ঢাবির হল চলে ছাত্রলীগের ‘সংবিধানে’
- ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০১:৫২ PM , আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৪:২৮ PM
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ছাত্রলীগের। হলে শিক্ষার্থী ওঠানো থেকে শুরু করে কক্ষ বরাদ্দ দেয়া সবই করে সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। এসব ক্ষেত্রে হল প্রশাসনের ভূমিকা শূণ্য। ফলে শিক্ষার্থীদের বাধ্য হয়েই ছাত্রলীগে নাম লেখাতে হয়। অংশ নিতে হয় দলীয় কর্মসূচিতে। এর ব্যত্যয় ঘটলেই ‘গেস্টরুমে’ নিয়ে নির্যাতন করা হয়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, প্রশাসন ছাত্রলীগের এসব কর্মকাণ্ডে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো প্রশ্রয় দেয়।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করেছে প্রশাসন। ভিসি অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, এগুলো অহরহ কোন ঘটনা নয়। অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা এসব। এগুলো হল প্রশাসনের নজরে আসলে তারা ব্যবস্থা নেয়।
হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, হলে আধিপত্য বিস্তারে নবীন শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে ছাত্রলীগ। প্রথমে গণরুমে ও পরে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীদের অন্য কক্ষগুলোতে তোলে তারা। নবীন শিক্ষার্থীদের নিজেদের রাজনৈতিক কাজে বেশি ব্যবহার করে। এর কারণ হিসেবে শিক্ষার্থীরা জানান, গ্রাম থেকে একটা ছেলে এসে সে থাকার জায়গা পায় না। এই সুযোগটাই নেয় ছাত্রলীগ। নেতারা নিজ নিজ এলাকার শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে হলে ওঠায়। গ্রুপ ভারী করে। তাদের দিয়েই মিছিল-মিটিং করায়। এসব শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হল গুলোতে রাতে তারা ‘গেস্টরুম’ পরিচালনা করে। গেস্টরুমে ম্যানার শেখানোর নামে শিক্ষার্থীদের ওপর চলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়েন।
আরও পড়ুন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম আদালত’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী জানান, হলগুলোতে ছাত্রলীগের বেশ কিছু নিয়ম প্রচলিত রয়েছে। সেগুলোকে তারা ছাত্রলীগের ‘সংবিধান’ বলেন। এই সংবিধান অনুযায়ীই হলগুলো পরিচালনা করেন নেতারা। নিয়মগুলোর মধ্যে রয়েছে, প্রথম বর্ষ ছাড়া সবাইকে সালাম দেয়া, সালাম দেয়ার সময় হাতে ঝাঁকি ও চাপ না দেয়া, ছাত্রলীগের সকল প্রোগ্রামে নিয়মিত অংশগ্রহণ করা, গেস্টরুমে উপস্থিত থাকা, হলের ‘চেইন অব কমান্ড’ মানা।
করোনার কারণে দেড় বছর বন্ধ থাকার পর ১০ অক্টোবর খুলে দেয়া হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো। হল খোলার পূর্বে প্রশাসন মেধার ভিত্তিতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের হলে ওঠানোর ঘোষণা দিলেও সেটি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। আবাসিক হল খোলার পর পুনরায় চালু হয় গেস্টরুম নির্যাতনও। গত তিন মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন প্রায় ১০ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে নভেম্বরে ভারত-পাকিস্তানের খেলা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট করা এবং বন্ধুর সেই ফেসবুক পোস্টে লাইক করায় দুই শিক্ষার্থীকে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী নির্যাতন করার অভিযোগ ওঠে। এছাড়া গত ২৬ জানুয়ারি (বুধবার) রাতে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আকতারুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে নির্যাতন করার ফলে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
চলতি মাসের ৬ ফেব্রুয়ারি রাতে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে প্রথম বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর করে পরাগ নামে এক ছাত্রলীগ কর্মী। গত বছরের ১৮ নভেম্বর স্যার এ এফ রহমান হলে ‘গেস্ট রুমে হাজিরা’ বন্ধের সিদ্ধান্তের খুশিতে ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ায় ৩ ছাত্রকে বেধড়ক পেটায় শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ২৫ জানুয়ারি সিনিয়রদের কথা না শোনায় ওই হলের দুই শিক্ষার্থীকে গেস্টরুমে ডেকে এনে চড়-থাপ্পড় মারা হয়। গত বছরের অক্টোবরে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের কয়েকজনকে সালাম না দেয়া, ছাত্রলীগের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে না যাওয়ার জন্য মারধর করা হয়। এছাড়া গত বছরের ২১ নভেম্বর ফজলুল হক মুসলিম (এফএইচ) হলে শিক্ষার্থীদের রুমে রুমে গিয়ে তাদের বের করে দেওয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ নেতা মো. সারোয়ার হোসেন ও সানোয়ার হোসেন নাঈম। ৭ নভেম্বর রাতে সূর্যসেন হলে ছাত্রলীগের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ না করার অভিযোগে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তরিকুল ইসলাম এবং নৃবিজ্ঞান বিভাগের মো. আরিফুল ইসলাম নামের দুই শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে মারধর করেন ছাত্রলীগ কর্মী সিফাত উল্লাহ ও তার এক বন্ধু। সেই ঘটনার পর তার কাছ থেকে মুচলেকা নেয় হল প্রশাসন। কিন্তু এই ঘটনার এক মাসের মাথায় ১৩ ডিসেম্বর ছাত্রলীগের অনুষ্ঠানে না যাওয়ায় ফারসি ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী কাজী পরশ মিয়াকে হলের ৩৫১ নম্বর কক্ষে মিনি গেস্টরুমের জন্য ডেকে মারধর করেন সিফাত। যদিও পরে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় আবাসিক হল থেকে তাকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
আরও পড়ুন- ঢাবিতে গেস্টরুম দখল নিয়ে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপে মারামারি
এদিকে মেয়েদের হলেও গেস্টরুমের নামে শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয় বলে অভিযোগ আছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৭ নভেম্বর রোকেয়া হলের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের প্রথম বর্ষের দুই শিক্ষার্থীকে রাতভর গেস্টরুমের নামে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের অভিযোগ ওঠে হলের তৃতীয় বর্ষের পাঁচ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। এক ছাত্রীকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ধরে নাচতে বাধ্য করা হয়।
এসব বিষয়ে জানতে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনকে কল দিলেও রিসিভ করেন নি তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের দপ্তর সম্পাদক মেফতাহুল আলম পান্থ বলেন, গেস্টরুমের যে কালচার এটা ছাত্রলীগের মধ্যে নেই। আগে ছাত্রদলের সময় গেস্টরুমে নির্যাতন করা হতো। এখন আমরা সেটা বন্ধ করেছি। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা ঘটলে সেটার বিরুদ্ধে আমরা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেই।