বুয়েটে পড়ার স্বপ্নভঙ্গ হলেও কলেজছাত্রী অনন্যা চান্স পেলেন বিশ্বসেরা ক্যালটেকে

সানজিদা নুসরাত অনন্যা
সানজিদা নুসরাত অনন্যা  © সম্পাদিত

ব্যর্থতার হাত ধরেই আসে সফলতা। চলার পথে প্রতিকূলতা আসবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু এই প্রতিকূলতা ডিঙ্গিয়ে যারা এগিয়ে যেতে পারে জীবনেই তারাই সফল। চলার পথে এমনি সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে এক অনন্য অর্জনের নজির গড়েছেন ময়মনসিংহের মেয়ে সানজিদা নুসরাত অনন্যা। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি’তে (ক্যালটেক) ফুল স্কলাশিপ নিয়ে স্নাতক প্রোগ্রামে পড়াশোনার করার সুযোগ পেয়ে নিজের পরিবারের সাথে উজ্জ্বল করেছেন দেশের মুখও।

টাঙ্গাইল থেকে এসএসসি পাশের পর ময়মনসিংহ চলে আসেন অনন্যা। ২০২১ সালে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন, সেখান থেকেই শুরু হয় তার এই যাত্রা। গণিত ও পদার্থবিদ্যার প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ থাকা এই ছাত্রী দেখছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ার স্বপ্ন।

এক সাক্ষাতকারে অনন্যা বলেছিলেন, আমার গল্পটা সবার মতো না। আমার গল্পটা ব্যাতিক্রম। আমার গল্পটা তাদের জন্য যারা সারাজীবন বুয়েটে পড়ার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু ভর্তির আবেদন করতে না পেরে দিন শেষে মানুষের কথা শুনতে হয়!

২০২১ সালের এপ্রিলের দিকের ঘটনা। বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় চান্স পাওয়ার জন্য পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও সাধারণ গণিত মিলিয়ে মোট নম্বরে ঘাটতি ছিল তার। এজন্য ভর্তিযুদ্ধে বসার ফর্ম তুলতে পারেননি অনন্যা। এরপর এক বছরের বিরতি নেন এবং ভর্তি হন ঢাকার কার্ডিফ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হন। বুয়েটের স্বপ্নভঙ্গের পর নতুন আশা খুজছিলেন অনন্যা। আর ঠিক সেসময় পেয়েও যান তিনি।

অনন্যা বলেন, সেসময় আমি 'বাংলাদেশ বিয়ন্ড বর্ডার' নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ খুঁজে পাই, যা এমআইটি, ক্যালটেক ও হার্ভার্ডের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মিলে তৈরি করেছেন। এরপরেই আমি আমার পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি।

সর্বপ্রথম স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সামার ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম স্পিনউইপে ডাক পান অনন্যা; এর জন্য তার বাংলাদেশ ফিজিক্স অলিম্পিয়াডের স্বীকৃতিকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। স্ট্যানফোর্ডে ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামে থাকার সময় অধ্যাপক রিসা ওয়েকসলারের একটি সেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন অনন্যা; এরপরেই গবেষণার প্রতি তার আগ্রহ আরও বেড়ে যায়।

অনন্যা বলেন, এরপর আমি নিউইয়র্ক একাডেমি অব সায়েন্সেসে যোগ দেই এবং বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা ৫ জন বন্ধুর সাথে চারটি গবেষণা প্রকল্পে কাজ করি। সেই সাথে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের 'কোল্ড-ইমেইল' পাঠানো অব্যহত রাখি এবং উল্লেখযোগ্য সামার প্রোগ্রামগুলোতে আবেদন করতে থাকি।

একের পর এক গবেষণা এবং এলজাভিয়ারসহ বিভিন্ন কনফারেন্সে একাধিক পাবলিকেশনের পর অনন্যা টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলথ সায়েন্স সেন্টারের ক্লিনিশিয়ান অধ্যাপক নাজনিন এস আহমেদ এবং কর্নেল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক জিলিয়ান গোল্ডফার্বের সাথে কাজ করার সুযোগ পান।

আরও পড়ুন: সব বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ভর্তি পরীক্ষা নিতে সভা ডেকেছে ইউজিসি।

এদিকে অনন্যার বাবা বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) একজন অধ্যাপক। অনন্যা তার বাবারও একটি থিসিসের কাজের সঙ্গে যুক্ত হন এবং নেটিভ সোসাইটিতে ঔষধি ভেষজের ব্যবহার নিয়ে তাদের সর্বশেষ গবেষণায়ও অংশগ্রহণ করেন।

অনন্যার বাবা বলেন, আমি এবং আমার স্ত্রী সবসময় অনন্যার পাশে ছিলাম এবং ওকে ওর লক্ষ্যপূরণে এগিয়ে যেতে উৎসাহ দিয়েছি। ওর বিদেশে যাওয়া নিয়ে আমি দুয়েকবার আপত্তি তুললেও, ওর মা সবসময় ওকে সমর্থন দিয়েছে।

গবেষণা কাজের পাশাপাশি গণিত অলিম্পিয়াডেও অংশ নিয়েছেন অনন্যা। হার্ভার্ড-এমআইটি ম্যাথ টুর্নামেন্টে ফাইনালিস্ট ছিলেন তিনি। এছাড়াও, আমেরিকান ম্যাথমেটিকস কম্পিটিশন (এএমসি) ১২-তে অংশগ্রহণ করেছেন অনন্যা। এএমসিতে তিনি শীর্ষ ৫ শতাংশের মধ্যে একজন ছিলেন এবং 'অনার রোল'-এ ভূষিত হন। এর মাধ্যমে তিনি আমেরিকান ইনভাইটেশনাল ম্যাথমেটিকস এক্সামিনেশনে (এআইএমই) অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন।

অনন্যা বলেন, এআইএমই আমাকে ইউএসএ ম্যাথ অলিম্পিয়াড ২০২৩-এ অংশগ্রহণ ও কোয়ালিফাই করতে সাহায্য করেছে।

আরও পড়ুন: আমেরিকার এমআইটি ডাকছে চাঁদপুর কলেজের নাফিসকে।

কম্পিউটেশনাল বায়োলজি ও নিউরোসায়েন্স নিয়ে গবেষণার প্রতি অনন্যার আগ্রহ তাকে বায়োলজিক্যাল সায়েন্স নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার সুযোগ করে দেয়। তিনি বলেন, ২০২১ সালে আমি ব্রিটিশ বায়োলজি অলিম্পিয়াড (বিবিও) থেকে স্বর্ণ ও ২০২২ সালে ব্রোঞ্জ পদক জিতেছি। তখন আমাকে বিবিও পদকপ্রাপ্ত হিসেবে রয়্যাল সোসাইটি অব বায়োলজিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

ইন্টারন্যাশনাল মেডিসিন অলিম্পিয়াডেও অংশ্রগ্রহণ করেন এবং সেখানে তিনি সারা বিশ্বের প্রতিযোগিদের মধ্যে দ্বিতীয় হন। ইউএসএ মেডিসিন অলিম্পিয়াডে কোয়ালিফাই করার পর বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদক জেতেন অনন্যা। এছাড়াও, ইন্টারন্যাশনাল জিনিয়াস অলিম্পিয়াডে প্রথম অনারেবল মেনশনের মর্যাদা অর্জন করেন অনন্যা এবং রচেস্টার ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ২৫ হাজার ডলার পুরস্কার পান।

সাম্প্রতিক সময়ে এমআইটিতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সুযোগ বেড়েছে, কিন্তু ক্যালটেকে পড়ার সুযোগ যে বিরল তা অস্বীকার করা যাবে না। বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে ক্যালটেক একটি; এবং এ প্রতিষ্ঠানটিতে সুযোগ পাওয়া এতটাই কঠিন যে স্টেম (বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইঞ্জিনিয়ারিং, গণিত) শিক্ষাখাতে সবচেয়ে প্রতিযোগিতাপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে।

উল্লেখ্য, আমেরিকায় মাথাপিছু সর্বাধিক নোবেলবিজয়ী ৭৯ জনের নাম ক্যালটেকের সঙ্গে জড়িত এবং সরাসরি ক্যালটেকের ৪৬ জন প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ফ্যাকাল্টি সদস্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। যাদের মধ্যে বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এবং রিচার্ড ফেইনম্যানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

তথ্যসূত্র: টিবিএস বাংলা 


সর্বশেষ সংবাদ