চাকরির প্রস্তুতি নিতে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বই কিনছেন তরুণরা
- তৌহিদুর রহমান তুহি
- প্রকাশ: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৬ PM , আপডেট: ২৪ নভেম্বর ২০২৫, ০৭:২৬ PM
দেশে প্রতি বছর লাখ লাখ স্নাতক কিংবা স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী চাকরির বাজারে আসছেন। কিন্তু সে তুলনায় পদ খালি থাকছে না। ফলে লাখ লাখ শিক্ষার্থী অ্যাকাডেমিক শিক্ষা শেষে সীমিত সংখ্যক পদে চাকরির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়ছেন। সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পেতে পড়াশোনা করছেন তারা। বেসরকারি ব্যাংকের চাকরিকেও সোনার হরিণ হিসেবে দেখছেন তারা। এসব নিয়োগের প্রস্তুতির জন্য খাতভিত্তিক নিয়োগের প্রস্তুতিমূলক বই, গাইড, মডেল টেস্ট বা প্রশ্নব্যাংক কেনেন চাকরিপ্রার্থীরা।
এভাবে দেশে হাজার হাজার কোটি টাকার চাকরির প্রস্তুতির বই বিক্রি হচ্ছে। দিন দিন বেকারত্বের হার বাড়লেও এক শ্রেণির ব্যবসায়ী হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা। বাজার ঘুরে দেখা গেছে, একজন চাকরিপ্রার্থীর প্রস্তুতির জন্য প্রকাশিত বইয়ের মূল্য ৪৫০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত। তবে একাধিক বই কিনতে হওয়ায় তাদের পদভেবে প্রস্তুতি নিতে গড়ে ২ থেকে ৫ হাজার টাকার বই কিনতে হয়। আর চাকরিবাজারের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা বিসিএসের প্রস্তুতির জন্য প্রিলি থেকে ভাইভা পর্যন্ত গড়ে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকার বই কেনেন একেকজন শিক্ষার্থী।
৪৫তম বিসিএসের প্রিলিতে আবেদন করেছিলেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ চাকরিপ্রার্থী। ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন তিন লাখ ৩৭ হাজারের বেশি। এক্ষেত্রে প্রিলির জন্য গড়ে ৭-৮ হাজার টাকার বই ধরা হলেও ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। আর প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীদের প্রস্তুতি নিতে আলাদা বই কিনতে গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। সবমিলিয়ে বিসিএসের প্রিলি, লিখিত ও ভাইভার প্রস্তুতিমূলক বইয়ের বার্ষিক বাজার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
সবমিলিয়ে চাকরি প্রস্তুতির বইয়ের বাজার দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বইয়ের বাজারের প্রকাশনা বা বিক্রির বিষয়ে নির্দিষ্ট তথ্য কোন দপ্তর কিংবা সংস্থার কাছে নেই। তবে চাকরির বইয়ের ক্ষেত্রে বড় একটা অংশ কয়েকটি প্রকাশনীর দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের বইয়ের বিক্রির পরিমাণ অনেক। আবার মানহীন বই বিক্রি করেও মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে কয়েকটি চক্র।
পড়াশোনা শেষ করে চাকরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন সাদিয়া তাসনিম তামান্না। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা চাকরির প্রস্তুতির জন্য বেসিক কিছু বই কিনে থাকেন। এগুলোর মধ্যে রয়েছে বাংলা ব্যাকরণ, বাংলা সাহিত্য, ইংরেজি সাহিত্য ও গ্রামার, ম্যাথ, কম্পিউটার এবং সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বই। এছাড়া খাত অনুযায়ী বিসিএস, ব্যাংক, সরকারি প্রাইমারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক, নিবন্ধনসহ বিভিন্ন অধিদপ্তরের জন্য আলাদা আলাদা বই কেনেন। এক্ষেত্রে পৃথক নিয়োগ প্রস্তুতির বই কিনতে আনুমানিক দেড় থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত লেগে যায়।’
৪৪তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত এক শিক্ষার্থী জানান, বিসিএসে প্রতিযোগিতা বেশি। প্রিলিমিনারি থেকে ভাইভা পর্যন্ত প্রস্তুতির জন্য কমপক্ষে ১০-১২ হাজার টাকার বই কিনেছেন তিনি। পাশাপাশি অন্য চাকরির জন্য আরও কয়েক হাজার টাকার বই কিনেছেন এ চাকরিপ্রার্থী।
৪৫তম বিসিএসের প্রিলিতে আবেদন করেছিলেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ চাকরিপ্রার্থী। ৪৬তম বিসিএস পরীক্ষায় আবেদন করেছিলেন তিন লাখ ৩৭ হাজারের বেশি। এক্ষেত্রে প্রিলির জন্য গড়ে ৭-৮ হাজার টাকার বই ধরা হলেও ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। আর প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়ে লিখিত পরীক্ষায় অংশ নেওয়া চাকরিপ্রার্থীদের প্রস্তুতি নিতে আলাদা বই কিনতে গুনতে হয় অতিরিক্ত অর্থ। সবমিলিয়ে বিসিএসের প্রিলি, লিখিত ও ভাইভার প্রস্তুতিমূলক বইয়ের বার্ষিক বাজার প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
বড় সংখ্যক চাকরিপ্রার্থী আবেদন করেন শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়। স্কুল ও কলেজে শিক্ষকতার জন্য নিবন্ধনে আবেদন করেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী। সর্বশেষ ১৮তম নিবন্ধনে আবেদন করেছিলেন ১৮ লাখ ৬৫ হাজার ৭১৯ জন প্রার্থী। এ পরীক্ষার জন্য একজন প্রার্থী গড়ে দেড় হাজার টাকার বই কেনেন বলে জানা গেছে। সে হিসাবে কমপক্ষে ২৮০ কোটি টাকার নিবন্ধনের প্রস্তুতির বই বিক্রি হয়েছে।
এছাড়া সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক, খাদ্য অধিদপ্তর, দুদক, বিভিন্ন জেলায় স্বাস্থ্য সহকারী, পুলিশের এসএই ও কৃষিখাতের বিভিন্ন পদে নিয়োগের বইয়ের বাজার অন্তত ৬০০ কোটি টাকার বেশি বলে খাত সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
চাকরিপ্রার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, অ্যাকাডেমিক পড়ালেখা শেষ করেই ‘জব সলিউশন’ কেনেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। খুচরা বাজারে এ বইয়ের দাম ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। প্রতি বছর এ বইটি অন্তত এক লাখের বেশি কপি বাজারে বিক্রি হয়। সে হিসেবে একটি বইয়েরই বার্ষিক বাজার প্রায় ১০ কোটি টাকা।
‘করোনার সময় ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে আমরা দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলাম। পরে আস্তে আস্তে ব্যবসার উন্নতি হতে শুরু করে। এ সরকার আসার পর বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে’ -প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম, ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগের প্রধান, প্রফেসর'স প্রকাশন
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির সময় বইয়ের বাজারে ধস নামলেও এখন কিছুটা ধকল কাটিয়ে উঠেছে প্রকাশনীগুলো। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর একে একে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হওয়ায় বই বিক্রিও বেড়েছে বলে জানিয়েছেন প্রকাশক ও বিক্রয় সংশ্লিষ্টরা।
চাকরি প্রস্তুতির বইয়ের অন্যতম প্রফেসর'স প্রকাশনের ডিজিটাল মার্কেটিং বিভাগের প্রধান মো. মাইনুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘করোনার সময় ব্যবসা একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে আমরা দোকানপাট বন্ধ করে ঘরে বসে ছিলাম। পরে আস্তে আস্তে ব্যবসার উন্নতি হতে শুরু করে। এ সরকার আসার পর বিক্রি প্রায় ৫০ শতাংশ বেড়েছে।’
আরও পড়ুন: ৩ প্লেট ও ৬ ফল্টের কারণে হচ্ছে ভূমিকম্প, কোনটি কোন অঞ্চলে
বইয়ের বাজারের সমন্বয়ের অভাব মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মুদ্রণ শিল্পে বিশেষভাবে নজর দেয়া প্রয়োজন। প্রকাশনার ক্ষেত্রে সমন্বয় নেই বললেই চলে। এ খাতের দ্রুত বর্ধন সত্ত্বেও বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে, যা যদি সঠিকভাবে মোকাবিলা করা না হয়- তাহলে দীর্ঘমেয়াদী বাজারের স্থায়িত্ব ও গুণগত মানে প্রভাব পড়বে।’
চাকরির প্রস্তুতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এসব বই ও লেখার মান। অনেক প্রকাশনী দ্রুত বাজারে বই ছাপাতে গিয়ে সিলেবাস অনুযায়ী তথ্য আপডেট করতে পারে না। যার ফলে শিক্ষার্থী বা পরীক্ষার্থী সময় ও অর্থ উভয়ই নষ্ট হয়। অনেক কোচিং সেন্টার নিজস্ব বই বের করছে, যা দ্রুত প্রস্তুতির জন্য সুবিধাজনক। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই একাডেমিক গভীরতা বা বিশ্লেষণ কম থাকে। তবে নিয়োগ পরীক্ষার সিলেবাস বা প্রশ্নপত্রের রূপ অনেক সময় পরিবর্তিত হয়। তখন বইগুলো সে অনুযায়ী দ্রুত আপডেট করতে খরচ বেড়ে যায়। এর ফলে শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বইয়ের গুণগত মান আরও বৃদ্ধি করা প্রয়োজন বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান ড. শিল্পী বেগম। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘প্রকাশকদের সুনির্দিষ্ট নীতিমালার আওতায় আনা জরুরি। এর ফলে একদিকে যেমন বইয়ের গুণগত মান উন্নত হবে অন্যদিকে পাঠক তাদের বইয়ের বিষয়ে তথ্য পাবে।’ প্রকাশনীর স্বচ্ছতার জন্য নিয়মিত তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে জনসম্মুখে তথ্য প্রকাশ করা উচিত বলেও মনে করেন ঢাবির এই শিক্ষক।