‘ভূতের ভয়’ কাটছে জাবি প্রশাসনে

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়  © ফাইল ছবি

গত ১ মার্চ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হলে ওইদিনেই উপ-উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলমকে উপাচার্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরেরদিন অধ্যাপক নুরুল আলমের দায়িত্বগ্রহণ করার কথা থাকলেও অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম দায়িত্ব ছাড়েন ওইদিন মধ্যাহ্নে। এরপর থেকেই একধরনের অদৃশ্য ‘ভয় ও চাপ’ এর ওপর ভর করে চলছিল জাবির প্রশাসনিক কার্যক্রম।

তবে দেড় মাসের মাথায় এসে অধ্যাপক নুরুল আলমকে ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটে। আজ রবিবার (১৭ এপ্রিল) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব মাসুম আহমেদ স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে তার এই নিয়োগের কথা জানানো হয়। কার্যত এই আদেশের মধ্য দিয়ে জাবিতে উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের অধ্যায়ের ইতি ঘটলো।

জানা যায়, মার্চে অধ্যাপক নুরুল আলমের উপাচার্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের কাছে সুবিধাভোগী ও ঘনিষ্ঠ শিক্ষক-কর্মকর্তারা দাবি করতেন যে, শিগগির অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য হিসেবে ফিরে আসবেন জাবিতে। একই কথা সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলাম নিজেই সদ্য সাবেক রুটিন উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলমকেও বলেছেন বলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফারজানা ইসলামের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সমাজবিজ্ঞান অনুষদের এমন একজন প্রভাবশালী শিক্ষক।

অধ্যাপক নুরুল আলম রুটিন উপাচার্য নিয়োগের পর প্রথম এক সপ্তাহে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডেপুটি রেজিস্ট্রার বলেছিলেন, আজম স্যাররা (অধ্যাপক আলী আজম তালুকদারসহ সেসময়ের সুবিধাভোগী ও ঘনিষ্ঠ শিক্ষকগণ) বলেছিলেন ৩-৪ দিন পর নাকি উনি আবার আসতেছেন। এজন্য সবাই ভয়ে আছেন। কেউ মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।

তবে অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার বিষয়টিকে ভিত্তিহীন বলে উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, এই অভিযোগটি পুরোপুরি ভিত্তিহীন। আমি এরকম লোক নই। আর এগুলো আমার সাথে যায় না।

সেসময় সাবেক উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ কয়েকজন শিক্ষকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে উন্নয়ন কাজ চলমান তা সুষ্ঠুভাবে চলতে অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের বিকল্প নাই। যেকোনভাবে তিনি আসতেছেন, সেটা এ্যাক্টের (ইউনিভার্সিটি এ্যাক্টের) ১১’র ১/ ২ হোক। এটা ডকট্রিন অব নেসেসিটি। আর প্রধানমন্ত্রী সফর শেষে দেশে ফিরেই সেটা হবে।

এসময় উপাচার্য ফারজানার আমলের শেষ সিন্ডিকেটে পাস হওয়া আপগ্রেডেশন ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের রুটিন আপগ্রেডেশন ও থমকে থাকে। একদিকে ফারজানা ইসলামের সুবিধাভোগীদের চাপ অন্যদিকে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষোভ।

রুটিন আপগ্রেডেশন না হওয়ায় কর্মকর্তাদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করে কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি আজিম উদ্দিন বলেন, বুঝতেছি স্যার (রুটিন উপাচার্য) কেন বাই রোটেশন যেই আপগ্রেডেশন হওয়ার কথা সেটা কেন করতেছেন না। রুটিন দায়িত্বটা তো ওনাকেই ডিফাইন করতে হবে। কিসের ভয়ে উনি করতেছেন না তা বোধগম্য না।

এসব নিয়ে উপায় না দেখে রুটিন উপাচার্যের নির্দেশে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ‘রুটিন দায়িত্বের’ ব্যাখ্যা চেয়ে চিঠি লিখেন ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ। প্রথমবার চিঠির জবাব না পেয়ে মন্ত্রণালয়ের মৌখিক নির্দেশে পুনরায় চিঠি লিখেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত কোন চিঠিরই জবাব মেলেনি।

তবে আজ রবিবার মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও চ্যান্সেলরের অনুমোদনক্রমে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় আইন, ১৯৭৩ এর ১১(২) ধারা অনুসারে অধ্যাপক নুরুল আলমকে উপাচার্য পদে সাময়িকভাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। 

তথ্যমতে, গত মার্চ মাসে ২১ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট টিম বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে ২ কোটি টাকা ঈদ সেলামীসহ ১৬টি খাতের তথ্য চেয়ে তাকিদপত্র দেওয়া হলেও সব কাগজপত্র দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এরপর দ্বিতীয় দফা তাকিদপত্র দেন অডিট টিমের প্রধান বাবুল হোসেন। তবে অডিট টিমের কাজের সীমাপরিসীমা নিয়ে বিতর্ক উঠিয়ে শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরসহ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে ২৪ তারিখে অডিট টিমকে অডিট কাজ হতে বিরত রাখা হয়।

পরবর্তীতে অডিট টিমের সরেজমিন সংগৃহীত তথ্য, উপাত্ত ও প্রমাণক এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে পাঠানো দলিলসমূহ পর্যালোচনা করে সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে ৬৫ কোটি টাকার অডিট আপত্তি দেওয়া হয়েছে।

এরপর গত ৫ এপ্রিল কেন্দ্রীয় ভর্তি পরিচালনার কমিটির সভা ও সিন্ডিকেট সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক নুরুল আলম। অন্যদিকে ৩য় ও চতুর্থ শ্রেণির আপগ্রেডেশন ৪টি বোর্ড বসলেও এসিসট্যান্ট রেজিস্ট্রার থেকে ডেপুটি রেজিস্ট্রার হবেন এমন কর্মকর্তাদের বোর্ড বসছে না।

বোর্ড দেরিতে বসার কারণ জানতে চাইলে ডেপুটি রেজিস্ট্রার (প্রশাসন) বি এম কামরুজ্জামান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আসলে কর্মচারীদের অনেকেরই শর্ত পূরণ না হওয়ায় পরে আবেদন করেছে। যে চারটি বোর্ড বসবে সেগুলোতে সভাপতিত্ব করবেন উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) ও উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) আর ডেপুটি রেজিস্ট্রার যারা হবেন তাদেরটা উপাচার্য স্যার রুটিন দায়িত্বের মধ্যে করতে চাচ্ছেন না। তারা অবশ্য আগেই আবেদন করেছেন কিন্তু সাবেক উপাচার্য ব্যবস্থা নেননি।

কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম হাওলাদার বলেন, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ম্যাডামের জন্য এমনিতেই দেরি হযেছে। তাছাড়া এতদিন রুটিন উপাচার্য স্যার আপগ্রেডেশন বোর্ড করতে চাচ্ছিলেন না কিন্তু আমরা বুঝিয়েছি যে উপাচার্য হিসেবে কাজ না করলেও উপ-উপাচার্য হিসেবে যেন উনি এটা করেন। উনি সম্মত হয়েছেন।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের সভাপতি রাকিবুল রনি মনে করেন, সরকারের উপর মহলে তাঁর প্রভাবের গল্প ছড়িয়ে স্বার্থান্বেষী কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি সম্ভবত একই সাথে এক ধরণের ভীতি ও আশাবাদ সঞ্চার করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন।

তিনি বলেন, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকা সত্ত্বেও, তিনি আত্মস্বীকৃত হামলা-মামলাবাজ হবার পরেও সরকারের নগ্ন সমর্থন পেয়েছিলেন। ফলে সরকারের উপর মহলে তাঁর প্রভাবের গল্প ছড়িয়ে স্বার্থান্বেষী কতিপয় শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনি সম্ভবত একই সাথে এক ধরণের ভীতি ও আশাবাদ সঞ্চার করতে তিনি সক্ষম হয়েছিলেন। যার ফলে মেয়াদ শেষ হবার পর তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্যের চেয়ারে আসবার উড়ো ও বানোয়াট সম্ভাবনার গল্পের প্রভাব তাঁর অনুপস্থিতিতেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রায় সর্বস্তরে ছিলো বলেই ধারণা করি৷

প্রগতিশীল শিক্ষক মঞ্চের মুখপাত্র ও দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, যেহেতু উপাচার্যের বাসভবনটি উপাচার্যের অফিসও কাজেই মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বাসভবনে 'অযৌক্তিক' অবস্থান করায় প্রশাসনিক কার্যক্রমকে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাহত করেছে।

জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম জাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক কামরুল হাসান বলেন মনে করেন সাবেক উপাচার্যের এমন 'ভয় দেখানোর রাজনীতি'র পেছনে দায় শুধু সাবেক উপাচার্যের একার নয় বরং সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের ও দায় রয়েছে।

তিনি বলেন, এই যে একজন উপাচার্য দুই মেয়াদের পর তৃতীয় মেয়াদে উপাচার্য হওয়ার গুঞ্জন আসে, একটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে অধ্যাদেশ দ্বারা 'নিয়মমাফিক' পরিচালিত হলে তো এরকমটি হতো না। আশা করি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ আইনানুযায়ী খুব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এদিকে, ‘অদৃশ্য চাপ ও ভয়ের’ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ ও রুটিন উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম।

ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার রহিমা কানিজ বলেন, আসলে কোনো ধরনের চাপ ছিল না, এখনো নেই। স্যার একটু সময় নিয়ে জেনে-বুঝে কাজগুলো করছেন। 

উপাচার্য অধ্যাপক নুরুল আলম বলেন, আমার উপর কখনোই কোনোধরণের চাপ ছিলো না, আমি একটু সময় নিয়েছিলাম। সবকিছু ঠিকঠাক করতে, এর বেশি কিছু না। আশাকরি এভাবেই সবকিছু চলবে।

কেন্দ্রীয় প্রশাসনের কাজকর্ম বৃদ্ধির সাথে দাপ্তরিক ও অন্যান্য কার্যক্রম গুলো বৃদ্ধি পেয়েছে- এ কথার সাথে একমত পোষণ করেন তিনি।

তবে এ পর্যন্ত উপাচার্যের গাড়ি, বাড়ি সাবেক উপাচার্যের ‘অবৈধ দখলে’ রয়েছে। আর উপাচার্যের দপ্তরে বসার কথা বললেও পরে আর তা করেননি অধ্যাপক নুরুল আলম। একই দায়িত্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের উদাহরণ দিলে তিনি বলেন, একটা আলাদা চেয়ার নিয়ে উপাচার্যের চেয়ারের পাশে বসা আর আমার কার্যালয়ে বসার মধ্যে তো আমি কোনো পার্থক্য দেখি না।


সর্বশেষ সংবাদ