ঢাবি শিক্ষার্থীদের গ্যাং কালচারে জড়ানোর নেপথ্যে ‘গেস্টরুম’ ও ‘বড়ভাই’
- টিডিসি রিপোর্ট
- প্রকাশ: ২৭ মার্চ ২০২৩, ১২:৪৯ AM , আপডেট: ২৭ মার্চ ২০২৩, ০৩:৫৩ AM
“ভর্তি হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে শুরুর দিকে সব ঠিকঠাক চলেছিল। তবে কিছুদিন পর এই গ্রুপের (প্রলয় গ্যাং) কয়েকজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আমার। ঠিক সে সময়ে হলের গেস্টরুম শেষে বড়ভাইয়েরা (পলিটিক্যাল) আমাদেরকে রাতে ক্যাম্পাসে বের হতে বলতো— সারারাত ক্যাম্পাস ঘুরতে বলতো। এর ফলে প্রলয় গ্যাংয়ের বন্ধুদের সাথে আমিও গভীর রাত পর্যন্ত ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি শুরু করি। আগে সিগারেটে আসক্ত থাকলেও এসময় বন্ধুরা আমাকে মাদকে আসক্ত করে ফেলে। টানা ৬ মাস আমি নিজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এই মাদক থেকে সরে আসার জন্য কিন্তু পারিনি। পরে আমি রাতে ক্যাম্পাসে ঘুরাঘুরি ছেড়ে দেই এবং এসব বন্ধুদের ত্যাগ করি। ধীরে ধীরে আমি মাদক ও প্রলয় গ্যাং থেকে সরে আসতে পেরেছি।”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ২০২০-২১ সেশনের এক শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসভিত্তিক ‘প্রলয় গ্যাংয়ের’ একজন প্রাক্তন সদস্য কিভাবে ওই গ্রুপে জড়িয়ে গিয়েছিলেন সেটি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান। গত শনিবার (২৫ মার্চ) সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রকে পেটান তার একদল সহপাঠী। এরপর আলোচনায় আসে এই গ্যাংয়ের।
স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে এসে শুরুতেই ‘রাজনৈতিক শিষ্টাচার’ শেখানোর নামে আবাসিক হলের গেস্টরুম কালচারে জন্ম নেয় অসংখ্য দুঃস্বপ্নরা। প্রথমবর্ষে ম্যানার শেখানোর নামে পলিটিক্যাল সিনিয়রদের (বড়ভাই হিসেবে পরিচিত) শাসনে নবীন শিক্ষার্থীদের ক্যাম্পাস চেনার জন্য রাতে ঘুরতে যেতে আদেশ দেওয়া হয়। বাধ্য হয়েই রাতের ঘুম বাদ দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীরা টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, কার্জন হল ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় আড্ডা দিতেন। এভাবে রাতে ঘুরে বেড়ানোর অভ্যাস গড়ে ওঠে। ঘুরতে ঘুরতে অন্য হলের সহপাঠীদের সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। প্রায়ই রাতে ক্যাম্পাসের সড়ক দিয়ে যাওয়া মিনি ট্রাক আটকে তাতে করে হাতিরঝিল, ধানমন্ডি লেকসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতেন। একপর্যায়ে সহপাঠীদের কেউ কেউ শুরু থেকেই মাদক সেবন, ছিনতাই-চাঁদাবাজিতে, র্যাগিংসহ নানান অপরাধে। এটি ভয়ানক গ্যাং কালচারের সাথে নিজেদের জড়িয়ে ফেলার শুরুর গল্প।
আরও পড়ুন: ঢাবি শিক্ষার্থীকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করল অপর হলের শিক্ষার্থীরা
সেই গল্পের স্রোত ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের (২০২০-২১ সেশন) হাত ধরে গড়ে উঠেছে ভয়ানক গ্যাং ‘প্রলয়’। ক্যাম্পাসে মারামারি, ছিনতাইয়ে জড়িতদের বেছে বেছে সেই গ্যাংয়ের সদস্য বানায়। তারা জড়িত হন মাদকের সঙ্গে, নেশার সঙ্গে। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিশু চত্বরের পাশে তাদের নিয়মিত নেশার স্থান। তারা সেই জায়গার নাম দিয়েছেন ‘নিকুম্ভিলা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ বুদ্ধিজীবী ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের তৃতীয় তলার রুমে তাদের গ্যাংয়ের আড্ডার জায়গা (কার্যালয়) বানিয়েছে। নিয়মিত সেখানে জড়ো হন গ্যাংয়ের সদস্যরা, ক্যাম্পাসে চলাফেরা করে একত্রে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সংঘবদ্ধ আড্ডা, গল্প ও ঘুরাঘুরির ছবিও পোস্ট করেন নিয়মিত।
গত শনিবার সন্ধ্যায় জসীমউদ্দিন হলের সামনে (হলপাড়া) একদল যুবক প্রকাশ্যে তাদেরই এক সহপাঠীকে পেটানোর ঘটনার নেপথ্যে সামনে আসে এই গ্যাংয়ের কিছু সদস্যদের নাম। যাদের বেধড়ক মারধরের শিকার হয়ে বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী যোবায়ের ইবনে হূমায়ুন।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রদের মারধরের পেছনে ক্যাম্পাসভিত্তিক ভয়ঙ্কর গ্যাং
ভুক্তভোগী এই ছাত্র বলেন, আমাকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে হুমকি দেওয়া হয় যে তুই কই আছিস বল। তখন আমি বললাম জিয়া হলের দিকে আছি। কিছুক্ষণের মধ্যে ৫০ থেকে ৬০ জন ছেলেপেলে এসে আমাকে বেদম প্রহার করতে থাকে। উপর্যপুরি কিল ঘুষি এবং ইট দিয়ে আঘাত করে। তারা সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী। ফিল্মি কায়দায় পেটানো হয় আমাকে।
জানা গেছে, এদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল, কবি জসীমউদ্দিন হল, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও বিজয় একাত্তর হলের মিলনস্থলে (হল চত্বর) ‘তুচ্ছ কারণে’ এই শিক্ষার্থীকে মেরে রক্তাক্ত করেন এ দলের সদস্যরা। মারধরের ঘটনার পর খোঁজ নিয়ে বেরিয়ে আসে এ গ্যাংয়ের নাম।
মারধরের শিকার এই ছাত্র আরও বলেন, কার্জন হলের সামনে অভিযুক্তরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় বাইক চালাচ্ছিল। সেটা দেখার পর আমি বাইক চালাতে নিষেধ করি, এসম একটু কথা কাটাকাটি হয়। কথা কাটাকাটি শেষে হল পাড়ায় আসলে অপরিচিত নাম্বার থেকে (সাহিল, গ্যাংয়ের সদস্য) ফোন করে জিয়াউর রহমান হলের তবারক আমার লোকেশন জিজ্ঞেস করে এবং দেখা করতে চায়। পরে আমি লোকেশন জানালে তারা (প্রত্যয় গ্যাং) সকলে আসে এবং কোন কথা ছাড়া মারধর করতে। শুরু করে, মারধরের ফলে আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে ক্ষত হয় এবং রক্ত ঝরে। পরে বন্ধুরা উদ্ধার করে মেডিকেলে ভর্তি করায়।
জুবায়ের আরও বলেন, জিয়া হলের তবারক, মুহসীন হলের অর্ণব ও টুরিজম হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সিফরাত সাহিল বেশি মারধর করে। তাদের চিনতে পেরেছি।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রকে মারধরের ঘটনায় গ্যাংয়ের দুই সদস্য আটক
জানা গেছে, প্রলয় গ্যাংয়ের নেতৃত্বে আছেন— শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের হেদায়েতুন নুর, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সৈয়দ নাসিফ ইমতিয়াজ, ইতিহাস বিভাগের বদরুজ্জামান সজীব, মার্কেটিং বিভাগের বিপ্লব হাসান জয় ও মোহাম্মদ শোভন, প্রিন্টিং এন্ড পাবলিকেশন বিভাগের শাহ আলম, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাদমান তাওহিদ বর্ষণ, মাস্টারদা সূর্যসেন হলের তৌসিফ তাহমিদ অর্পন ও নাজমুল হোসাইন, কবি জসীমউদ্দিন হল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তাহমিদ ইকবাল মিরাজ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবু রায়হান, জগন্নাথ হলের প্রত্যয় সাহা, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ও গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র মাহিন মুনাওয়ার, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল ও শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের তবারক, টুরিজম এ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজেমেন্টের সিফরাত সাহিল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও মনোবিজ্ঞান বিভাগের অর্ণব খান। এরা সকলেই ছাত্রলীগের হল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রের নাকে-মুখে অনবরত স্টাম্পের আঘাত গ্যাংয়ের সদস্যদের
এরমধ্যে নাজমুল হোসাইন, তৌসিফ তাহমিদ অর্পন ও মাহিন মুনাওয়ার ছাত্রলীগের হল শাখার পদে রয়েছেন। নাজমুল ও তৌসিফ মাস্টারদা সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক। আর মাহিন শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক।
গ্যাং কালচারে কিভাবে জড়ালেন শিক্ষার্থীরা?
অনুসন্ধানে ওঠে এসেছে এই প্রলয়ের শুরুর ইতিহাস। জানা গেছে, গত বছরের শুরুর দিকে হলের গেস্টরুমে কিছু সিনিয়র (যারা পূর্বে এসবের সাথে যুক্ত ছিলেন এমন) প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের রাতের বেলা ক্যাম্পাসে শোডাউন দেওয়ানো, বহিরাগতদের উচ্ছেদ করতে পাঠাতো। এছাড়া এসব সিনিয়ররা তখন কোন ঝামেলায় জড়ালে সেসব প্রতিরোধ করতেও ডাকা হতো এই নবীন শিক্ষার্থীদের। সেসব ঝামেলা বা বহিরাগত উচ্ছেদে যারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো তাদের বেশ উচ্ছসিত প্রশংসা করা হতো সকলের সামনেই।
এসবে উদ্ভুদ্ধ হয়ে একসময় প্রথম বর্ষের অতি উৎসাহী শিক্ষার্থীরা ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল আকিবের হাত ধরে শতাধিক শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলে যার নাম ‘বণিক’। এই ‘বণিক’ গ্রুপের সদস্যদের কাজ ছিলো ক্যাম্পাসে র্যাগিং দেওয়া, ক্যাম্পাস থেকে বহিরাগত উচ্ছেদ করাসহ বিভিন্ন সময় ঝামেলা বাধলে সেটার সমাধানে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ করা। কিছুদিন তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ক্যাম্পাসে ঝামেলার সৃষ্টি, সেটার সমাধানে মারধরের পথ বেছে নেয়া, বহিরাগত উচ্ছেদের নামে মারধর করে।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রকে মারধর, প্রলয় গ্যাংয়ের ১৯ সদস্যদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ
কিন্তু এতেও সন্তুষ্টু ছিলেন না গ্রুপের বিশেষ কিছু সদস্যরা। যারা নিয়মিত মদ, গাঁজা, ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদক গ্রহণ করতো তাদের প্রয়োজন ছিলো আরো বেশি ক্ষমতা ও টাকা। ফলে তারা জসীমউদ্দিন হলের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ ইব্রাহিমের হাত ধরে মে মাসের শুরুর দিকে আরেকটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খোলে যার নাম ‘প্রলয়’। এই প্রলয় গ্রুপের সদস্যরা ছিলো আরো উচ্ছৃঙ্খল, অতি উৎসাহী, মাদকাসক্ত।
তারা মাদকের অর্থের যোগান দিতে শহীদ মিনার, ফুলার রোড ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ‘ঠেক দিতো’। এই ঠেক দেয়ার অর্থ হলো র্যাগিং বা বহিরাগতের উচ্ছেদের সময় ভয় দেখিয়ে মানিব্যাগ, টাকা বা মোবাইল জোরপূর্বক কেড়ে নেওয়া। পরে সেই টাকা দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মাদক কারবারির মূল হোতা পারুলী ও মালতীর সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাদক গ্রহণ ও কারবারির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে যায়। একটি বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, পারুলী ও মালতীকে ক্ষমতাসীন ছাত্রলীগের নামে শেল্টার দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে বিনা টাকায় মাদকও নেয় এই গ্রুপের সদস্যরা।
আরও পড়ুন: প্রলয় গ্যাংয়ের নির্যাতনে ছিঁড়ে গেছে ঢাবি ছাত্রের পায়ের লিগামেন্ট
গত শনিবারের ঘটনার পর এই ‘বণিক’ গ্রুপ থেকে প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল্লাহ আল আকিবসহ অধিকাংশ শিক্ষার্থী লিভ নেয়ার প্রমাণ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। কিন্তু প্রলয় গ্রুপের কার্যকলাপ, তথ্য আদান-প্রদান এখনো চলমান রয়েছে এবং এখনো তারা সংঘবদ্ধ রয়েছে বলেও সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।
প্রলয় গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের একটি বিবরণ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের কাছে এসেছে। যাদের অধিকাংশই শনিবারের মারামারিতে যুক্ত ছিলো বলে একধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই গ্যাংয়ের বর্তমানে নেতৃত্বে রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হল এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের তবারক, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল এবং গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ছাত্র মাহিন মুনাওয়ার। তবে প্রতিষ্ঠাকালে এই গ্রুপের সভাপতি ছিলো রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ ইব্রাহিম এবং সাধারণ সম্পাদক ছিলো যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগের হাসান বায়েজিদ। এছাড়াও আইন বিভাগের দীন ইসলাম, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্টের সিফরাত সাহিল, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল ও দর্শন বিভাগের অর্ণব খান, আবু রায়হান, শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের সমাজকল্যাণ ইনস্টিটিটিউটের হেদায়েতুন নুর, তথ্য বিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের সাদমান তাওহিদ বর্ষণ, আব্দুল্লাহ আল আরিফ, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের সৈয়দ নাসিফ ইমতিয়াজ, ইতিহাস বিভাগের বদরুজ্জামান সজীব, মার্কেটিং বিভাগের বিপ্লব হাসান জয় ও মোহাম্মদ শোভন, অঙ্কন এবং মুদ্রণ বিভাগের শাহ আলম, মাস্টারদা সূর্য সেন হলের তৌসিফ তাহমিদ অর্পণ ও নাজমুল হোসাইন, সূর্যসেন হলের আন্তর্জাতিক ব্যবসা বিভাগের কবি জসীম উদ্দীন হল ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সাদ, ফিন্যান্স বিভাগের মোশাররফ হোসেন, চাইনিজ ভাষা বিভাগের ফেরদৌস আলম ইমন, ফার্সি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগের তাহমিদ ইকবাল মিরাজ, হাজী মুহম্মদ মুহসীন হলের আবু রায়হান ও জগন্নাথ হলের প্রত্যয় সাহাসহ নাম না জানা অনেকে। আরও কিছু সদস্যদের নাম উঠে এসেছে যারা পূর্বে প্রলয়ের সদস্য থাকলেও এখন এই গ্রুপের হয়ে কাজ করে না।
আরও পড়ুন: ঢাবি ছাত্রদের মারধরের পেছনে ক্যাম্পাসভিত্তিক ভয়ঙ্কর গ্যাং
এদিকে প্রলয় গ্যাংয়ের নেতৃত্ব দেয়া শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়নের তবারক তার উচ্ছৃঙ্খল কর্মকাণ্ডের কারণে প্রথম বর্ষেই ইমিডিয়েট বড়ভাইয়েরা তাকে হল থেকে বের করে দেয়। তারপর তিনি ও তার বন্ধুরা শেখ রাসেল আবাসিক ভবনে একটি রুম নিয়ে থাকত। সে তখন শহীদ মিনার ও উদ্যান এলাকায় ছিনতাই চাঁদাবাজি, মেয়েদের যৌন হয়রানি করা শুরু করে। তিনি ছিনতাইয়ের টাকা দিয়ে পূরণ করত তার সকল শখ-আহ্লাদ ও মাদক গ্রহণ। তিনি তারপর তার ঘনিষ্ঠ তিন বন্ধু মাহিন মুনাওয়ার, আব্দুল্লাহ আল আরিফ ও ফারহান লাবিবকে নিয়ে শুরু করে পানির ব্যবসা। একটি অখ্যাত পানির কোম্পানির পানি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশে পাশের দোকানে সাপ্লাই দেওয়ার জন্য দোকানিদের হুমকি দেওয়া শুরু করে।
নাম না প্রকাশের শর্তে প্রলয় গ্রুপের প্রতিষ্ঠাকালীন কিন্তু বর্তমানে নিষ্ক্রিয় এক সদস্য দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমিও একসময় অতি উৎসাহী ছিলাম। আমি নিয়মিত সিগারেট খেলেও কখনো মাদকে জড়াইনি। আমি শুধু বহিরাগতের উচ্ছেদের ব্যপারে বেশি আগ্রহী ছিলাম। কিন্তু একসময় দেখলাম তারা (উপরে বর্ণিত শিক্ষার্থীরা) র্যাগিংয়ের ফাঁকে ভুক্তভোগীদের টাকা, মোবাইল কেড়ে নিতো।
তিনি আরও বলেন, তারা নিজেদের ইচ্ছা প্রকাশ করতে, নিজেদের অনেক ‘বড় কিছু’ হিসেবে অন্যদের সামনে প্রকাশ করতে ইচ্ছাকৃতভাবে ঝামেলার সৃষ্টি করতো, অন্যদের মারধর করাকে নিজেদের বড়ত্বের প্রকাশ বলে মনে করতো। ধীরে ধীরে তারা উদ্যান মাদক সিন্ডিকেটে এর সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে৷ তখন তারা মাদক কারবারিদের রাজনৈতিক শেল্টার দেয়ার নামে বিনা টাকায় মাদক নিতো। এজন্য তাদেরকে দিনে ৪/৫ বার উদ্যানে যাওয়া-আসা করতে দেখা যেতো।
প্রলয়ের এক সক্রিয় সদস্য বলেন, আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, আমরা কি টাকা দিয়ে মাদক কিনবো! আমরা কি বোকা নাকি! তারা আমাদের ট্যাক্স দিয়েই এখানে ব্যবসা করে। তাছাড়া আমরা 'ঠেক দিয়ে' টাকা নিয়ে নিজেদের বিভিন্ন ইচ্ছে পূর্ণ করি। মাঝেমাঝে ইচ্ছাকৃতভাবে গায়ে ধাক্কা দিয়ে নিজের ফোন নিচে ফেলে দিতাম যা আগেই ভাঙা থাকতো। পরে মোবাইল সার্ভিসের নাম করে টাকা আদায় করি। পরে এসব টাকা নিজেদের মাঝে বণ্টন করে মাদক গ্রহণ করি। মাঝেমধ্যে টাকা দিয়ে আমরা মাদক নিলেও অধিকাংশ সময় আমরা ট্যাক্স হিসেবে বিনা টাকায় মাদক নিয়ে থাকি।
তবে তিনি গতকালের ঘটনায় জড়িত থাকাকে অস্বীকার করে বলেন, আমি এর আগে কিছু ঝামেলায় জড়ালেও গতকালের ঘটনায় জড়িত নই। কাল আমি বিকেল থেকেই ক্যাম্পাসের বাইরে ছিলাম।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি সূত্র জানায়, প্রত্যেক হল থেকে বাছাই করে শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়। তবে শর্ত থাকে— মারামরি করতে হবে, নেশা করতে হবে, বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ থেকে ক্যাম্পাসে বাইক নিয়ে ঘুরাঘুরি করার মন মানসিকতা থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হলে হলে ছাত্রলীগের ‘গেস্টরুম আদালত’
গ্যাং থেকে বের হয়ে আসা এমন একজনের নাম তারেক (ছদ্মনাম)। গ্যাং থেকে তার বের হয়ে আসার বিষয়ে তিনি বলেন, প্রথম বর্ষের শুরুতে একাধিক গ্রুপ থাকে, ঘোরাঘুরি করার জন্য কিংবা রাতে আড্ডা দেওয়ার জন্য। আমাদের গ্রুপের নাম ছিল 'প্রলয়'। প্রথমে আমরা সবাই মিলে রাতে আড্ডা দিতাম শহীদ মিনারে, টিএসসিতে কিংবা কার্জনে। আড্ডার পরে শুরু হয় র্যাগ দেওয়া, শহীদ মিনারে রাতে কাপল কাউকে দেখলে র্যাগ দেওয়া শুরু হয়। পরে আস্তে আস্তে গাঁজা খাওয়া শুরু হয়। পরে মদ কিংবা অন্যান্য নেশাদ্রব্যের সঙ্গে। আমি কখনো এসব খাইনি, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে। তবে এখানে এসে সেবন করা শুরু করি, বিষয়টি আমার এলাকার এক বড় ভাই আমার পরিবারকে অবহিত কর। পরে একদিন মা ফোন দিয়ে বলে, বাবা! তোরে পড়ালেখা করার জন্য ঢাকায় পাঠিয়েছি, মদ-গাঁজা খাওয়ার জন্য না। এসব থেকে সরে এসে পড়াশোনা কর, সরকারি চাকরি কর। মা আমার কাছ থেকে ওয়াদা (অঙ্গীকার) নেয় যে ‘এসবে জড়াবো না’। মাকে কথা দেওয়ার পর আর জড়াইনি। আস্তে আস্তে সেই গ্যাংয়ের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।
এ বিষয়ে রবিবার (২৬ মার্চ) ঢাবি প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রব্বানী দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, সামগ্রিক বিষয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দেখছে। যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে দেবো না।
তিনি আরও বলেন, এই গ্যাং কালচার বন্ধ করার জন্য যেসব উদ্যোগ নেওয়া দরকার, সেটাই আমরা নিবো। ইতোমধ্যে খবর পেলাম এদের মধ্যে একজন শাস্তিপ্রাপ্ত আছে। অপরাধ প্রমাণিত হলে তাদেরকে প্রয়োজনে আইনের কাছে তুলে দিব।
আরও পড়ুন: গেস্টরুম-গণরুমে নির্যাতনের ভয়, ঢাবি ছেড়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে
ঢাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, প্রশাসনকে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়ার আহবান জানাই। পাশাপাশি যথোপযুক্ত প্রমাণ সাপেক্ষে সাংগাঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে, ছাত্রলীগ অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ভূমিকা রাখবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।