ঢাবিতে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস হাজার হাজার শিক্ষার্থীর
- খালিদ হাসান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:২১ AM , আপডেট: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১০:০৩ AM
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) পূর্ণাঙ্গ আবাসিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে প্রতিষ্ঠার শতবর্ষেও শিক্ষার্থীদের শতভাগ মানসম্মত আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয়টি। শিক্ষার গুণগতমান নিয়েও নিয়মিতই প্রশ্নের মুখে পড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। যেসব শিক্ষার্থীর আবাসনের ব্যবস্থা হয়েছে, তাঁদেরও থাকতে হচ্ছে জীর্ন আবাসিক হল। এসব হলে অনেক ভবনেই লোনা ধরা দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল। ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা। এসব সংস্কারে বড় কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে মৃত্যু ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী।
জানা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ আবাসিক হল তৈরি হয়েছে স্বাধীনতার আগে। ফলে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেও এসব ভবন ধ্বসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর বিষয়টি ফের আলোচনা শুরু হয়েছে। হলগুলো বহু বছরের পুরোনো। বিগত কয়েক বছর ধরে জায়গায় জায়গায় ফাটলের সৃষ্টি হয়েছে। প্লাস্টার খসে পড়ছে।
বেশ কিছু ভবনের রুমে, করিডোরে বা সিঁড়িতে ফাটলের ফলে রড বের হয়ে থাকতেও দেখা গেছে। এগুলো শিক্ষার্থীদের মনে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। মাঝে মাঝে সংস্কারের নামে সিমেন্টের প্রলেপের ওপর রঙ দিয়ে ঢেকে দিলেও এতে ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।
১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর রাতে দেশের শীর্ষ বিদ্যাপীঠের জগন্নাথ হল মিলনায়তনের ছাদ ধসে ছাত্র-কর্মচারীসহ ৩৯ জন প্রাণ হারান। প্রতি বছর দিনটি শোক দিবস হিসেবে পালন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ২০১৭ সালের ১ এপ্রিল সূর্যসেন হলের শহীদ এইচএম ইব্রাহীম সেলিম মিলনায়তনের রেলিং ধসে শিক্ষার্থীসহ দুইজন আহত হন। কিছুদিন আগে মুহসীন হলের টিভি রুমের ছাদের অংশ ধসে পড়ে। এসব নিয়ে ভুলে থাকলেও বিভিন্ন ঘটনা শিক্ষার্থীদের মনে নাড়া দিয়ে উঠছে প্রতিনিয়তই।
রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনেও ছাদের প্লাস্টার খসে পড়ছে প্রতিনিয়তই। এভাবে চলতে থাকলে ঘটতে পারে বড় দূর্ঘটনা। আবার শক্তিশালী কোনো ভূমিকম্প হানা দিলে প্রাণ হারাবে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠের অসংখ্য শিক্ষার্থী।
সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৯২২ কোটি ৪৮ লাখ টাকার বাজেট বার্ষিক সিনেট অধিবেশনে উপস্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। এত বিশাল বাজেট হলেও হল সংস্কারে দেয়া হচ্ছে খুবই নগন্য পরিমাণ অর্থ। নতুন হল তৈরি কিংবা পুরোনো ভবনের সংস্কারে নেই বড় কোনো উদ্যোগ।
এদিকে বেশ কিছু নতুন ভবন তৈরি করা হলেও আবাসন সংকট কাটেনি এ শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে। আবার এদিকে নতুন ভবন নির্মাণে দেখা যাচ্ছে কচ্ছপ গতি। এজন্য শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট থাকায় জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ ভবনেই শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দিচ্ছে হল প্রশাসন। নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্রলীগ। ফলে ঝুঁকির মাঝেই রাত কাটাচ্ছেন অধিকাংশ হলের হাজারী শিক্ষার্থী। বড় কোন ভূমিকম্প বাংলাদেশে আঘাত হানলে অসংখ্য দেশের ব্যপক ক্ষতির সঙ্গে সঙ্গে ঢাবির অসংখ্য ভবনের ব্যপক ক্ষতি হয়ে প্রাণহানির সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে দুটি দেশের এখন পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, যা পুরো বিশ্বকে নাড়া দিয়েছে। এত উন্নত একটি দেশে ভূমিকম্পে এমন ক্ষতি হয়েছে। সবার আশঙ্কা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো ভবন যেগুলো তৈরি হয়েছে অন্তত ৬০ বছর আগে, সেগুলোর কি অবস্থা হবে? বাংলাদেশের ভূতত্ত্ববিদিগরা সতর্ক করে দিয়েছেন, বাংলাদেশ উচ্চ ভূমিকম্পপ্রবণ অবস্থায় রয়েছে। যেকোনো সময় ঘটতে পারে ভূমিকম্পের মত বড় কোনো প্রাকৃতিক দূর্ঘটনা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহম্মদ মুহসীন হল, মাস্টারদা সূর্য সেন হল, সার্জেন্ট জহুরুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক মুসলিম হল, শহীদুল্লাহ হল ও জগন্নাথ হলের বেশ কয়েকটি ভবন এবং জিয়া হলসহ প্রায় প্রতিটি হল ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবন, কুয়েত মৈত্রী হলের মনোয়ারা ভবনও বেশ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবাসিক শিক্ষার্থীরা। আগেেই এসব হলের কিছু ভবনকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিনে দেখা যায়, জহুরুল হক হলের করিডোর এবং পুরোনো ভবনগুলোর ছাদের বিভিন্ন অংশ ধসে পড়ছে। হলের বর্ধিত ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিভিন্ন পিলারে দেখা গিয়েছে ফাটল। বৃষ্টি হলে দেয়াল ও ছাদ চুঁইয়ে পানি পড়ে। হলের টিনশেড থেকে মূল ভবনে আসার করিডোরের ছাদের অসংখ্য স্থানে আস্তরণ খসে পড়ছে।
সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের মূল ভবন থেকে ক্যান্টিনে যাওয়ার করিডোরটির ছাদের আস্তরণ পুরোটাই খসে পড়েছে। করিডোরের পিলারগুলো ফেটে গেছে, বিভিন্ন রুমে দেয়ালের আস্তরণ খসে পড়ছে। এজন্য দু’বছর ধরে এ হলে নতুন শিক্ষার্থীর আবাসন বন্ধ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কয়েক বছরের মাঝে নতুন ভবন তৈরির মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
মুহসীন হলের রিডিং রুম এবং ইনডোর খেলা ঘরের অবস্থা বেশ করুণ। খেলাঘরটি বেশ কয়েক বছর আগে প্রবেশ নিষিদ্ধ করলেও তোয়াক্কা করছেন না সাধারণ শিক্ষার্থীরা। নিষেধ অমান্য করে তারা ক্যারম, টেবিল টেনিসসহ বিভিন্ন ইনডোর খেলায় মেতে উঠছে সময়-অসময়ে। এছাড়া হলের দুইটি রিডিং রুমের অবস্থা বেশ খারাপ। ওপরের প্লাস্টার খসে পড়েছে, বিভিন্ন স্থানে রড় বের হয়ে আছে। এরই নিচে বসে প্রতিদিন শতাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে দিনরাত।
সূর্যসেন হলের অডিটোরিয়াম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করে। হলটি বেশ কিছুদিন আগে সংস্কার পুরোনো এ হলটিতে স্বস্তি নেই সাধারণ শিক্ষার্থীদের। মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের ওপরের তলা বেশ নাজুক। ছাদের দিকে ফাটলসহ বিভিন্ন জায়গায় বেরিয়ে গেছে রডের একাংশ। শিক্ষার্থীদের দাবি, পুরো হলের মান দূর্বল এবং খুব ঝুঁকিপূর্ণ।
আরো পড়ুন: ক্যাম্পাস এক কলেজে, লাইব্রেরি আরেক কলেজে— ২ কি.মি. দূরত্বে পরিবহন সেবা দাবি
জগন্নাথ হলের পুরোনো জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ভবনের ভবনের অবস্থাও নড়বড়ে। এ ভবনের তৃতীয় তলার সিঁড়ির উপরের ছাদে বেশ বড় ফাটলের সাথে প্লাস্টার খসে রড বেরিয়ে গেছে। বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের মনোয়ারা ভবনের বেশ কিছু স্থানে ফাটল ও প্লাস্টার খসে রড বের হয়ে থাকতে দেখা গেছে। হলের এ ভবনটিতে শিক্ষার্থীদের বসবাস নিষিদ্ধ করা হলেও হল প্রশাসন ও ছাত্রলীগ সেখানে শিক্ষার্থীদের সিট বরাদ্দ দিচ্ছে। এছাড়া রোকেয়া হলের বর্ধিত ভবনের ছাদের প্লাস্টার নিয়মিত খসে পড়ছে বলে জানিয়েছেন হলে অবস্থানরত একাধিক শিক্ষার্থী।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হলের শিক্ষার্থী বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘হলগুলোর পুরনো ভবনে লোনা ধরা দেয়ালে দেখা দিয়েছে ফাটল, মাঝেমধ্যে ছাদ থেকে খসে পড়ছে পলেস্তারা, যা শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। আবার বিভিন্ন হলের ছাদের রড বের হয়ে আছে। এদিকে তুরস্কে ভয়াবহ ভূমিকম্পে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্য সতর্কবার্তা। একটি দুর্ঘটনা ঘটে গেলে কারো কিছু করার থাকবে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে সচেতন হওয়া উচিত।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কুয়েত মৈত্রী হলের আবাসিক এক শিক্ষার্থী বলেন, মৈত্রী হলের মনোয়ারা ভবনটি অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে প্রশাসনিকভাবে সিট বরাদ্দ নিষিদ্ধ হলেও মানছেন না ছাত্রলীগের নেত্রীরা। তারা এ ভবনেও শিক্ষার্থীদের সিট দিচ্ছেন। তাছাড়া এখানে আবাসিক শিক্ষকদের আলাদা রুম রয়েছে। তারপরও প্রায় ৩০০ শিক্ষার্থী রাখা হয়েছে। যেকোনো সময় বড় কোনো দূর্ঘটনা বা ভূমিকম্প হলে অনেক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ‘আমরা দেখেছি, আমাদের প্রতিনিধি দল দেখেছে। আমাদের আবাসিক হলগুলোর জরাজীর্ণ অবস্থা। দিনদিন এসব আরো খারাপ পরিস্থিতিতে যাচ্ছে। আমরা অনেক বছর যাবৎ এসব সংস্কার এবং নতুন হল নির্মাণের জন্য ওপর মহলে চিঠি দিয়েছি। তাদের অনেক কড়া ভাষায় বার্তা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসে আমরা অনেকগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছিলাম। কিন্তু প্রশাসনিক জটিলতায় সবগুলো মুখ থুবড়ে আছে। শুধু ভূমিকম্প নয়, যেকোনো সময় এমনিতেই ঘটতে পারে বড় দুর্ঘটনা। আমি প্রশাসনের কাছে চিঠিতে বলে দিয়েছি, কোনো দুর্ঘটনা হলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর দায় নেবে না। সরকারকেই এ দায় মাথায় নিতে হবে।’
উল্লেখ্য, সলিমুল্লাহ মুসলিম, ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও জগন্নাথ হল বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে ১৯২১ সালে নির্মিত। বেগম রোকেয়া হল ১৯৩৮ সালে, ফজলুল হক মুসলিম হল ১৯৪০ সালে, জহুরুল হক হল ১৯৫৭ সালে, সূর্যসেন হল ১৯৬৪ সালে, মুহসীন হল ১৯৬৭ সালে এবং বাকিগুলো স্বাধীনতার পরে বিভিন্ন সময় তৈরি করা হয়েছে। এরপর হলগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।