এসএসসি-এইচএসসিতে ‘কাঙ্ক্ষিত’ ফল না হলেও ঢাবিতে চান্স, আলীনূর এখন প্রশাসন ক্যাডারে
- এস আলী দুর্জয়
- প্রকাশ: ১২ জুলাই ২০২৫, ০৪:০৩ PM , আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৫, ০২:৩১ PM
আলীনূর খান। এসএসসি ও এইচএসসির দুটোর কোনোটাতেই ‘এ প্লাস’ না পেয়েও চান্স পেয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। শুধু তাই নয় ৩৪তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার নির্বাহী অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন তিনি। সম্প্রতি নিজের সাফল্য, সংগ্রাম ও এসএসসি-এইচএসসির রেজাল্ট খারাপ করে যারা হতাশায় ভুগছেন তাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ নিয়ে মুখোমুখি হয়েছেন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের। তার কথাগুলো শুনেছেন এস আলী দুর্জয়—
এসএসসি ও এইচএসসির রেজাল্ট তুলে ধরে আলীনূর বলেন, আমি ২০০৫ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে জিপিএ-৪.৮১ পাই। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে এটিকে মোটামুটি ভালো রেজাল্ট বলা যায়। আমাদের স্কুল থেকে তখন মাত্র একজন শিক্ষার্থী ‘এ প্লাস’ পেয়েছিল। আর আমি দ্বিতীয় স্থান অর্জন করি। পরবর্তীতে আমি ঢাকার সরকারি বিজ্ঞান কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু কলেজে ভর্তির পর আমার জীবনে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়। গ্রামের সহজ-সরল পরিবেশ থেকে হঠাৎ করে শহরের ব্যস্ত, প্রতিযোগিতামূলক এবং প্রায় অপরিচিত পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে অনেক সংগ্রাম করতে হয়। নতুন পরিবেশে নিজেকে টিকিয়ে রাখতে গিয়ে একধরনের মানসিক চাপ ও অসুবিধার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল। এই পরিবর্তনের ধাক্কাগুলোই আমাকে পরিণত করেছে, বাস্তবতাকে বুঝতে শিখিয়েছে এবং জীবনের নানা দিক চিনতে সাহায্য করেছে। তিনি আরও বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে এইচএসসি পরীক্ষাতেও আমি জিপিএ-৫ পাইনি। আমি জিপিএ-৪.৫০ পেয়েছিলাম। তখনকার সময়ে এটি একেবারে খারাপ ফলাফলও ছিল না। আমাদের সময় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখনকার মতো এত বেশি ছিল না।
ব্যর্থতাকে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে সফলতা অর্জন করা সম্পর্কে আলীনূর বলেন, একটানা কাঙ্ক্ষিত রেজাল্ট না পাওয়ার কারণে আমার মধ্যে একতা জেদ তৈরি হয়েছিল যে, এই ফলাফলের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠে আমাকে ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতে হবে। এই তাড়না থেকে আমি মনোযোগ দিয়ে পড়ালেখা শুরু করি। সেই অধ্যবসায়ের ফলেই আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাই। শেষ পর্যন্ত আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই।
ভালো রেজাল্ট নাকি দক্ষতা কোনটা বেশি জরুরি জানতে চাইলে তিনি বলেন, আজকের দিনে জিপিএ-৫ পাওয়াকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কেউ ‘এ প্লাস’ পায়, কেউ ‘গোল্ডেন এ প্লাস’ পায়—এ সবকে অনেক বড় করে দেখা হয়। অথচ প্রকৃত শিক্ষা কাকে বলে, তা দিয়ে কী একজন শিক্ষার্থী বাস্তব জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারবে কিনা, সেই প্রশ্নটাই এখন প্রায় অনুপস্থিত। তবে আমার কাছে রেজাল্ট নয়, প্রকৃত শিক্ষা ও দক্ষতাই একজন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ার মূল কারিগর। যদি কোনো শিক্ষার্থী প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে, তাহলে রেজাল্টের সামান্য ঘাটতি থাকলেও সে তা পুষিয়ে নিতে পারে এবং এগিয়ে যেতে পারে।
তিনি বলেন, একজন শিক্ষার্থী সারা বছর ভালোভাবে প্রস্তুতি নেওয়ার পরেও নানা অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে—যেমন, শারীরিক অসুস্থতা, পারিবারিক দুর্ঘটনা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ—তার এক-দুইটি বিষয়ের পরীক্ষা ভালো নাও হতে পারে। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, সে ওই বিষয় ভালো জানে না বা মেধাবী নয়। অথচ আমাদের প্রচলিত পদ্ধতিতে জিপিএ-এর ওপর ভিত্তি করেই তার মূল্যায়ন হয়।
তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও জিপিএ-এর ওপর একটা নম্বর থাকে। ফলে জিপিএ কম থাকলে স্বাভাবিকভাবে একটু পিছিয়ে পড়লেও, ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করলে সে ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব। আমি কখনোই মনে করি না, জিপিএ-৫ না পাওয়াটা কোনো শিক্ষার্থীর লক্ষ্য পূরণে অন্তরায়। বরং দক্ষতা, মনোযোগ, অধ্যবসায় ও আত্মবিশ্বাস—এই গুণগুলো থাকলে একজন শিক্ষার্থী যেকোনো সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে পারে।
এসএসসিতে যারা কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি তাদের পরামর্শ দিয়ে আলীনূর বলেন, পুষিয়ে নিতে না পারলেও হতাশ হওয়ার কিছু নেই। প্রত্যেক মানুষের মাঝে কিছু না কিছু আলাদা যোগ্যতা, সক্ষমতা ও সম্ভাবনা থাকে—সেই বিশেষ গুণগুলোকে ভিত্তি করেই সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করা সম্ভব। হতাশ হয়ে পড়া বা নিজের ওপর ক্ষুব্ধ হওয়া কোনো সমস্যার সমাধান নয়। বরং এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে স্থির রেখে নতুন করে ভাবার চেষ্টা করা জরুরি। কোনো পরীক্ষায় খারাপ ফলাফল হয়েছে বলেই জীবনের সব দরজা বন্ধ হয়ে গেছে—এমনটা ভাবা ঠিক না। বরং আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে এখনো অনেক ধরনের সুযোগ ও বিকল্প পথ খোলা রয়েছে, যেগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব। যারা ভালো ফল করেছে, তাদের জন্য শুভকামনা। আর যারা কাঙ্ক্ষিত ফল পায়নি, তাদের জন্য আরও বেশি শুভকামনা—কারণ তাদের জন্য এখন শুরু হলো নতুন এক জেদ, নতুন এক পথচলা। তারা যেন সেই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করে, দক্ষতা অর্জন করে, এবং সফল জীবনের দিকে এগিয়ে যায়—এটাই আমার প্রত্যাশা।
নিজের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আমার নিজের কথাই বলি—আমারও দুটি পরীক্ষায় ফলাফল খুব একটা ভালো ছিল না। কিন্তু আমি সেটা নিয়ে ভেঙে পরিনি। বরং আমি বুঝতে চেষ্টা করেছি কোথায় আমার দুর্বলতা ছিল, কীভাবে সেই ঘাটতিগুলো পূরণ করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে আমি নতুন করে পড়াশোনায় মনোযোগী হয়েছি এবং ধীরে ধীরে নিজের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠেছি।
তিনি আরও বলেন, আপনার যদি কোনো পর্যায়ে ফলাফল খারাপও হয়, তবু আপনি নতুন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। তার জন্য দরকার আত্মপ্রত্যয়, মানসিক শক্তি আর পরিকল্পনা। সমাজে অনেকেই আছেন যারা হতাশা কাটিয়ে সাফল্যের শিখরে পৌঁছেছেন। তাদের অনুসরণ করুন, অনুপ্রেরণা নিন। মনে রাখবেন, দীর্ঘদিন হতাশায় ডুবে থাকলে তা শুধু ক্ষতির কারণই হবে—কোনো ইতিবাচক ফলাফল আনবে না।