ঢাবির জরাজীর্ণ হলগুলোতে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে নতুন ফাটল, বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের

ভূমিকম্পে ঢাবির বিভিন্ন হলে ফাটল দেখা দিয়েছে
ভূমিকম্পে ঢাবির বিভিন্ন হলে ফাটল দেখা দিয়েছে  © টিডিসি

শুক্রবার (২১ নভেম্বর) সকালে ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে রাজধানী ঢাকা। কয়েক সেকেন্ডের এই মাঝারি মাত্রার কম্পনেই নতুন ফাটল দেখা দেয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) একাধিক জরাজীর্ণ আবাসিক হলে, যা বড় ধরনের ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয়ের শঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরা আতঙ্কিত হয়ে হল থেকে বের হয়ে আসেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, দীর্ঘদিন অবহেলিত শতবর্ষী হলগুলো বড় দুর্যোগের আগে ‘তাৎক্ষণিক সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ’ ছাড়া কোনো পথ নেই।

৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, হাজী মুহাম্মদ  মুহসীন হল,স্যার এ এফ রহমান  হল, বিজয় একাত্তর হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান হল, কবি জসীমউদ্দিন হল ও শামসুন্নাহারসহ একাধিক হলে দৃশ্যমান ফাটল দেখা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক আবাসিক ভবনে ফাটল দেখা দেওয়ায় শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, অল্প সময়ের একটি মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেই যখন হলগুলোতে এ ধরনের ক্ষতি হয়, তখন বড় মাত্রার ভূমিকম্পে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শতবর্ষী আবাসিক হলগুলোর অবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই নাজুক। শহীদুল্লাহ হল, মহসিন হল ও সলিমুল্লাহ হলের মতো পুরোনো ভবনগুলো ২০১৪ সালেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং সেকশন কর্তৃক ‘বাসযোগ্য নয়’ হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু এক দশক পেরিয়ে গেলেও প্রয়োজনীয় সংস্কার বা নতুন ভবন নির্মাণ শুরু হয়নি। আজকের ভূমিকম্পে কয়েকটি হলে শিক্ষার্থীরা আহতও হয়েছে বলে জানা গেছে।

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বহু বছর ধরে নতুন হল নির্মাণে ‘মাস্টারপ্ল্যান’ রয়েছে বলে জানালেও তার কোনো বাস্তব অগ্রগতি নেই। তাদের দাবি, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অবশ্যই ‘স্টুডেন্ট ফার্স্ট’ নীতি গ্রহণ করতে হবে—নিরাপত্তা, আবাসন ও কল্যাণই হতে হবে সব সিদ্ধান্তের কেন্দ্রবিন্দু।”

শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ ও সংগঠিত না হলে পরিস্থিতির উন্নতি অসম্ভব।

শহীদুল্লাহ হলের এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমার রুমের দরজার ওপরের অংশে বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। ১০০ বছরের পুরোনো এই ভবনগুলোতে বাস করা মানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুঝুঁকিতে থাকা।’

শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তাদের জন্য নাজুক আবাসন রেখে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বহু নতুন বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলেও সেগুলোর কোনোটিই শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করা হয়নি। এতে প্রশাসনের উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশ তিনটি সক্রিয় প্লেট—ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান ও বার্মা প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থান করায় বড় ধরনের ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে রয়েছে।

সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) এবং জাইকার যৌথ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৭ সালে দেশে ২৮টি, ২০২৩ সালে ৪১টি এবং ২০২৪ সালে ৫৪টি ভূমিকম্প রেকর্ড হয়েছে, যা বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনাকে আরও ঘনিয়ে আনে। সর্বশেষ ১৯১৮ সালে শ্রীমঙ্গলে ৭.৬ মাত্রার একটি বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। তবে, ৮ মাত্রার কাছাকাছি সর্বশেষ বড় ভূমিকম্প ছিল ১৮৯৭ সালের গ্রেট আসাম ভূমিকম্প। 

ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বড় ভূমিকম্প সাধারণত ১০০ বছরের ব্যবধানে পুনরাবৃত্ত হয়। এ হিসেবে বাংলাদেশ এখন অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, ঢাকায় যদি ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তবে ৭২ হাজারের বেশি ভবন ধসে পড়তে পারে, এবং ঢাকার ২ কোটির বেশি মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়বে। আর যদি ৯ মাত্রার ভূমিকম্প হয় তাহলে এক লাখের বেশি ভবন ধ্বসে পড়বে। এমন ও হতে পারে যে পুরান ঢাকাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে।  ভবন গুলো এমনভাবে আছে যে উদ্ধারকর্মীরা উদ্ধার কাজ ও চালাতে পারব না। 

ভূমিকম্পে সৃষ্ট ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  ভুতত্ত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, ‘আমাদের ছোট্ট এই দেশে জনসংখ্যা অনেক, আর ভূগর্ভের নিচে যেসব সাব–সারফেস রক ও সফট রক আছে, সেগুলোর বৈশিষ্ট্য ভূমিকম্পের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে। বাংলাদেশকে আমরা ভূমিকম্প ঝুঁকির তিন ভাগে ভাগ করি—উচ্চমাত্রা, মধ্যমাত্রা ও নিম্নমাত্রা। সিলেট অঞ্চল উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে, আর মধ্যম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে ঢাকা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ময়মনসিংহসহ আশপাশের এলাকাগুলো।’

তিনি বলেন, ‘সাবডাকশন জোনের আশপাশে বড় ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা সবসময়ই বেশি থাকে। আজকের যে ভূমিকম্পটি হয়েছে, সেটি ঢাকার খুব কাছেই—ঢাকা থেকে মাত্র ৩৫ কিলোমিটার দূরে নরসিংদীতে। তাই ঢাকায় এর প্রভাবও বেশি অনুভূত হয়েছে।’

ইনফ্রাস্ট্রাকচার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে মো. বদরুদ্দোজা মিয়া আরও বলেন, ‘আমাদের ভবন, রাস্তা বা যেকোনো বড় নির্মাণ কাজ করার সময় ভূমিকম্পঝুঁকি মাথায় রেখে কাজ করা উচিত। বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে অনুসরণ করতেই হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর দিকে তাকালেই দেখবেন, অনেক ভবনের বয়স ৬০, ৭০, এমনকি ৮০ বছর। একটি ভবনের তো লাইফটাইম আছে। সেই লাইফটাইম অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। এগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির জন্য ভূমিকম্পের দরকার নেই।’

হলের শিক্ষার্থীদের ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি নিজেও হলে ছিলাম। ছাদ থেকে কিছু পড়ার ঘটনা খুবই সাধারণ ছিল। আজকের ঘটনার পর ছাত্রছাত্রীরা যে ভয় পেয়েছে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীদের আরও সচেতন করা দরকার—ভূমিকম্পে কখনোই লাফ দেওয়া যাবে না, অস্থির হওয়া যাবে না। যে যেখানে থাকে, মাথা রক্ষার মতো শেল্টার নিতে হবে। এই সেফটি প্র্যাকটিসগুলো নিয়মিত শেখানো খুব জরুরি।’

বিদেশের উদাহরণ টেনে মো. বদরুদ্দোজা মিয়া বলেন, ‘আমি পাঁচ বছর জাপানে ছিলাম, সেখানে তিন মাস পরপর ভূমিকম্প মক ড্রিল হতো। ওরা আট-নয় মাত্রা পর্যন্ত মোকাবিলা করার মতো বিল্ডিং তৈরি করে। কিন্তু আমাদের ভবনগুলোর বড় একটি অংশ খুব পুরোনো, দুর্বল এবং অনেক ক্ষেত্রে রক্ষণাবেক্ষণহীন। এর মধ্যে আবার বেশিরভাগ আবাসিক হলের লাইফটাইম শেষ হয়ে গেছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল প্রসঙ্গে হতাশা জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, ‘শহীদুল্লাহ হল, মুহসিন হল তো ২০১৪ সালেই বসবাসের অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল। এরপরও শিক্ষার্থীরা সেখানে থাকে—এটা খুবই দুঃখজনক। এগুলোর সংস্কার বা পুনর্নির্মাণ অনেক আগেই করা উচিত ছিল।’

ভূমিকম্প সচেতনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়ভার মূলত ফায়ার সার্ভিস ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। মাঝে মাঝে সামান্য সচেতনতামূলক কার্যক্রম হয় ঠিকই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। প্রতিটি হলে নিয়মিত মক ড্রিল প্রয়োজন।”

স্কুল পর্যায়ে ভূমিকম্প শিক্ষার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘একসময় আমাদের পাঠ্যপুস্তকে ভূমিকম্প ও দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা শেখানো হতো, এখন অনেক জায়গায় তা নেই। স্কুল–কলেজ থেকেই যদি বাচ্চারা দুর্যোগ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে বড় হয়, তাহলে দেশে সচেতনতা অনেক বাড়বে।’


সর্বশেষ সংবাদ