একীভূত হওয়া দুই কৃষ্ণগহবরের সেরা দৃশ্য দেখলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা 

দুটি কৃষ্ণগহবরের একীভূত হওয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার ও বিস্তারিত দৃশ্য
দুটি কৃষ্ণগহবরের একীভূত হওয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার ও বিস্তারিত দৃশ্য  © রয়টার্স

জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি দুটি কৃষ্ণগহবরের একীভূত হওয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার ও বিস্তারিত দৃশ্য দেখতে পেয়েছেন। এটি কৃষ্ণগহবরের আচরণসেহ অন্যান্য বিষয় সম্পর্কে অগ্রগামী বিজ্ঞানীদের তত্ত্বকে আরও অধিক জোরদার করছে। গত ৯ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থা (এলআইজিও) এ ছবি প্রকাশ করেছে। এর মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, দুটি কৃষ্ণগহবরের মিলন একটি তাৎপর্যপূর্ণ ও মহাকাব্যিক ঘটনা, যা মহাকাশ, সময় এবং মাধ্যাকর্ষণের সবচেয়ে চরম ও রহস্যময় রূপকে প্রকাশ করে। 

রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত এই ধরনের একটি ঘটনার সবচেয়ে পরিষ্কার ও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ পেয়েছেন, যেখানে মহাকাশ-সময়ে তৈরি হওয়া সূক্ষ্ম কম্পন, অর্থাৎ মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করা হয়েছে। যা বিখ্যাত পদার্থবিদ আলবার্ট আইনস্টাইন এবং স্টিফেন হকিং-এর তত্ত্বগুলোকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে।

এই সংঘর্ষটি ঘটেছিল পৃথিবী থেকে ১.৩ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে, আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির বাইরের একটি গ্যালাক্সিতে। এতে জড়িত ছিল দুটি কৃষ্ণগহবর, একটি ছিল সূর্যের ভরের প্রায় ৩৪ গুণ এবং অপরটি ছিল প্রায় ৩২ গুণ। তারা পরস্পরের চারপাশে প্রায় আলোর গতিতে ঘুরতে ঘুরতে মাত্র এক সেকেন্ডের ভগ্নাংশে একীভূত হয়ে যায় এবং সৃষ্টি করে একটি বৃহৎ কৃষ্ণগহবরের। এর ভর ছিল প্রায় ৬৩ গুণ সূর্যের ভর এবং এটি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০০ বার ঘূর্ণন করছিল।

এক আলোকবর্ষ মানে হলো, এক বছরে আলো যে পরিমাণ পথ অতিক্রম করে, তা প্রায় ৫.৯ ট্রিলিয়ন মাইল (৯.৫ ট্রিলিয়ন কিলোমিটার)। কৃষ্ণগহবর হলো অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ মহাজাগতিক বস্তু, যার মাধ্যাকর্ষণ শক্তি এতটাই প্রবল যে, আলো পর্যন্ত সেখান থেকে বের হতে পারে না।

এ একীভূতকরণের ফলে বিপুল পরিমাণ শক্তি বিকিরন হয়, যা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ (gravitational waves) হিসেবে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ শক্তির পরিমাণ এত বেশি যে, তা তিনটি সূর্য-আকারের তারাকে ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে ফেলার সমতুল্য। তরঙ্গগুলো শনাক্ত করা হয় গত ১৪ জানুয়ারি। ওয়াশিংটটের হ্যানফোর্ড এবং লুইসিয়ানার লিভিংস্টনের গবেষণার স্থানে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন পরিচালিত লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি বা এলআইজিও-এর অংশ। 

পর্যবেক্ষণগুলো এসেছে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রথম ঐতিহাসিক শনাক্তকরণের প্রায় এক দশক পর, যা ঘটেছিল অনুরূপ এক কৃষ্ণগহবরের একীভূবনের ফলে। ২০১৫ সালের পর থেকে প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে এই একীভূবন পূর্ববর্তী ঘটনার চেয়ে চার গুণ বেশি স্পষ্টতা (resolution) নিয়ে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়েছে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলো জলাশয়ের ঢেউয়ের মতো উৎস থেকে বাইরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এ ক্ষেত্রে, সেই ‘জলাশয়’ হলো মহাকাশ-সময় (space-time) — একটি চার-মাত্রিক অবকাঠামো, যা স্থানের তিনটি মাত্রা (উচ্চতা, প্রস্থ ও দৈর্ঘ্য) এবং সময়ের একমাত্রাকে একত্রিত করে গঠিত।

‘আলবার্ট আইনস্টাইনের কল্যাণে আমরা জানি যে, স্থান এবং সময় একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং একটি একক সত্তা, যার নাম মহাকাশ-সময় (space-time)’, বলেছেন কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও ফ্ল্যাটআয়রন ইনস্টিটিউটের একজন জ্যোতির্পদার্থবিদ ম্যাক্সিমিলিয়ানো ইসি। বুধবার ফিজিক্যাল রিভিউ লেটারস জার্নালে প্রকাশিত গবেষণার অন্যতম প্রধান নেতৃত্বদানকারী তিনি।

তিনি বলেন, ‘উদাহরণস্বরূপ, এটি প্রকাশ পায় যে, আপনি কোথায় আছেন তার ওপর নির্ভর করে সময়ের গতি ভিন্ন হয়’। তিনি ব্যাখ্যা করেন, ‘একটি ভারী বস্তুর কাছাকাছি,যেমন কৃষ্ণগহবরের সময় দূরবর্তী ব্যক্তির তুলনায় আরও ধীরে ধীরে প্রবাহিত হয়। ফলে, যদি কেউ কৃষ্ণগহবরের খুব কাছে থাকে, তাহলে তার ধীরে বয়স বাড়াবে, অর্থাৎ কম সময়ে বয়স্ক হবে।’  

গবেষকরা শনাক্ত করা মহাকর্ষীয় তরঙ্গগুলোর কম্পাংক (frequency) বিশ্লেষণ করে একীভবনের ঠিক আগে ও পরে কৃষ্ণগহবরের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করেছেন। যদিও এই কম্পাংকগুলো ধ্বনিতরঙ্গ ছিল না, তবুও গবেষকরা এগুলিকে ঘণ্টা বাজানোর সাথে তুলনা করেছেন। ইসি বলেন, ‘এটা ঠিক যেন এমন যে, একটি ঘণ্টায় আঘাত করার পর তার যে ধ্বনি শোনা যায়, তা শুনে বোঝার চেষ্টা করা ঘণ্টাটি কী দিয়ে তৈরি।’

আরও পড়ুন: স্লো ইন্টারনেট, কয়েকটা সাধারণ কাজেই বাড়তে পারে মোবাইল নেটের গতি

উদাহরণস্বরূপ, একটি বড় লোহার ঘণ্টা যে শব্দ করে, তা একটি ছোট অ্যালুমিনিয়ামের ঘণ্টার শব্দের থেকে আলাদা। গবেষকরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গের কম্পাংকের ভিত্তিতে যা জানতে পেরেছেন, তা কৃষ্ণগহবর সম্পর্কিত বিজ্ঞানের একটি মৌলিক নীতির প্রমাণ হিসেবে কাজ করেছে, যা প্রস্তাব করেছিলেন স্টিফেন হকিং, যিনি ২০১৮ সালে মৃত্যুবরণ করেন।

হকিং অনুমান করেছিলেন যে কৃষ্ণগহবরের মোট পৃষ্ঠতল ক্ষেত্র — বিশেষ করে ইভেন্ট হরাইজনের (ঘটনা দিগন্তের) পৃষ্ঠতল ক্ষেত্র, যা সেই সীমা যেখানে থেকে কিছুই পালাতে পারে না, কখনই কমতে পারে না। তার অনুমান অনুযায়ী, একীভবনের ফলে তৈরি হওয়া একক ব্ল্যাক হোলের পৃষ্ঠতল ক্ষেত্র অবশ্যই দুইটি কৃষ্ণগহবরের সম্মিলিত পৃষ্ঠতল ক্ষেত্রের চেয়ে বেশি হবে। এ একীভবন সেই প্রত্যাশাকে পূরণ করেছে।

সংঘর্ষের আগে, দুটি কৃষ্ণগহবরের সম্মিলিত পৃষ্ঠতল ক্ষেত্র প্রায় ৯৩ হাজার বর্গমাইল (২ লাখ ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার) ছিল। একীভবনের পর তৈরি হওয়া একক কৃষ্ণগহবরের পৃষ্ঠতল ক্ষেত্র প্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার বর্গমাইল (৪ লাখ বর্গকিলোমিটার) ছিল।

‘এটি প্রথমবার যখন আমরা এত স্পষ্টভাবে এই পরিমাপটি করতে পেরেছি এবং এটি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ যে, আমরা কৃষ্ণগহবরের আচরণ সম্পর্কে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণার সরাসরি পরীক্ষামূলক নিশ্চিতকরণ পেয়েছি’, বলেন স্টোনি ব্রুক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফ্ল্যাটআয়রন ইনস্টিটিউট-এর জ্যোতির্বিদ উইল ফার। তিনি এ গবেষণার অন্যতম প্রধান নেতৃত্বদানকারী।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষণগুলো সবচেয়ে সরাসরি প্রমাণ দিয়েছে যে, কৃষ্ণগহবরগুলো সত্যিই আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্বে আখ্যায়িত ‘বিরোধপূর্ণভাবে সরল’ বস্তু, যেখানে বলা হয়েছে যে, মাধ্যাকর্ষণ হল মহাকাশ-সময়ের বাঁকানো, যা সৃষ্টি হয় ভর ও শক্তির কারণে। এ ফলাফলগুলো আইনস্টাইনের প্রস্তাবিত কৃষ্ণগহবরের সরলতাকে নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ কৃষ্ণগহবরকে সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র তাদের ভর এবং ঘূর্ণন (স্পিন) দ্বারা বোঝা যায়, যা ১৯৬৩ সালে গণিতবিদ রয় কের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

মহাকর্ষীয় তরঙ্গের পরিমাপ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত সময়ে নেওয়া হয়েছিল। ক্যালটেকের জ্যোতির্পদার্থবিজ্ঞানী ক্যাটেরিনা চাটজিওয়ান্নো জানান, কৃষ্ণগহবরগুলো একে অপরের দিকে স্পাইরাল আকারে প্রায় ২০০ মিলিসেকেন্ড ধরে ঘুরছিল। একীভবনের পর তৈরি কৃষ্ণগহবর থেকে প্রাপ্ত সংকেত প্রায় ১০ মিলিসেকেন্ড পর্যন্ত পরিমাপ করা হয়েছিল।


সর্বশেষ সংবাদ