নববধূর স্বপ্ন ছেয়ে গেল বিষাদে
- টিডিসি ডেস্ক
- প্রকাশ: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৪ AM , আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪৪ AM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ হওয়া সাইমন ইসলাম আল-আমিন (২৩) বিয়ে করেন প্রায় পাঁচ মাস আগে। ফেসবুকে পরিচয়ের মাধ্যমে তিন বছরের সম্পর্কে বিয়ে করে প্রস্ততি নিচ্ছিলেন নতুন বউ ঘরে তোলার। নববধূ বাবার বাড়িতে থাকলেও নতুন চাকরি পেয়ে সাইমন বউকে খবর দিয়েছিলেন নতুন বাসা নিয়েছেন বলে।
নতুন সংসার সাজানোর সুখবর দেওয়ার পরপরই বিষাদের খবর পান নববধূ। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতোই অবিশ্বাস্য এই দুঃসংবাদ মেনেই নিতেই পারছিলেন না স্ত্রী শামীমা আক্তার (১৯)। শামীমার নতুন সংসারের স্বপ্ন যেন চুরমার হয়ে গেল একটি গুলিতেই।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্রজনতা ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষে গত ১৯ জুলাই দুপুরে সাভার রেডিও কলোনি এলাকায় শহিদ হন সাইমন ইসলাম আল-আমিন। কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর মধ্যপাড়ার মো. বাবুল ও মনোয়ারা বেগম দম্পতির মেজো ছেলে সাইমন ইসলাম আল-আমিন (২৩)। তিনি সাভারের রেডিও কলোনির নয়াবাড়ি এলাকায় ভাড়া বাসায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। তার বাবা কাজ করেন গাজীপুরের এক কোম্পানিতে।
আরও পড়ুন: ‘হাসিনার পতনে সব যন্ত্রণা ভুলে গেছি’
২০ জুলাই শহিদ সাইমনের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের দৌলতপুর দক্ষিণপাড়ায় দাফন করা হয় । নিহত সায়মন তিন ভাই-বোনের মধ্যে ছিল মেজ। বড় ভাই মো. মহসিন মিয়া (২৬) কাতার প্রবাসী। ছোট ভাই জহির মিয়া (১৮) স্থানীয় একটি ওয়ার্কশপে কাজ করেন। বড় বোন মাহমুদা আক্তার (২৭) বিবাহিত।
সাইমন মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সে আমাকে ফোন করে নতুন বাসা নেওয়ার কথা জানায়। আমিও তাঁর সাথে গিয়ে ওই বাসা দেখে আসবো বলেছিলাম। এর কিছুক্ষণ পরই খবর পেলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে তাঁর গুলি লেগেছে।
নিহত সাইমনের স্ত্রী শামীম আক্তার বলেন, আমি আমার পরিবারের সাথে ঢাকার সবুজবাগ এলাকায় থাকতাম। আর সায়মন থাকতো রেডিও কলোনিতে। আমাদের বিয়ে হওয়ার পর তাদের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা না থাকায় আমি বাড়িতে থাকতাম। পরে নতুন বাসা নিয়ে আমাকে নিয়ে যাবে এমন কথা হয়েছে দু’পরিবারের মধ্যে। সাইমন মারা যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে সে আমাকে ফোন করে নতুন বাসা নেওয়ার কথা জানায়। আমিও তাঁর সাথে গিয়ে ওই বাসা দেখে আসবো বলেছিলাম। এর কিছুক্ষণ পরই খবর পেলাম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে তাঁর গুলি লেগেছে। পরে তো হাসপাতালে মারা যায়। মাত্র ঘণ্টা খানেকের মধ্যে এমন দু’টি খবর আমার মোবাইল ফোনে আসবে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সাইমনের মামা হারুনুর রশিদ বলেন, আমার বোন জামাই তার সন্তানের লাশ আনতে কোন যানবাহন পাচ্ছিলেন না। শুক্রবার সারা রাতেও কোন অ্যাম্বুলেন্স খুঁজে পাননি। তখন ফোন করে আমাকে বিষয়টি জানায়। পরে আমি কুমিল্লা থেকে শনিবার ভোরে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ঢাকা থেকে লাশ নিয়ে কুমিল্লায় আসি। এ লাশ আনতে গিয়ে পথে পথে কঠিন বাঁধা ও পরিস্থিতির শিকার হয়েছি যা বলার ভাষা আমার নেই।
আরও পড়ুন: ‘আমি তো সব হারিয়েছি, আর কিছুই দেওয়ার নেই’
সাইমনের মা মনোয়ারা বেগম বলেন, আমার ছেলে বাসা থেকে জুমার নামাজ পড়তে বের হয়। পড়ে আমার কাছে খবর আসে ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে কেউই ভয়ে ধরতে যাচ্ছে না। এর কিছুক্ষণ পর কল আসে সে হাসপাতালে। আমি দৌড়ে হাসপাতালে গিয়ে দেখি ছেলে মারা গেছে। টাকা পয়সার অভাবে ছেলেটা এইচএসসি পাস করে আর লেখাপড়া করতে পারেনি। নতুন একটা চাকুরি পেয়েছিল। গত ৫ মাস আগে সম্পর্ক করে বিয়ে করেছে। বউটাকে তুলে আনতেও পারেনি। এর আগেই আমার ছেলেটাকে খুন করে দিল তারা। ছেলেটা চাকুরি করে পরিবারের হাল ধরবে। নতুন বউ ঘরে আনবে সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না।
এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া দিলে আমার আহত ছেলেকে রেখে পালিয়ে যায় উদ্ধারকারীরা। পরে পুনরায় আমরা গিয়ে পথ পরিবর্তন করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কিছুক্ষণ আইসিউতে রেখে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সাইমনের বাবা বাবুল মিয়া বলেন, আমার ছেলে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে পরিবারের সচ্ছলতা আনতে চাকুরি নিয়েছিল একটি বেসরকারি কোম্পানিতে। গত ১৯ জুলাই সাভারের রেডিও কলোনিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের সময় আল-আমিনের পিঠে গুলি লেগে নাভির ওপর দিয়ে বের হয়ে যায়। সেখান থেকে কিছু ছেলে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সাভার সুপার হাসপাতালে। তাকে সে হাসপাতালে রাখা হয়নি। পরে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার সময় পথে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ধাওয়া দিলে আমার আহত ছেলেকে রেখে পালিয়ে যায় উদ্ধারকারীরা। পরে পুনরায় আমরা গিয়ে পথ পরিবর্তন করে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে কিছুক্ষণ আইসিউতে রেখে ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
তিনি আরও বলেন, আমার ছেলের বিষয়ে উপজেলা প্রশাসন থেকে ফোন করে খবর নিয়েছে। স্থানীয়ভাবে বরুড়া উপজেলা যুবদল আমাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছিল। এছাড়া, সরকারি বেসরকারি কোন সহযোগিতা পাইনি।
আরও পড়ুন: রিকশায় ঝুলে থাকা মরদেহের পেছনের যে বীভৎস বর্ণনা দিলেন চালক
সাইমনের বাবার কথা উল্লেখ করে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, বাবুল মিয়া একটি ফ্যান কোম্পানির কর্মচারী। খুবই অসহায় ও অসচ্ছল পরিবার। বড় ছেলেকে অনেক ধার দেনা করে বিদেশে পাঠিয়েছেন। তার অবস্থা ভাল না হওয়ায় এখনও ধার শোধ করতে পারেনি। এর মধ্যে মেজ ছেলে নিহত হয়েছে।
অসহায় এ পরিবারটিকে সহায়তা দিতে সরকারের পাশাপাশি সকলকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানায় সাইমনের স্বজন ও এলাকার বাসিন্দারা।
বরুড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নু-এমং মারমা মং গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা নিহত পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছি। নিহত সাইমন ইসলাম আল-আমিনের পরিবার ঢাকায় থাকে। কোন সহযোগিতা আসলে আমরা তাদের জন্য ব্যবস্থা করবো। আমরা তাদের তালিকা পাঠিয়েছি।
[বাসস অবলম্বনে]