যান।


সর্বশেষ সংবাদ