‘বিসিএসের খাতায় শুধু কলমের কালি নয়, চোখের জলও ছিল’

আশরাফুল ইসলাম ইমন
আশরাফুল ইসলাম ইমন  © টিডিসি ফটো

বাবার আকস্মিক মৃত্যু হয়েছিল। সেই শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থী আশরাফুল ইসলাম ইমন। ৪৩তম বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (বিসিএস) তথ্য ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। গত ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএসের ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে মোট ২ হাজার ৮০৫ জন চূড়ান্ত সুপারিশপ্রাপ্তদের ফল ঘোষণা করে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। এতে তথ্য ক্যাডারে জায়গা করে নেন ইমন।

ইমনের গ্রামের বাড়ি বরিশাল জেলাতে। তার বাবার নাম আলি ইসলাম মোল্লা। তার বাবা রুপালি ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তারা তিন ভাই বোন। তার বড় বোন তার থেকে পাঁচ বছরের বড়। ছোট ভাই আহসানুল্লাহ্ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশুনা করছেন।

বরিশাল জিলা স্কুল থেকে তার মাধ্যমিক ও শহরের সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করেন ইমন। পরবর্তীতে তিনি বুটেক্সে ২০১৪-১৫ সেশনে ভর্তি হোন। তিনি বুটেক্সের ৪১তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রথম ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন তিনি। কিন্তু প্রিলিতে পাশ করার পর তার বাবার হঠাৎ মৃত্যুতে তিনি ভেঙে পড়েন এবং সেবার ননক্যাডারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। এরপর অনেক চড়াই উৎড়াই পেরিয়ে ৪৩তম বিসিএসে তথ্য ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

তার সফলতা নিয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষবর্ষে বিসিএসের প্রতি কিছুটা আগ্রহ জন্মে। আত্নীয় স্বজনের মধ্যে কেউ সিভিল সার্ভিসে না থাকায়, একটা উদাহরণ হতে চেয়েছিলাম। উদ্দেশ্য ছিলো মা-বাবাকে আরো সম্মানিত ও গর্বিত করা। পাশাপাশি এমন একটা জব করা, যেটিতে আমি স্বাচ্ছন্দবোধ করবো। সমাজে বিসিএস ক্যাডারদের সম্মানের বিষয়টি যে একটি বড় প্রভাবক, তাও অস্বীকার করবো না। আমার মা-বাবাও উৎসাহিত করলেন এ চ্যালেঞ্জিং পথে পা বাঁড়াতে।

তিনি আরও বলেন, মানুষের জন্য কাছ থেকে কাজ করার আনন্দ আমাকে প্রবলভাবে মাঠ প্রশাসনের প্রতি আকর্ষিত করেছিলো। আর এটা একমাত্র ভালোভাবে সম্ভব বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে।

৪১তম বিসিএসে কেন তিনি লক্ষ্যচ্যুত হন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ৪১তম বিসিএস প্রথম বিসিএস ছিলো। প্রিলি পরীক্ষায় ভালো করার পর রিটেনের জন্য আগাচ্ছিলাম। কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত জীবনে ঘটে গেলো বড় ট্র্যাজেডি। রিটেন পরীক্ষার ২ মাস আগে ২০২১ সালের অক্টোবরের ২ তারিখ বাবার আকস্মিক মৃত্যুতে একেবারেই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। কারণ তিনি শুধু বাবাই নন, আমার প্রিয়তম, নিকটতম বন্ধুও ছিলেন। প্রিয়জনের অন্তিমকালের দৃশ্য আমাকে ভেঙে চুরে ফেলে। আমার জীবনে আমার বাবার আত্নত্যাগ অনস্বীকার্য। যখন বাবাকে এভাবে হারিয়ে ফেললাম, আমি এ করুণ বাস্তবতাকে কিছুতেই গ্রহণ করতে পারছিলাম না। কারণ বাবার মত কেউ আমাকে এতটা আগলে রাখেনি, ভালোবাসে নি। বাবার শূন্যতায় প্রচণ্ড ডিপ্রেশনে চলে গিয়েছিলাম। বাবা কত স্যাক্রিফাইস করেছে, কত স্নেহ করেছে আমাকে, আর আমি তার জন্য নিজের উপার্জনে একটা জামা উপহার দিতে পারলাম না। কখনো সে সৌভাগ্য হবেও না। একদিন বিসিএস ক্যাডার হলেও বাবার হাসিমুখটা দেখতে পারবো না, এ কথাগুলো চিন্তা করে আমি লক্ষ্যচ্যুত হয়ে পড়ি—বলেন ইমন।

তিন বলেন, ২ মাস একেবারে না পড়েই ৪১তম রিটেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। শুধু চেয়েছি অংশ নিতে। আমার ঐ রিটেন পরীক্ষার খাতায় শুধু কলমের কালি নয়, চোখের জলও ছিলো। 

বাবার মৃত্যুর পর কিভাবে আপনি আবার ঘুরে দাঁড়ালেন এ বিষয় তিনি বলেন, ৪৩তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা হয়েছিলো ৪১তম রিটেনের ৬ মাস পর ২০২২ সালের জুনে। নিজেকে গুছিয়ে তুলতে পারছিলাম না তখনও। পড়াশোনা একেবারেই ভালো হচ্ছিল না। বই সামনে থাকলেও বাবার স্মৃতিই তাড়িয়ে বেড়াতো। লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স চোখে ভেসে উঠতো। মানুষের সবচেয়ে বড় যুদ্ধ, তার নিজের মনের সাথেই। বিসিএসের মত স্ট্রেসফুল জার্নিতে মানসিক স্থিতিশীলতা খুব গুরুত্বপূর্ণ। 

লিখিত পরীক্ষাতেও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থার প্রভাব পড়েছিলো তার। প্রায় ১ বছর তিনি পড়াশোনায় ঠিকমতো মনোসংযোগ করতে পানেন নি। টুকটাক যেভাবে পড়েছেন, তাতে আসলে ভালো কিছু সম্ভব নয় বর্তমান প্রতিযোগিতার সময়ে। আরো কয়েকটি সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ভাইভা পর্যন্ত গেলেও জব হয় নি তার। 

ইমনের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে মা-বাবার অজস্র আত্নত্যাগের গল্প আছে। তিনি জানান, আমার পরিবারের প্রতি আবেগ অনুভূতি, নির্ভরতা একটু বেশি। ক্রমশ আমি উপলব্ধি করতে পারি যে, আমাকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ভাগ্যকে এক্সকিউজ হিসেবে দেখানোর সুযোগ নেই। বরং দুঃসময় ম্যানেজ করাই জীবনের সার্থকতা। এই যে আমার দুরবস্থা, এজন্য ভাগ্য না, আমিই দায়ী। 

যত যাই হোক মা আর পরিবারের জন্য ভালো কিছু করতে হবে, এমন ব্রত নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা শুরু করেন তিনি। তিনি বলেন, ডিপ্রেশন, বাবার স্মৃতি  থাকলেও পরিশ্রম করে যেতে হবে। আমার বিসিএস জার্নিতে পরিবার অনেক সাপোর্ট করে এসেছে। কিন্তু পরিবারের বড় ছেলে হওয়ায় সামাজিক একটি চাপ আমাকে ঘিরে ধরেছিলো। অন্য কোন জবও হচ্ছিল না। শুধু নিজের না, পরিবারের জন্য ফাইট করছিলাম। প্রতিদিনই ভেঙে যাওয়া নিজেকে জোড় করে গড়তাম। নতুন টার্গেট সেট করতাম। আমাকে ভালো কিছু করতেই হবে। বাবার মৃত্যুর পর ওরা খুব কষ্টে আছে। ওরা যেন আমার অর্জনে একটু খুশি হয়। 

তিনি আরও জানান, ২০২৩ সালের অক্টোবরে ৪৩তম বিসিএস ভাইভা দেই। আমি আদৌ চিন্তা করি নি, ক্যাডার হতে পারবো। মনে হয়েছে, রিটেনে যথেষ্ট ভালো করি নি। তাছাড়া আমার প্রতিযোগিরা আমার চেয়ে অনেক মেধাবী। এরপর গত ২৬ ডিসেম্বর ৪৩তম বিসিএসের রেজাল্ট দেখে সত্যিই আশ্চর্যান্বিত হয়েছি।

ক্যাডার হওয়ার উপলব্ধির বিষয়ে তিনি বলেন, পরিবার বা আত্নীয় স্বজনের মধ্যে আমিই প্রথম বিসিএস ক্যাডার হতে চলেছি। আমার আশেপাশের অনেক মানুষ এ সফলতায় আনন্দিত। আমি কী হয়েছি, তা জানি না, আমার মা অনেক খুশি হয়েছেন। আমার পরিবার একটি শক্তি পেয়েছে। আমাকে দেখে আরও অনেকে চিন্তা করবে- ‘ওর মত সাধারণ কেউ পারলে, আমিও পারবো।’ এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।  

মহান আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এই বিসিএস জয়ী শিক্ষার্থী বলেন, যেখানে আল্লাহ্ সুযোগ দেবেন দেশ, জনগণ ও সোসাইটির জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করবো ইনশাআল্লাহ্। সম্মান, মর্যাদা বা স্বীকৃতি অর্জনের চেয়ে তা রক্ষা করা কঠিন। আমি সকলের কাছে দোয়া চাইছি। মহান আল্লাহ্ যেন সহায় হোন। মহান আল্লাহ্ জীবনের কঠিন সময়ে আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছেন। ধৈর্য, প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা, দায়িত্ববোধ, মানুষের প্রকৃতি সম্পর্কে ধারণা, আরো অনেক কিছু। অনেক অনিশ্চয়তার মাঝেও যা আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যায় তা হলো অজেয়কে জয় করার দৃঢ় স্পৃহা।

ইমন ক্রিকেট খুব ভালোবাসতেন। তিনি তার কলেজ লাইফে বেশ কিছু ট্রফিও পেয়েছিলেন। এছাড়া ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক ও স্বেচ্ছাসেবী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ ছিলো তার। এর মধ্যে ছিলো দরিদ্রদের সহায়তা, পথশিশুদেরকে ঈদের পোশাক উপহার, শীতার্তদের মাঝে কম্বল বিতরণ, করোনা সংকটে মাস্ক, ত্রাণ বিতরণ, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি এবং মাদক ও যৌতুকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম।

 

সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence