বাবুই পাখির আর্তনাদ শুনল না কেউ— এক করাত কেড়ে নিল শত জীবনের নীড়

ঝালকাঠিতে বাবুই পাখির বাসা থাকা তালগাছটি কেটে ফেলা হয় (ইনসেটে মারা যাওয়া ছানা ও নষ্ট হওয়া পাখির ডিম)
ঝালকাঠিতে বাবুই পাখির বাসা থাকা তালগাছটি কেটে ফেলা হয় (ইনসেটে মারা যাওয়া ছানা ও নষ্ট হওয়া পাখির ডিম)  © টিডিসি

ঝালকাঠির সদর উপজেলার পূর্ব গুয়াটন গ্রামে একটি তালগাছ কেটে ফেলে শত শত বাবুই পাখির ছানা, ডিম ও বাসা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার (২৭ জুন) সন্ধ্যায় এ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। এলাকাবাসী একে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের বিরুদ্ধে ভয়াবহ ‘অপরাধ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

জানা যায়, পূর্ব গুয়াটনের তালগাছটি বহু বছর ধরে বাবুই পাখির প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিচিত ছিল। গাছ কেটে ফেলার ফলে মুহূর্তেই শতাধিক ছানা, অসংখ্য ডিম ও বাসা ধ্বংস হয়ে যায়। পরে গাছের নিচে পড়ে থাকা মৃত ও আহত ছানা, ভাঙা বাসা দেখে শিশু, বৃদ্ধ, যুবক—সবাই ভেঙে পড়েন। এমনকি কারও কারও চোখে পানি চলে আসে এ দৃশ্য দেখে। 

স্থানীয়রা জানান, গ্রামের বাসিন্দা মোবারক আলী ফকির তার বাড়ির পাশের তালগাছটি ফারুক ব্যাপারীর কাছে বিক্রি করেন। এরপর ফারুক ব্যাপারী শ্রমিক (কুঠারী) নিয়ে গাছটি কাটেন। গাছ কাটার সময় স্থানীয় কয়েকজন সচেতন যুবক ছুটে গিয়ে গাছটি না কাটার অনুরোধ করেন। এমনকি গাছের বাজারমূল্য পরিশোধ করে সংরক্ষণ করতে চাইলেও অভিযুক্তরা কোনো কথায় কর্ণপাত করেননি।

স্থানীয় পরিবেশ সচেতন নাগরিক সাব্বির ও জাহিদুল বলেন, এই গাছটি শুধু একটি গাছ নয়, এটি একটি প্রাণবৈচিত্র্যের কেন্দ্র ছিল। গাছে গাছে পাখির কিচিরমিচির, ডিম, ছানা—সব মিলে এটি ছিল প্রাণের উৎস। যারা এটি কেটেছে, তারা প্রকৃতির বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। তারা জানান, গাছ কাটার কাজে নিযুক্ত ব্যক্তিরা শুধু কথা অমান্য করেই ক্ষান্ত হননি, বরং প্রতিবাদকারীদের সাথে চরম দুর্ব্যবহারও করেছেন। এক পর্যায়ে এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের ডেকে আনা হলেও ততক্ষণে সব শেষ হয়ে যায়।

আরও পড়ুন: নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা, পবিপ্রবির অধ্যাপকের পদ অবনমিত

ঘটনার পর শনিবার সকালে স্থানীয় প্রশাসন ও বন বিভাগের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। শেখেরহাট ইউনিয়নের গুয়াটন ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য মো. মাসুদুর রহমান জানান, আমি গাছ কাটার পর ঘটনাটি জানতে পারি। পরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখি বহু পাখির বাসা নষ্ট হয়েছে। বিষয়টি ইউএনও ম্যাডামকে জানানো হয়েছে এবং তাঁর নির্দেশে গাছটি জব্দ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) ঝালকাঠির নেটওয়ার্ক মেম্বার আল-আমিন বাকলাই বলেন, বাবুই পাখি শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, পৃথিবীর পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন। তাদের বাসা তৈরির কারুকাজ ও সামাজিক আচরণ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এমন নির্মমতা শুধুই পরিবেশের ক্ষতি নয়, বরং মানবিকতার অপমৃত্যু বলেও মন্তব্য করেন তারা। বাবুই পাখি পরিবেশবান্ধব ও সংরক্ষিত প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। তাদের আবাস ধ্বংস করাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়কেই আইনের আওতায় আনা উচিত।

ঝালকাঠির সামাজিক বনায়ন নার্সারি ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফরেস্টার মো. আরিফুর রহমান বলেন, গাছ কাটার খবর পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি একটি বিশাল তালগাছ কেটে ফেলা হয়েছে, যার ডালে শত শত বাবুই পাখির বাসা ছিল। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। আমরা বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

এলাকার সচেতন মহল ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, শুধুমাত্র অভিযুক্তদের বিচারের আওতায় আনলেই চলবে না—জনগণের মাঝে প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। তাদের মতে, প্রতিটি গাছ কাটা, প্রতিটি প্রাণ হত্যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকিস্বরূপ।

ঝালকাঠি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফারহানা ইয়াসমিন বলেন, উপজেলা প্রশাসন এবং বন বিভাগের কর্মকর্তারা ইতোমধ্যেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। গাছ কাটার ঘটনায় দায়ীদের বিরুদ্ধে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনে পৃথক মামলা দায়েরের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

 

 

 


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence