উপকূলীয় এক ইউনিয়ন থেকেই হলেন পাঁচ বিসিএস ক্যাডার
- আনোয়ারা (চট্টগ্রাম) প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১৩ নভেম্বর ২০২৫, ০২:৩৭ PM
চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার রায়পুর ইউনিয়ন, বঙ্গোপসাগর ও সাঙ্গু নদে ঘেরা উপকূলীয় এক অঞ্চল। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস আর নদীভাঙনে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত এই এলাকার শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সহজ নয়। এমন প্রতিকূল পরিবেশেও গেলো কয়েকবছরে এই ইউনিয়ন থেকে পাঁচজন তরুণ বিসিএস ক্যাডার হয়েছেন। এতে এলাকায় যেমন আনন্দের জোয়ার, তেমনি জেগেছে নতুন আশার আলো।
রায়পুর ইউনিয়নের মানুষ মূলত মাছধরা, ক্ষুদ্র ব্যবসা ও দিনমজুরির সঙ্গে যুক্ত। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী মাধ্যমিক পেরোতে পারে না। তবুও এই পাঁচ তরুণের সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে, ইচ্ছা আর অধ্যবসায় থাকলে সীমাবদ্ধতা বাধা নয়।
এই পাঁচজন বর্তমানে দেশের প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগে দায়িত্বে আছেন। তাঁরা হলেন, কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট সজীব তালুকদার (৩৮তম বিসিএস, প্রশাসন), জেলা প্রশাসকের কার্যালয় রাজশাহীতে কর্মরত নুরুল আবছার সবুজ (৪৩তম বিসিএস, প্রশাসন), বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান আমজাদ (৪৩তম বিসিএস, পুলিশ), ৪৪তম বিসিএস (এডমিন) ক্যাডার সালমান হায়দার এবং শেষবার গেলো মঙ্গলবার প্রকাশিত ফলে ৪৯তম বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মুহাম্মদ আশরফ আলী।
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত মুহাম্মদ আশরফ আলী বলেন, “৯১ সালের প্লাবনে আমার চার ভাই ও এক বোন পানিতে ভেসে যায়। তাঁদের কাউকেই পাওয়া যায়নি। আল্লাহর রহমতে মা বেঁচে যান, বাবা ছিলেন শহরে। সেই শোকে আমার পরিবার প্রায় ভেঙে পড়ে। এক বছর পর আমার জন্ম। তাই আমি পরিবারের আদরের সন্তান। ছোটবেলা থেকেই মনে হতো, আমাকে বাঁচতে হবে তাদের স্বপ্ন হয়ে। মাদ্রাসা বিভাগ থেকে পড়াশোনা শুরু করলেও কখনো হাল ছাড়িনি। আজ যখন দেখি, সেই গ্রাম থেকে আমি শিক্ষক ক্যাডারে নির্বাচিত হয়েছি। মনে হয়, আমার সফলতা কেবল আমার নয়, পুরো গ্রামের।'
আশরাফের ছোট ভাই মোশাররফ আলী বলেন, 'আমরা পিঠাপিঠি ভাই। ওর সংগ্রাম আমি খুব কাছ থেকে দেখেছি। নিজের ভাই হয়েও তার পরিশ্রমে আমি অনুপ্রাণিত হই। ওর সাফল্যে শুধু আমাদের পরিবার নয়, পুরো গ্রাম উৎসব করছে।'
আশরাফের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, ৮বছর আগে বাবা হারান তিনি। তিন ভাই ও মা কে নিয়ে বসবাস তার। তিনি ১ম-৫ম শ্রেনি পর্যন্ত পশ্চিম রায়পুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন৷ পরে, আবার মাদ্রাসায় ভর্তি হন ২য় শ্রেণিতে। ২য়-৮ম শ্রেণি পর্যন্ত রায়পুর গাউছিয়া হাশেমীয়া আলিম মাদ্রাসা। পঞ্চম শ্রেণিতে সরকারি বৃত্তিও পেয়েছিল বলে জানান তার পরিবার।
আরও জানান, জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা আলিম পাশ করেন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন।
একই ইউনিয়নের সন্তান, বর্তমানে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত সজীব তালুকদার বলেন, ‘দারিদ্র্য ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বেড়ে উঠলেও বাবা-মা ও শিক্ষকদের সহযোগিতা আর নিজের পরিশ্রমে তিনি প্রশাসনে যোগ দিতে সক্ষম হয়েছেন। সাফল্যের মূল চাবিকাঠি হলো আত্মবিশ্বাস, কঠোর পরিশ্রম ও নিয়মিত পড়াশোনা।'
নতুন প্রজন্মের প্রতি পরামর্শ দিতে গিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘নিজের অবস্থান ও শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে, বড় স্বপ্ন দেখতে হবে, সিনিয়রদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে হবে এবং যেকোনো প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হবে।’
সহকারী কমিশনার নুরুল আবছার সবুজের মন্তব্য তাঁর পরীক্ষার ব্যস্ততার কারণে পাওয়া যায়নি। পরে কথা বলবেন বলে জানান তিনি।
এদিকে সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান আমজাদ বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণরত থাকায় তাঁর প্রতিক্রিয়াও পাওয়া যায়নি। ৪৪তম বিসিএস (এডমিন) ক্যাডারে সালমান হায়দার আছেন বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. আলমগীর হোসেন। তিনি বলেন, সালমান হায়দার রায়পুর গহিরার সন্তান। সে ছোটবেলা থেকেই পরিবার নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করতো। সে গহিরার স্থায়ী বাসিন্দা। আমি তার উজ্জ্বল ভবিষ্যত কামনা করছি।
সহকারী পুলিশ সুপার মেহেদী হাসান আমজাদের মামা ইউপি সদস্য মো. আলমগীর হোসেন বলেন, আমার ভাগিনা বর্তমানে ট্রেনিং এ আছে। তার সাফল্যে আমরা পুরো আনোয়ারাবাসী গর্বিত। উপকূলীয় এলাকা হওয়া স্বত্বেও এখানকার অভিভাবকরা তাদের নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী সন্তানদের পড়াশোনা চালিয়ে নেয়ার প্রচেষ্টা চালান। তাই, এখন দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্বনামধন্য স্কুল কলেজে এখানকার সন্তানেরা পড়াশোনা করছে। যার ফলশ্রুতিতে এই গৌরবোজ্জ্বল অর্জন বয়ে এসেছে।
রায়পুর গাউছিয়া হাশেমিয়া আলিম মাদ্রাসার সিনিয়র শিক্ষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, 'আমাদের এলাকার অনেক শিক্ষার্থী আর্থিক অসচ্ছলতা ও অভিভাবকদের অবহেলার কারণে মাধ্যমিক শেষ করতে পারে না। কিন্তু এই চারজন প্রমাণ করেছে, চেষ্টা থাকলে কিছুই অসম্ভব নয়। ওদের দেখে এখন গ্রামের ছেলেমেয়েরা নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শিখছে।'
চট্টগ্রাম কলেজের শিক্ষক মুহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আশরাফ আলী আমার কাছে আরবি ভাষা শিখত। আমি তাকে প্রথমে যেভাবে পেয়েছি তখনই বলেছিলাম তার আত্মবিশ্বাস ও একনিষ্ঠতা একদিন তাকে ব্যক্তি হিসেবে গড়ে তুলবে, সে আজ তাই করে দেখিয়েছে। তার সাফল্যে আমি সত্যিই গর্বিত।’
রায়পুর ইউনিয়ন উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক তৌহিদুল আলম বলেন, ‘প্রত্যন্ত অঞ্চলে দারিদ্র্য ও দূর্যোগপূর্ণ এলাকায় প্রকৃতির সাথে লড়াই করে এখানে শিক্ষার্থীদের বেড়ে উঠতে হচ্ছে, এসব প্রতিকূলতার মধ্যেও বিসিএস শিক্ষা ও প্রশাসনিক বিভাগে বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী উত্তীর্ণ হয়েছে, তাদের এই সফলতায় আমরা গর্বিত, তাদের জন্য দোয়া রইল।’
স্থানীয় অভিভাবক ইদ্রিস মিয়া বলেন, 'আমাদের জীবনে কষ্টের শেষ নেই। কিন্তু এখন মনে হয়, কষ্ট সার্থক হয়েছে। গ্রামের ছেলেরা আজ বড় অফিসার। আমি চাই, আমার মেয়েও একদিন ওদের মতো হোক।'
স্থানীয় বাসিন্দা মো. আবু ছৈয়দ বলেন, 'একসময় রায়পুর মানেই ছিল নদীভাঙন, বেড়িবাঁধ ভাঙন আর কষ্টের গল্প। এখন শুনি, এখানকার ছেলেরা বিসিএস ক্যাডার হয়েছে, বুকটা গর্বে ভরে যায়। ওরা দেখিয়ে দিয়েছে, উপকূলের সন্তানরাও পারবে যদি সুযোগ পায়।'
রায়পুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য তৌহিদুল ইসলাম বলেন, 'এই চারজনের সাফল্য শুধু চারটি পরিবারের নয়, পুরো ইউনিয়নের গর্ব। তাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো তেমনটা নয়, তারা শিক্ষাদানের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজেদের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছে। এসএসসির পরে কেউ এখানে ছিল না তারা শহরে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করেছে। ফলে তাদের এই সাফল্য ধরা দিয়েছে। উপকূলের সন্তানদের সুযোগ দিলে ওরাও অনেক দূর যেতে পারবে।'
রায়পুর ইউনিয়নের চার তরুণের এই সাফল্য এখন গ্রামের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। স্থানীয়রা বলছেন, উপকূলের সন্তানরা চাইলেই বড় কিছু করতে পারে। এই বিশ্বাসই রায়পুরের সবচেয়ে বড় অর্জন।