ঢাবি শিক্ষার্থী পরিচয়ে ভর্তি কোচিং তিতুমীর ছাত্রের, অতঃপর...
- জুবায়ের হোসাইন, ঢাবি প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪, ১১:১৭ PM , আপডেট: ২৩ জুন ২০২৪, ১২:১৫ AM
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানে পড়ার প্রবল আগ্রহকে কাজে লাগিয়ে অনলাইন কোচিংয়ের নামে ব্যবসা করার অভিযোগ উঠেছে কলেজে পড়ুয়া একদল শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন ইমরান হোসাইন নামে এক শিক্ষার্থী। তার বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয়ে ভর্তি প্রস্তুতির জন্য অনলাইনে পড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। তবে তিনি অধিভুক্ত সরকারি তিতুমীর কলেজের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী বলে জানা গেছে। ‘লার্ন উইথ ইমরান’ নামে তার একটি ফেসবুক পেজও আছে এবং সেখানে এক লাখেরও বেশি ফলোয়ার রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা ঢাবির ছাত্রদের প্ল্যাটফর্ম ভেবে ভর্তি হচ্ছে, যেটা তাদের সঙ্গে প্রতারণার শামিল। এ ঘটনায় জড়িতদেরকে শাস্তির আওতায় না আনলে ঢাবি শিক্ষার্থীরা পরিচয় সংকটে পড়বে। পাশাপাশি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সাথে যে প্রতারণা করা হচ্ছে তারাও ভর্তি কোচিংয়ের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে।
জানা যায়, ইমরান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র দাবি করেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের কাছে। পরবর্তীতে টাকার বিনিময়ে অনলাইনে ক্লাস করান তিনি। তিনি নিজেকে ঢাবির হিসাববিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র দাবি করেছেন এমন একটি স্ক্রিনশট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। যদিও এ স্ক্রিনশট বানানো বলে জানিয়েছেন ইমরান।
বায়ে তিতুমীর ছাত্র ইমরান ও মাঝখানে ঢাবি ছাত্র স্বাধীন। দুজনে মিলে অনলাইন কোচিং তারপর দ্বন্দ্বে আলাদা। এর জেরে আসল ঘটনা বেরিয়ে আসছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ছবি সংগৃহীত
অধিভুক্ত কলেজে পড়া সত্ত্বেও ঢাবির পরিচয় দিয়ে শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন ইমরান এমন অভিযোগ উঠেছে। পেজে তার ভিডিও পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ঢাবির অভ্যন্তরীণ নানা সুযোগ-সুবিধার কথা উল্লেখ করে এবং ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় ভিডিও বানিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে তার দিকে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন তিনি।
ঢাবির পরিচয় দেওয়ার কথা অস্বীকার করে ইমরান দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি কখনো বলিনি আমি ঢাবিতে পড়ি। আমার কোনো ভিডিওতে এটি নেই। আমি শিক্ষার্থীদেরকে ভালো ভাবে পড়াই বলেই শিক্ষার্থীরা আমার কাছে আসে। আমি চক্রান্তের শিকার। তবে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীর পরিচয়ও তিনি দেননি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরেই নানা ধরনের ভিডিও তিনি করেন এ কথা স্বীকার করেছেন।
এসময় তিনি অভিযোগ করেন আরেকটি ভর্তি পরীক্ষার অনলাইন কোচিং প্ল্যাটফর্ম ‘প্রো উইথ স্বাধীন’ এর প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীন আহমেদের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, স্বাধীন এক সময় আমার বন্ধু ছিল আমরা একসাথে কাজ করেছি ক্লাস নিয়েছি। পরবর্তীতে আমি ওখান থেকে বের হয়ে আসি এবং নিজের পেজে ক্লাস নেওয়া শুরু করি। আমার দ্রুত জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে দেখেই স্বাধীন তার অনুগত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদেরকে দিয়ে এই বিষয়টি ছড়িয়ে দিয়েছেন। যাতে করে সে অনলাইন ভর্তি কোচিং প্ল্যাটফর্মগুলোতে সবার উপরে থাকতে পারে।
যদিও অভিযোগ সম্পূর্ণভাবে অস্বীকার করেছেন স্বাধীন আহমেদ। তার ভাষ্যমতে, তিনি ইমরানকে উলটা সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হয়ে যাওয়ায় তার উপরও চাপ আসছে জন্য তিনি আর কোনো কথা বলেননি।
বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা কোনো অনলাইন প্লাটফর্মের উপর বিশ্বাস রাখতে পারবে না বলে মনে করছেন ঢাবি শিক্ষার্থীরা। হিসাববিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী রাকিব বলেন, এভাবে চলতে থাকলে ঢাবি এবং সাত কলেজ একই জায়গায় অবস্থান করবে। ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা যেখানে ঢাবির ছাত্র ভেবে আকৃষ্ট হয় সেখানে তাদের এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে যারা মিথ্যা বলে প্রতারণা করছে তাদেরকে শাস্তির আওতায় না আনলে বিশ্ববিদ্যালটির আসল শিক্ষার্থীরা পরিচয় সংকটে পড়বে। পাশাপাশি ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের সাথে যে প্রতারণা করা হচ্ছে তারাও ভর্তি কোচিংয়ের উপর থেকে বিশ্বাস হারাবে। এতে করে যারা আসলেই উন্নত মানের পাঠদান দিয়ে থাকে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী তাদের ক্ষতি হবে।
ইমরানের পরিচয় গোপন করে অনলাইন পাঠদান ব্যবসা সম্পর্কিত বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ইমরানের অভিযোগের মাধ্যমে সামনে আসে ‘প্রো উইথ স্বাধীন’ নামে আরেকটি অনলাইন প্লাটফর্ম। জানা যায়, নানা সময় শিক্ষার্থীদের টাকা নিয়ে ক্লাস না করানো, মানসম্পন্ন ক্লাসের অভাব, ভালো শিক্ষকের অভাব, টাকা ফেরত না দেওয়াসহ কোর্সের অর্ধেক করিয়ে বাকি অর্ধেক না করানোর ঘটনাও ঘটিয়েছেন এই অনলাইন প্লাটফর্মের প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীন আহমেদ ও তার সহকর্মীরা।
স্বাধীন ঢাবির ব্যাংকিং এন্ড ইনসুরেন্স বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি কবি জসীম উদদীন হলের আবাসিক ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে পড়াকালীন সময়ের শুরু থেকেই নিজের বন্ধু এবং জুনিয়রদের নিয়ে চালু করেন এই ‘প্রো উইথ স্বাধীন’ নামক অনলাইন ভর্তি কোচিং প্ল্যাটফর্মটি।
'প্রো উইথ স্বাধীন' প্লাটফর্মটির প্রতারণার একাধিক স্ক্রিনশট এসেছে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে, সেখানে দেখা যায় এইচএসসি-২০২২ ব্যাচের ভর্তি পরীক্ষার সময় ৫০টি পরীক্ষার কথা বলে ৫০০ টাকা করে প্রায় ১৫০০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করান স্বাধীন আহমেদ। কিন্তু সর্বমোট ৩৩টি পরীক্ষা নিয়েই কোর্স বাতিল করে দেন তারা। আরেকটি স্ক্রিনশটে দেখা যায়, ২০২৩-২৪ সেশনের এক ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থী লিখেছেন, 'প্রো উইথ স্বাধীন' পুরাই একটা বাটপার-চিটার। আমিও ২৩-২৪ সেশনে ৩ হাজার টাকা দিয়ে ভর্তি হই কিন্তু উনার ক্লাসের অবস্থা পরীক্ষা নেওয়ার সিস্টেম পুরাই ফালতু। একটুও সময় দেয় না। ৮০% মিথ্যা কথা বলে। আমি প্রতিবাদ করছিলাম তারপর থেকে আমাকে মেইন প্রোফাইল থেকে ব্লক দিয়ে রেখেছে।
এভাবেই নানা ধরনের প্রতারণা কথা উঠে এসেছে 'প্রো উইথ স্বাধীন' নামক এই প্লাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা স্বাধীনের বিরুদ্ধে। এই প্লাটফর্মে একসময় ক্লাস নেওয়া এক শিক্ষার্থী বলেন, আমি যেহেতু সেখানে কাজ করছি তাই শিক্ষার্থীদেরকে আমি চিনি। স্বাধীনের বিরুদ্ধে এইচএসসি-২০২২ এর শিক্ষার্থীদের সাথে যে প্রতারণা অভিযোগ উঠেছে সেটি সত্য এবং তার একাধিক স্ক্রিনশটও আমার কাছে আছে। পাশাপাশি অন্যান্য যে অভিযোগগুলোর কথা বর্তমানে শোনা যাচ্ছে তারও কিছুটা সত্য। পরবর্তীতে এই প্লাটফর্ম থেকে আমি বের হয়ে এসেছি।
এইচএসসি-২০২২ এর ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার কোর্স নিয়ে একটু ঝামেলা হলেও পরবর্তী আর কোনো কোর্স নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি বলে জানান স্বাধীন আহমেদ। তিনি বলেন, ঈদ পরবর্তী সময়ে অনেক শিক্ষক চলে যাওয়ার কারণে ওইসময় সবগুলো পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এই অভিযোগটি সত্য কিন্তু বাঁকি যে অভিযোগগুলো আসছে সেগুলো কোনোটিই সত্য নয়।
এছাড়াও তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী ইমরান হোসেনকে দীর্ঘদিন কবি জসীম উদদীন হলের গণরুমে রেখেছিলেন স্বাধীন। এ বিষয়টি হলের নিশ্চিত করেছেন একই হলের আরেক শিক্ষার্থী যিনি দীর্ঘদিন স্বাধীনের সাথে কাজ করেছেন। কিন্তু বিষয়টি অস্বীকার করে স্বাধীন বলেন, ইমরান এখানে মাঝে মাঝে এসে থাকতো। যেহেতু আমাদের বাড়ি একই জেলায় তাই আগে থেকেই বন্ধুত্ব ছিল। এর বেশি কিছু না।
বছরে ৫০ লাখেরও বেশি টাকা ইনকাম করলেও সরকারকে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রকার ট্যাক্স দেয়নি স্বাধীন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, আয়ের হিসাবটি সত্য। আমরা কোম্পানি হিসেবে এ বছর নিবন্ধন করেছি। এ বছর জুলাই থেকেই সকল হিসাব ক্লিয়ার হবে।