নেগেটিভ মার্কিং শুধরালেই প্রিলি পাস সম্ভব
- এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
- প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১০:২০ PM , আপডেট: ১৬ এপ্রিল ২০১৯, ১০:৩৯ AM
৪০তম বিসিএস দুয়ারে কড়া নাড়ছে। হাতছানি দিচ্ছে সদ্য গ্রাজুয়েট সম্পন্নকারী তরুণদের স্বপ্ন। ৩ মে অনুষ্ঠিত হবে এর প্রিলিমিনারী পরীক্ষা। প্রতিযোগিতাপূর্ণ এই পরীক্ষায় যতটা প্রস্তুতির প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি দরকার কৌশলী হওয়া। তরুণদের প্রথম পছন্দের বিসিএস পরীক্ষার সাতকাহন শুনাতে মুখোমুখি হয়েছেন বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী মাহামুদুল হাসান পারভেজ। ৩৭তম বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগদান করেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন— এম এম মুজাহিদ উদ্দীন
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: দেশের উচ্চশিক্ষিত তরুণদের বড় অংশই এখন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আপনিও শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করে বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। আপনার স্বপ্ন দেখার শুরুটা কেমন ছিল?
মাহামুদুল হাসান পারভেজ: প্রথমে বলি কেন উচ্চশিক্ষিত তরুণরা স্নাতক/স্নাতকোত্তর শেষ হওয়ার পর বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। একজন গ্রাজুয়েট ৪ থেকে ৫ বছর পড়াশোনা করে এমন একটি চাকরি চায়; যা তাকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা দেবে। আমাদের দেশে ভাল চাকরি নাই তা বলব না। কিন্তু ক্যারিয়ার ওরিয়েন্টেড চাকরির সংখ্যা কম।
একজন গ্রাজুয়েট পাশ করার পর তার সামনে তিনটি পথ খোলা থাকে— বেসরকারি চাকরি, সরকারি চাকরি কিংবা বিদেশ গমন। বেসরকারি চাকরির মধ্যে মূলত বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে চাকরির সুযোগ-সুবিধা একটু বেশি। কিন্তু ব্যাংকিং সেক্টরে নানাবিধ অনিশ্চয়তার কারণে আগের মতো ব্যাংকের চাকরি নিশ্চয়তা নেই।
মাল্টিন্যাশানাল কোম্পানিগুলোতে চাকরি পাওয়া বেশ কষ্টসাধ্য। বাইরে পড়তে যাওয়ার জন্য ভাল রেজাল্টের পাশাপাশি IELTS/GRE/GMAT দিতে হয়; যা অনেকেই পারে না। তাই যারা দেশে থেকে ভাল একটা ক্যারিয়ার করতে চায়; তারা সরকারি চাকরির পিছনে বেশ ঝুঁকছেন। আবার সরকারি চাকরির মধ্যে বিসিএস হলো সবদিক মিলিয়ে ভালো। যৌক্তিক কারণেই তরুণদের বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া এটি মানসম্মত ক্যারিয়ার দেওয়ার পাশাপাশি দেশ সেবার সরাসরি সুযোগ দিয়ে থাকে বিসিএস। আবার প্রস্তুতি নিলেই যে সবাই বিসিএস ক্যাডার হবে তা নয়। বিসিএস প্রস্তুতি নিলে অন্য সব সরকারি / বেসরকারি চাকরি পাওয়া অনেক সহজ হয়ে যায়।
আমার ক্ষেত্রে মূলত শুরুটা হয়েছিল বাবার স্বপ্ন পূরণের মধ্যে দিয়ে। বাবার খুব ইচ্ছে ছিল আমি প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করে একদিন জেলা প্রশাসক হই। তারপর আমি নিজেও সবদিক ক্যালকুলেট করে দেখলাম আমার জন্য এটাই বেস্ট ক্যারিয়ার প্ল্যান। যখন দেখলাম প্রশাসন ক্যাডার থেকে বাইরে পড়াশোনার সুযোগ আছে; সরাসরি সমাজ বা দেশের জন্যে কাজ করার সুযোগ রয়েছে; এই পেশা মানুষের কাছাকাছি গিয়ে তাদের কল্যাণে অবদান রাখার সুযোগ দিচ্ছে; তখন সিদ্ধান্ত নিতে অনেক সহজ হয়ে গেলো।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পথে কোনো বাঁধা অতিক্রম করতে হয়েছে কি-না?
মাহামুদুল হাসান: ‘The greater the obstacle, the more glory in overcoming it’। এই উক্তিটি আমি বারবার মনে করতাম। ‘বিসিএস ক্যাডার’ একটা স্বপ্নের নাম। স্বপ্ন পূরণে বাঁধা আসবে না; তা তো হয় না। আমার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাঁধা ছিল চারপাশের পরিবেশ। আশেপাশের মানুষ এবং আত্নীয়-স্বজনের অনেক মাথাব্যথা ছিল আমার চাকরি নিয়ে। কেন আমি চাকরি করছি না? নাকি চেষ্টা করেও হচ্ছে না? এই প্রশ্নগুলো আমার বাবা-মাকে প্রতিদিন শুনতে হত; যা তাদেরকে ব্যথিত করত।
আমি এইসব শোনার পর প্রচণ্ড অপরাধবোধে ভূগতাম। যদিও আমি বাবা-মাকে একটু ধৈর্য্য ধরার জন্য অনুরোধ করতাম। মাঝেমধ্যে খুব হতাশ হয়ে ভাবতাম; যদি ক্যাডার না হতে পারি তাহলে তো পুরো সময়টাই নষ্ট। কিন্তু এই হতাশাটাকে মনে বেশিক্ষণ বসতে দিতাম না। আমার মতে, ক্যাডার হওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাঁধা ‘হতাশা’। আর তা জয় করার সবচেয়ে কার্যকরি টনিক হলো ‘ধৈর্য্য’।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: এই সংগ্রামের পথে আপনার কোন স্মরণীয় কিংবা দুঃখের ঘটনা মনে পড়ে?
মাহামুদুল হাসান: অনেক দুঃখজনক ঘটনাই রয়েছে। সবচেয়ে কষ্ট পেয়েছিলাম যখন ৩৬তম বিসিএসের রেজাল্ট শিটে পছন্দের ক্যাডারে নিজের নাম খুঁজে না পেয়ে। হতাশার সাগরে পুরোপুরি নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিলাম। মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক খেতো; তা হলো- ‘নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েও ক্যাডার হতে পারলাম না’। এরপর ৩৭তমের জন্য প্রস্তুতি নেওয়াটা ছিল সবচেয়ে কঠিনতম কাজ ৷
‘‘পরীক্ষার হলে সবচেয়ে বড় যে ভুলটা হয় তা হলো ‘প্রশ্নের টাইপ ধরতে না পারা’। প্রশ্ন সহজ হয়েছে না কঠিন হয়েছে -এটা ধরতে না পারলে কতগুলো দাগানো উচিত সেটা বোঝা যায় না। যেমন ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন বেশ আনকমন ছিল; কিন্তু অনেকেই তা ধরতে পারেনি। তারা না বুঝেই বেশি দাগিয়েছে। ফলে নেগেটিভ মার্কসের কারণে প্রিলি থেকে বাদ পড়েছে।... ‘‘ঝুঁকি নিয়ে সবাই কমবেশি দাগায় কিন্তু তারও একটা লিমিট থাকা উচিত৷ কারণ অধিকাংশ মানুষই নেগেটিভ নাম্বারের বিষয়টা মাথায় না রাখার কারণে প্রিলি ফেল করে।’’
আর একটা ঘটনাও খুব পীড়া দিয়েছিল। ৩৬তমের লিখিত পরীক্ষার আগে যখন আমার ‘রাইটার্স ক্র্যাম্প’ ধরা পড়ল। ডাক্তার বললো- ডান হাতে লিখা আমার জন্য দিন দিন কঠিন হয়ে যাবে; তাই বাম হাত দিয়ে লিখার প্র্যাকটিস শুরু করতে। একের পর এক ডাক্তার যখন একই কথা বলেছিল, তখন দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম। তিনবেলা মেডিসিন নিয়ে আর প্রতিদিন ২ থেকে ৩ ঘন্টা হাতের লিখা প্র্যাকটিস করে এই সমস্যা নিয়ে পুরো জার্নিটা শেষ করি।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: মাত্র কয়েকদিন পরেই ৪০তম বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে। প্রিলি উতরানোর জন্য স্বল্প এ সময়ের টেকনিক কী?
মাহামুদুল হাসান: ৪০তম প্রিলি পরীক্ষার আর মাত্র দু’সপ্তাহ বাকি। এই স্বল্প সময়ে প্রিলি উতরানোর সহজ টেকনিক হলো— সঠিক উপায়ে রিভিশন শেষ করা; আর কিছু মডেল টেস্ট দেওয়া। ইতোমধ্যে সবার প্রস্তুতি মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। তাই এই শেষ সময়ে রিভিশনের ক্ষেত্রে অনেক কৌশলী হতে হবে। কারণ ‘A better plan is half done’. প্রতিটি সাবজেক্টের যেসব টপিকগুলোতে নম্বার বেশি সেগুলো বেশি বেশি রিভাইস করতে হবে। আর মডেল টেস্ট দিলে নিজের দুর্বলতাগুলো বোঝা যায়। একইসঙ্গে নেগেটিভ মার্কসের বিষয়েও ধারণা ক্লিয়ার হবে। মাথায় রাখবেন রিভিশন কৌশল যত ভালো হবে এবং পরীক্ষার হলে কমন ভুল যত কম করবেন; আপনার প্রিলি পাসের সম্ভাবনা তত বাড়বে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বিসিএসের প্রথম ধাপ পার হতে কোন বিষয়ে (সাবজেক্ট) বেশি সমস্যা হয়? এটি পার হওয়ার উপায় বা কি?
মাহামুদুল হাসান: এইটা নির্ভর করে পার্সন টু পার্সন। যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং বা সাইন্স ব্যাকগ্রাউন্ড হলে বাংলা লিটারেচার, ইংলিশ লিটারেচার এবং বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়বাবলি পড়তে গিয়ে শুরুতে বেশ সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ এইগুলো পুরোটাই মুখস্থ নির্ভর পড়া।
আবার আর্টস বা কমার্স ব্যাকগ্রাউন্ড হলে গণিত এবং মানসিক দক্ষতা (ম্যাথম্যাটিকেল অংশ), সাধারণ বিজ্ঞান, কম্পিউটারে (কিছু টপিকস) কিছু সমস্যার সম্মুখীন হয়। অনেকের আবার ইংলিশেও অনেক সমস্যা থাকে। তবে যে ব্যাকগ্রাউন্ডের হোক না কেন বিসিএস প্রস্তুতিতে সবাইকেই প্রায় সমানভাবে পরিশ্রম করতে হয়।
এর মাঝে যে যত বেশি কৌশলী তার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া তত সহজ। যে মুখস্থ করতে কম পারে; তাকে এমন কৌশল রপ্ত করতে হবে; যেন সহজে কম সময়ে মুখস্থ হয়, আবার মনেও রাখতে পারে। আমি যেমন ডাটা বা তথ্যবহুল পড়া একবারে মুখস্থ না করে মাঝেমধ্যে নিয়ে চোখ বুলাতাম; টেকনিক দিয়ে লিখে রাখতাম; এতে পড়া সহজ হয়ে যেত।
যাদের ম্যাথ এবং সাইন্সে সমস্যা তারা প্রতিদিন ১-২ ঘন্টা ম্যাথ করবে। ম্যাথের যেসব টপিক থেকে রেগুলার প্রশ্ন আসে; সেগুলো প্র্যাকটিস করে রপ্ত করে ফেলতে হবে। টপিক ধরে ধরে নিয়মিত অনুশীলন করলে দেখবেন অনেক উন্নতি হয়েছে। ইংরেজিতে দুর্বলতা থাকলে প্রতিদিন পেপার থেকে দুইটা আর্টিকেল পড়েন; এতে ভোকাবুলারি স্টক বাড়বে আবার গ্রামার সেন্সও উন্নত হবে৷ আসলে একরাতে কোন কিছুই ঠিক করা যায় না। কিন্তু ধৈর্য্য ধরে লেগে থাকলে সব দুর্বলতাই কাটিয়ে উঠা যায়৷
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: প্রিলি পরীক্ষার হলে সাধারণত কী ধরণের ভুল হয়। পরীক্ষার্থীদের কি করা উচিত?
মাহামুদুল হাসান: সবচেয়ে বড় যে ভুলটা হয় সেটা হলো ‘প্রশ্নের টাইপ ধরতে না পারা’। প্রশ্ন সহজ হয়েছে না কঠিন হয়েছে এটা ধরতে না পারলে কতগুলো দাগানো উচিত সেটা বোঝা যায় না। যেমন ৩৭তম বিসিএস পরীক্ষার প্রশ্ন বেশ আনকমন ছিল; কিন্তু অনেকেই তা ধরতে পারেনি। তারা না বুঝেই বেশি দাগিয়েছে। ফলে নেগেটিভ মার্কসের কারণে প্রিলি থেকে বাদ পড়েছে। এটা শুধরালেই প্রিলি পাস সহজ হয়ে যায়।
তাই যাদের প্রস্তুতি ভাল; তারা প্রশ্ন পেয়েই প্রশ্নের টাইপ বোঝার চেষ্টা করবেন। তারপর সে অনুযায়ী দাগাবেন। আর ঝুঁকি নিয়ে সবাই কমবেশি দাগায় কিন্তু তারও একটা লিমিট থাকা উচিত৷ কারণ অধিকাংশ মানুষই নেগেটিভ নাম্বারের বিষয়টা মাথায় না রাখার কারণেই প্রিলি ফেল করে।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শেষ মুহুর্তে এসে পরীক্ষার্থীদের কি ধরণের প্রস্তুতি নেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন। কোন বিষয়গুলো এখন বেশি বেশি পড়া উচিত?
মাহামুদুল হাসান: শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি হলো কৌশল অবলম্বন করে রিভিশন দেওয়া। যতই ভাল প্রস্তুতি নেন না কেন রিভিশন দিতে না পারলে পরীক্ষার হলে শুধুই কনফিউজড হবেন। এই সময়ে বাংলা লিটারেচার, ইংলিশ লিটারেচার, বাংলাদেশ বিষয়াবলির বিষয়ভিত্তিক (কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, জনসংখ্যা প্রভৃতি), আন্তর্জাতিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ; সাধারণ বিজ্ঞানের এবং মানসিক দক্ষতার ক্ষেত্রে বিগত সালের প্রশ্নসমূহ; কম্পিউটারের ডাটাভিত্তিক প্রশ্নসমূহ, ম্যাথের বেলায় গুরুত্বপূর্ণ নিয়মগুলো বারবার রিভিশন দেওয়া উচিত। এইগুলোতে পড়ার পরিমাণের তুলনায় নাম্বার বেশি থাকে। আর সাল, তারিখ, সংখ্যাভিত্তিক পড়া যত কম পড়া যায়; ততই মঙ্গল।
দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: ধন্যবাদ আপনাকে।
মাহামুদুল হাসান: ধন্যবাদ