ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
৫ ভাষার গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে নেই কোন সফটওয়্যার, বোর্ডই ভরসা
- ওমর হায়দার
- প্রকাশ: ১৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৩:২৪ PM , আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:৪০ PM
দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে প্রায়ই তাদের গবেষণাপ্রবন্ধ নিয়ে চৌর্যবৃত্তির (প্লেজিয়ারিজম) অভিযোগ উঠে। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানার বিরুদ্ধে পিএইচডি থিসিসে (অভিসন্দর্ভ) গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠলে ফের বিষয়টি আলোচনায় আসে। এতে শিক্ষা মহলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌর্যবৃত্তি ধরার সফটওয়্যার থাকলেও বেশিরভাগ ভাষা তা শনাক্ত করতে পারে না বলে জানা গেছে। তাই সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, গবেষণাপ্রবন্ধের চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর জন্য ব্যবহৃত প্রযুক্তির সাহায্য নেয়া হলে দেখা যাবে আরও অনেক শিক্ষক গবেষণায় জালিয়াতির দায়ে অভিযোগে অভিযুক্ত হবেন। এজন্য সব ভাষার গবেষণাপ্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তি ঠেকাতে প্রযুক্তির সাহায্য (সফটওয়্যার) নেয়ার দাবি তাদের।
জানা গেছে, শিক্ষকদের গবেষণায় চুরি ঠেকাতে সম্প্রতি বাংলা শনাক্ত করতে পারে, এমন সফটওয়্যার উদ্ভাবন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে সাতটি ভাষায় গবেষণা প্রবন্ধ লেখা হলেও পাঁচটি ভাষার গবেষণা চৌর্যবৃত্তি ধরার কোনো সফটওয়্যার নেই। ফারসি, উর্দু, পালি, আরবি ও সংস্কৃতি ভাষার গবেষণাকর্মে চৌর্যবৃত্তি ধরার নেই কোনো সফটওয়্যার।
আগে থেকে ইংরেজিতে লেখা গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি শনাক্তকরণে সহায়তার জন্য টারনিটিন সফটওয়্যার রয়েছে। ২০২২ সালে বাংলায় লিখা গবেষণার চৌর্যবৃত্তি শনাক্তকরণে dubd21 সফটওয়্যার তৈরি করা হয়। যদিও এই সফটওয়্যারটি পূর্ণাঙ্গ নয় বলে জানা গেছে। কিন্তু ফারসি, উর্দু, পালি, আরবি ও সংস্কৃতি ভাষার চৌর্যবৃত্তি ধরার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো নিজস্ব সফটওয়্যার নেই। আর্টিকেলগুলো চৌর্যবৃত্তি ধরার জন্য একমাত্র ভরসা মনোনীত এডিটরিয়াল বোর্ড। যেখানে বিভিন্ন অধ্যাপকেরা বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, প্রতিটি গবেষণা নিবন্ধ অনুমোদনের জন্য বোর্ড রয়েছে। তবে এ বোর্ডের কোনো কোনো সদস্য সেসব নিবন্ধ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ না করেই এ সংক্রান্ত আর্টিকেল প্রকাশের অনুমতি দেয়। ফলে সংশ্লিষ্ট ভাষার গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি থাকলেও তা প্রকাশ পায় না। এর মধ্যে ওই পাঁচটি ভাষা রয়েছে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্টিকেল প্রকাশ করতে হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে লেখা আহবান করে পরে তা সার্কুলার আকাবে প্রকাশ করে থাকে। তারপর জুরিবোর্ড থেকে সেই লেখার বিষয়বস্তু অনুমোদন পায়। সেখান থেকে ৫ সদস্যের এডিটরিয়াল বোর্ড সেটার রিভিউ করে। তারপর সেখান থেকে আর্টিকেল অনুমোদন পেলে সেটা জার্নালে প্রকাশিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়, উর্দু বিভাগে ২০২৩ এবং ২০২২ সালে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। তবে ২০২১ সালে দু’টি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। পালি এন্ড বুদ্ধিস্ট স্টাডিজ বিভাগে গত চার বছর ধরে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। সর্বশেষ ২০১৯ সালে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল।
আরবি বিভাগে ২০২৩ সালে কোনো গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। ২০২২ সালে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। সংস্কৃত বিভাগে গত তিন বছর ধরে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়নি। সর্বশেষ ২০২০ সালে তিনটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ২০২৩ সালে একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলা বিভাগে ২০২৩ সালে গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে চারটি।
উর্দু ভাষায় গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি ধরার সফটওয়্যার না থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে বিভাগটির চেয়ারম্যান গোলাম মাওলা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এটি বিশ্ববিদ্যালয় উদ্যোগ নিলে সম্ভব। তবে এ বিষয়ে আমরা উদ্যোগ নিচ্ছি। সামনে হয়ে যাবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সম্প্রতি বাংলায় চৌর্যবৃত্তি ধরার জন্য যে সফটওয়্যার তৈরি করেছে সেটা এখনও অপূর্ণাঙ্গ। ওটা পূর্ণাঙ্গভাবে তৈরি করার জন্য আমরা নির্দেশনা দিয়েছি।
উর্দু, ফারসি, সংস্কৃতসহ যে ভাষাগুলোর কথা বলা হচ্ছে, এ ভাষাগুলোর মধ্যে কয়েকটির গবেষণা চৌর্যবৃত্তি ধরার জন্য কোথাও সফটওয়্যারে নেই বলে তিনি দাবি করেন।
তবে যদি কোনো সফটওয়্যার পাওয়া যায় তাহলে সেটা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কাজ করবে। বিদশে যদি এই ভাষাগুলোর চৌর্যবৃত্তি ধরার জন্য কোনো সফটওয়্যার থাকে সেটি নিয়ে কাজ করবো, জানান অধ্যাপক ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল।
বিভিন্ন সময়ে গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগ
গত মে মাসে গবেষণা জালিয়াতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ড. রেবেকা সুলতানার বিরুদ্ধে প্লেজিয়ারিজম (গবেষণা জালিয়াতি) তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
২০২১ সালের ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সামিয়া রহমানকে পদাবনমন ঘটিয়ে সহকারী অধ্যাপক পদ দেয়। একই অপরাধে মারজানের দুই বছর পদোন্নতি রহিত করা হয়। সংগীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহসিনা আক্তার খানমের বিরুদ্ধেও গবেষণায় চুরির অভিযোগ উঠেছে।
২০২১ সালের ১৩ জুন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিভুক্ত জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা অ্যাকাডেমির (নায়েম) সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ইফফাত আরা নার্গিস সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন, সেই বইয়ে তার পড়া তিন থেকে চারটি বইয়ের বেশ কিছু অংশের হুবহু মিল খুঁজে পেয়েছেন।
গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক শিক্ষক আবুল মনসুর আহাম্মদ তার একটি গবেষণা নিবন্ধে অন্যের লেখা চুরি করেছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। ২০১৩ সালে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আবুল মনসুর আহাম্মদ সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদায়নের জন্য তার নিজের ১০টি গবেষণামূলক লেখা জমা দেন। এগুলোর একটিতে অনেকাংশ হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে একটি জাতীয় দৈনিকে প্রচারিত আরেকজন শিক্ষকের লেখা থেকে।
পিএইচডি থিসিসে জালিয়াতির আরেক ঘটনায় ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষক ওমর ফারুকের ডিগ্রি বাতিলের পাশাপাশি তাকে সহকারী অধ্যাপক থেকে প্রভাষক পদে নামিয়ে দেয়া হয়েছে।
গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে নীতিমালা
চলতি বছরের ২১ জানুয়ারি গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এতে গবেষণায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত সামঞ্জস্য (একটি উৎস থেকে সর্বোচ্চ ২ শতাংশ) শাস্তিযোগ্য নয়। এর বেশি মাত্রার সামঞ্জস্যের জন্য জরিমানা, পদাবনতি, ডিগ্রি বাতিল থেকে চাকরিচ্যুতি পর্যন্ত শাস্তির মুখে পড়তে হবে দায়ী ব্যক্তিদের। ‘দ্য রুলস ফর দ্য প্রিভেনশন অব প্লেইজারিজম’ শীর্ষক নীতিমালাটি তৈরি করা হয়।