স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি রাজবাড়ীর ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার

মো. ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার ও প্রত্যয়নপত্র
মো. ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার ও প্রত্যয়নপত্র  © সংগৃহীত

প্রথমে ট্রেনিং করেন আনসারে। পরবর্তী সময়ে যোগ দেন আনসার ব্যাটালিয়নে। চাকরি থেকেই গিয়েছিলেন যুদ্ধে। যুদ্ধ চলাকালে কুষ্টিয়ার ওয়্যারলেস এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় তাকে। মুক্তিযোদ্ধা সনদের জন্য দীর্ঘদিন চেষ্টাও করেন তিনি। ২০২০ সালে তাকে নিয়ে একটি লেখাও প্রকাশ পায় ‘৭১ মুক্তিযুদ্ধ রাজবাড়ী’ নামের একটি বইয়ে। বিভিন্নভাবে চেষ্টা করেও স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও আজও কাগজে-কলমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পাননি তিনি। 

বলছি রাজবাড়ী জেলার সদর উপজেলার রামকান্তপুর ইউনিয়নের রামকান্তপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ওয়াজ উদ্দিন তালুকদারের কথা। তিনি ওই গ্রামের মৃত রুস্তম তালুকদারের ছেলে। বৃদ্ধ বয়সে পেনশনের সামান্য টাকায় অতিবাহিত করছেন দিন। নেই ছেলে সন্তান। চার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে শুধু স্বামী-স্ত্রীই থাকেন বাড়িতে। বেশ কিছুদিন ধরে পিঠে একটি টিউমার দেখা দিলেও অর্থের অভাবে তার অপারেশন করতে পারছেন না তিনি। 

সরেজমিনে দেখা যায়, বৃদ্ধ বয়সে স্বামী-স্ত্রীর সংসার তাদের। ১৪ শতক জমির ওপর রয়েছে বাড়িটি। জমিটি তার শশুরবাড়ির সূত্রে পেয়েছিলেন তার স্ত্রী মৃত মাহফুজা বেগম। সেটাও মেয়েদের নামে করে দিয়েছিলেন তিনি। এর বাইরে আর কোনো জমি নেই তার। ৪ মেয়েকে বিয়ে দিয়ে চাকরির পেনশনের ১০ হাজার ৬০০ টাকা দিয়ে কোনো রকমে চলছে তাদের সংসার।

দেখা যায়, তার বা পায়ের উপরিভাগে রয়েছে গভীর গর্তের মতো ক্ষত। মুক্তির জন্য লড়াই করতে গিয়ে ৩টি গুলি লেগে হয় সে ক্ষত। এ ছাড়া পিঠে রয়েছে একটি টিউমার। অর্থের অভাবে হচ্ছে না তার চিকিৎসা। অথচ তার দাবি, ‘ভাতা প্রয়োজন নেই, কষ্ট করেছি তাই মৃত্যুর আগে কাগজে কলমে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খেতাব পেতে চাই। আমি সম্মানের সাথে মরতে চাই।’

মুক্তিযুদ্ধকালে ভূমিকা সম্পর্কে জানতে চাইলে মো. ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার বলেন, “শুরুর দিকে আমি ট্রেনিং করেছিলাম আনসারে, কয়েকটি ট্রেনিং করার পরে নিয়ে নিলো আনসার ব্যাটালিয়নে। ১৯৬৯ সালে চাকরিতে প্রথম মাসের বেতন তুলি আড়াইশ টাকা। এভাবেই চলে চাকরি। দেশে শুরু হয় যুদ্ধ। তখন আমি আনসার ব্যাটালিয়ন হিসেবে রাজবাড়ীতে কর্মরত ছিলাম। এমন সময় তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদের নির্দেশে মুক্তিযুদ্ধকালীন জেলা ডেপুটি কমান্ডার এ কে এম নূরন্নবী এসে বললেন, ‘এই ব্যাটারা মরার জন্য রাজি আছিস কারা কারা?’ আমরা ১৮ জন হাত তুলি। তখন নূরুন্নবী বলেন, ‘সেখানে গেলে কিন্তু ফিরে আসা নাও হতে পারে, যখন তখন ঝড়ের মতো গুলি আসতে পারে এবং সেখানেই আমরা মরে যেতে পারি তাই ভেবে চিনতে রাজি হতে হবে।’”

তিনি বলেন, ‘আমরা আগ্রহ প্রকাশ করলে আমাদেরকে কুষ্টিয়ায় নিয়ে যান ডেপুটি কমান্ডার এ কে এম নূরন্নবী। কুষ্টিয়ায় একদিন যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ওয়্যারলেস থেকে বালুঝড়ের মতো অঝোরে গুড়ি ছুড়ে চলেছে খান বাহিনীর সদস্যরা। আমরা কোনো মতে মাথা মাটির সাথে মিশিয়ে নিজেদের কিছুক্ষণ আড়াল করে রাখি। আমার ৩ হাত বামে ছিল এক সহযোদ্ধা। হঠাৎ তার হেলমেটে এসে গুলি লাগলো। হেলমেটটি পরে যাওয়ায় পরবর্তীতে পাচ ছয়টা গুলি তার মাথায় এবং শরীরে এসে লাগলো। তখন অর্ডার এলো গুলি করতে হবে, নইলে এই পরিস্থিতিতে আমরা কেউ বাচতে পারবো না। তখন আমাদের কারও মাথায় হেলমেট আছে, তো কারও মাথায় নেই। গুলি ছুড়তে শুরু করলাম সেদিন আমরা বাকিরা কোনো মতে সুস্থভাবেই ফিরে এসেছিলাম।’

‘তবে পরের দিন আবার যখন যাই, সেদিন কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পরে একসময় খান বাহিনীর ছোড়া গুলি আমার পায়ে এসে লাগে। একই সময়ে পরপর ৩ টি গুলি আমার পায়ে এসে লাগে। আমি তখন হাটতে না পেরে পরে যাই। আমার সহযোগীদের মধ্যে থেকেই কেউ আমাকে নিয়ে যায় কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। সেখানে প্রায় ৩ মাস চিকিৎসা চলতে থাকে আমার।’

ওয়েজ উদ্দিন আরও বলেন, ‘একসময় আমার পরিবারের লোকজন আমার কোনো খোঁজখবর না পেয়ে কুষ্টিয়ার উদ্দেশে রওনার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে তৎকালীন গোয়ালন্দ মহকুমার এসডিও শাহ মোহাম্মদ ফরিদ একটি ইঞ্জিনের সাথে ১টি কোচ নিয়ে আমার পরিবারের ১১ জন সদস্যকে সাথে নিয়ে কুষ্টিয়া গিয়ে আমাকে নিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে বেশ কিছুদিন যাবত শারীরিকভাবে অসুস্থ ছিলাম। তবে শেষে আবার কিছুদিন নূরন্নবীর নেতৃত্বে রাজবাড়ী জেলার আহলাদীপুর মোড়ে ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তির জন্য লড়া যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।’

ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার বলেন, ‘আমি সেই চাকরির পেনশন পাই। পেনশনের সেই ১০ হাজার ৬শ টাকা পেনশন দিয়েই এখন আমি চলি। তবে আমি কোনো ভাতা দাবি করি না। জীবনে কষ্ট করেছি অনেক। অনেক চেষ্টা করেছি, তবুও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ পাই নি। পাইনি মুক্তিযোদ্ধা খেতাব। আমি মৃত্যুর আগে কাগজে-কলমে শুধু সেই খেতাবটুকু চাই। আমি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সম্মানের সাথে মরতে চাই। ’

মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলা দক্ষিণ অঞ্চলের নেতৃত্বপ্রাপ্ত জেলা ডেপুটি কমান্ডার এ কে এম নুরুন্নবী স্বাক্ষরিত এক প্রত্যয়নে লেখা রয়েছে, ‘রাজবাড়ী জেলা সদর উপজেলার রামকান্তপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. ওয়াজ উদ্দিন তালুকদার আমার সাথে ১৯৭১ সালে ৩০ মার্চ তারিখে কুষ্টিয়ার মিলপাড়ায় ওয়ারলেস স্টেশনে পাকহানাদার বাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরে গুলিবিদ্ধ হয় এবং তাকে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সে সেখানে প্রায় ৩ মাস অবস্থান করেন৷ পরবর্তীতে সে আমার সহিত ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১ থেকে রাজবাড়ীর আহলাদীপুরে ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত সম্মুখ যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। সে একজন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে তার অবদান চির উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।’

রাজবাড়ী মুক্তিযোদ্ধা সংসদের জেলা কমান্ডেন্ট খন্দকার হেলাল উদ্দিন বলেন, ‘আমি জেলার দায়িত্ব নেওয়ার পরে তারা অফিসে কখনো আসেনি হয়তো। বিষয়টি আমার জানাও নেই। বর্তমানে এ-সংক্রান্ত কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তবে যেহেতু তার পক্ষে মুক্তিযুদ্ধকালীন ডেপুটি কমান্ডার স্বাক্ষরিত প্রত্যয়ন রয়েছে। তিনি (ওয়াজ উদ্দিন) যদি নিজে অথবা তার পরিবারের কাউকে দিয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে এ সংক্রান্ত একটি আবেদন করেন। এবং সে আবেদনের একটি কপি জেলা প্রশাসক ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদে দেন, তবে মন্ত্রণালয় থেকে যাচাইকালে আমরা তাকে মুক্তিযোদ্ধা তালিকার অন্তর্ভুক্ত করার জন্য চেষ্টা করব।’


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence