সরকারি তালিকায় থাকা যশোরের অধিকাংশ পাঠাগারের নেই বাস্তব অস্তিত্ব

সরকারি তালিকাভুক্ত অনেক বেসরকারি পাঠাগার বাস্তবে অস্তিত্বহীন
সরকারি তালিকাভুক্ত অনেক বেসরকারি পাঠাগার বাস্তবে অস্তিত্বহীন  © টিডিসি ফটো

যশোর জেলায় সরকারি তালিকাভুক্ত অনেক বেসরকারি পাঠাগার বাস্তবে অস্তিত্বহীন। জেলার শার্শার পাকশিয়া বাজারের ‘চেতনা পাঠাগার’ তার এক জ্বলন্ত উদাহরণ। সরকারি কাগজপত্রে বলা হয়েছে, ২০০৭ সালে ভাড়া করা ঘরে পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এখনো চালু রয়েছে। এমনকি যশোর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের ২০১৩ সালের হালনাগাদ তালিকায় এর সম্পাদকের নামও রয়েছে বজলুর রহমান। তবে বাস্তবে পাকশিয়া বাজারে এর কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

ডিহি ইউনিয়ন পাবলিক লাইব্রেরির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনিছুর রহমান বলেন, ‘এ নামে এখানে কোনো লাইব্রেরি নেই।’ একই মত দিয়েছেন পাকশিয়ায় বেড়ে ওঠা যশোর সাংবাদিক ইউনিয়নের (জেইউজে) সভাপতি সাজেদ রহমান বকুলও। অথচ এই লাইব্রেরির নামে সরকারি-বেসরকারি অনুদান সংগ্রহ করা হয়েছে।

এমনকি যশোর শহরের পূর্ব বারান্দীপাড়ার অধ্যাপিকা শামসুন নাহার গণগ্রন্থাগারও ২০০৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও, বর্তমান সময়ে এর কোনো হদিস মেলেনি। অথচ এটি এখনও সরকারি রেজিস্ট্রেশনধারী হিসেবে তালিকাভুক্ত।

সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বই পড়া প্রবন্ধে লাইব্রেরিকে স্কুল-কলেজের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করে গ্রামে গ্রামে পাঠাগার গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছিলেন। সেই তাগিদেই যশোরের বিভিন্ন এলাকায় প্রায় শতাধিক পাঠাগার গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের নিবন্ধনভুক্ত রয়েছে ৬৩টি। তবে অধিকাংশই এখন পাঠকশূন্য। কোনোটি স্মৃতির উদ্দেশ্যে, কোনোটি অনুদানের আশায়, আবার কোনোটি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও তা কার্যকরভাবে পাঠক আকৃষ্ট করতে পারছে না। অনেক পাঠাগার থাকে দিনের পর দিন তালাবদ্ধ। অনুদান পাওয়ার জন্য পাঠক ও বইয়ের সংখ্যা বাড়িয়ে দেখানো হয়, যা বাস্তবতার সঙ্গে মেলেনা।

যশোর শহরের ষষ্ঠীতলার পিটিআই রোডে অবস্থিত সাজ লাইব্রেরি পরিদর্শনে দেখা যায়, সেটিও বন্ধ। লাইব্রেরিটির নিবন্ধন নম্বর ৩৭ এবং সত্ত্বাধিকারী আক্তারুজ্জামান নিজ বাড়ির নিচতলায় এটি প্রতিষ্ঠা করলেও পাঠক টানতে পারেননি।

একই অবস্থা বাঘারপাড়ার ঘোষনগরের ‘অরূপ মেমোরিয়াল পাবলিক লাইব্রেরি অ্যান্ড কালচারাল সেন্টার’-এর। ২০০৬ সালে হরিদাসের ছেলে অরূপের স্মরণে লাইব্রেরিটি প্রতিষ্ঠিত হয়। মাঝে মাঝে বিকালে খুললেও অনুদান পাওয়া অব্যাহত রয়েছে।

২০১০ সালে যশোর শহরের চার খাম্বা মোড়ে ছায়া পাঠাগার নামের একটি লাইব্রেরি নিবন্ধন নেয়। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পাঠাগারটি বহুদিন আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

ঝিকরগাছার বোটঘাট রোডের ‘কপোতাক্ষ বেতার শ্রোতা সংঘ ও পাঠাগার’ নামক আরেকটি পাঠাগার সরকারি নথিতে ১০ বছর ধরে সক্রিয়। অথচ উদ্যোক্তারা জানান, এটি কখনো চালুই হয়নি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আবেদনকারী হুমায়ুন রেজা প্রায় চার বছর আগেই মারা গেছেন। কবি সাইফুদ্দিন সাইফুল জানান, “আমরা কয়েকজন উদ্যোগ নিয়েছিলাম, কিন্তু লাইব্রেরি বাস্তবায়ন হয়নি।”

কেশবপুরের গৌরীঘোনা বাজারের ‘বনফুল গণসংযোগ লাইব্রেরি’ কিছুদিন চালু থাকলেও এখন তা নেই। তবে এখনও সরকারি তালিকায় সক্রিয় দেখানো হচ্ছে। সেই সময়ের সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘একবার ২১ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিলাম। কিন্তু অনুদান পেতেও খরচ হয়, সুপারিশপত্র দরকার হয়, তদবির করতে হয় এইসব ঝামেলায় লাইব্রেরি বন্ধ করে দিয়েছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন সবাই মোবাইল ফোনে ঝুঁকেছে, কেউ আর লাইব্রেরিতে আসতে চায় না। চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দেয়, বই পড়ে না।’

যশোর জেলা সরকারি গণগ্রন্থাগারের সহকারী লাইব্রেরিয়ান মমতাজ খাতুন বলেন, ‘জেলায় রেজিস্ট্রেশনভুক্ত ৬৩টি লাইব্রেরি রয়েছে। যেগুলো বন্ধ আছে, তদন্ত করে তাদের নিবন্ধন বাতিল করা হবে।’

সরকারি নথিতে নাম থাকলেও বাস্তবে বহু পাঠাগারেরই নেই কোনো অস্তিত্ব বা কার্যক্রম। পাঠকের অভাব, অনুদানমুখী প্রশাসনিক ধারা ও আধুনিক প্রযুক্তির প্রভাব গ্রন্থাগার সংস্কৃতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করছেন সচেতন মহল।


সর্বশেষ সংবাদ