ভবনের নিচে সরকারি স্কুল, ওপরে সরকারি কলেজ— ‘পরাধীন’ এক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গল্প

তিনতলা এই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় চলে কলেজের ক্লাস। আর নিচতলায় চলে ইসলামিয়া স্কুলের কার্যক্রম
তিনতলা এই ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় চলে কলেজের ক্লাস। আর নিচতলায় চলে ইসলামিয়া স্কুলের কার্যক্রম  © টিডিসি ফটো

তিনতলা ভবনে ক্লাসরুম মাত্র আটটি, রয়েছে ছয় শতাধিক শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও কর্মচারী। ক্লাসে শিক্ষার্থী উপস্থিতি বাড়লে পাঠদান করতে হয় বারান্দায়; এক কক্ষেই চলে দুটি শ্রেণির ক্লাস। রয়েছে বড় খেলার মাঠ। ক্রিকেট বলে আহত হন শিক্ষক-শিক্ষার্থী। পুরান ঢাকার কবি নজরুল সরকারি কলেজের দখলে স্কুলের কক্ষ, ভবন, মাঠ—সবই। যেন নিজ গৃহে পরাধীন এক প্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।

সরকারি প্রতিষ্ঠান হলেও নেই কোনো অবকাঠামোগত সুবিধা। ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থী ভর্তি নেন না জানিয়ে ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জান্নাতুল তাজেরীন দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কলেজের গেট থেকে শুরু করে পুরো সম্পত্তি স্কুলের নামে। ক্লাস-পরীক্ষার নামে ধীরে ধীরে স্কুলের ক্লাসরুমগুলো কলেজ কর্তৃপক্ষ দখলে নেয়। কলেজের পরীক্ষা থাকলে অনেকটা বাধ্য হয়েই দিতে হয় স্কুল ছুটি। পাঠদান কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে দ্রুতই বিষয়টির সমাধান জরুরি। সেটা না হলে কালের আবর্তনে পাঠদান বন্ধ হতে পারে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যেতে পারে।

 

স্কুল ভবন, সামনে খেলার মাঠ—সব এখন কলেজের দখলে

তিনি আরও বলেন, ‘স্কুলের নামে সব কাগজপত্র রয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) বিষয়টি জানে। শিগগিরই আমরা এটি নিয়ে আদালতে একটি মিসকেস করব। ইতোমধ্যে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। মিসকেস করা হলে সংশ্লিষ্টরা কলেজ ও স্কুল কর্তৃপক্ষকে নিয়ে বসবে।’

অপর দিকে কবি নজরুল সরকারি কলেজের কারণে স্কুলের কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে জানালে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান। তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘ক্লাস-পরীক্ষা চলাকালীন মাঠে কলেজের শিক্ষার্থীদের খেলতে নিষেধ করা হয়েছে। আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।’

কলেজের সম্পত্তি স্কুলের নামে রয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে কবি নজরুল সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ বলেন, সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে, সেটাই হবে। 

আরও পড়ুন: পুরান ঢাকার ৩ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী সংকট, প্রতিবছরই উপস্থিতি কমছে 

জানা গেছে, কবি নজরুল কলেজের গেট থেকে পুরো জমি ওই স্কুলের সম্পত্তি। এই স্কুল থেকেই ১৯২৩ সালে ইসলামিয়া ইন্টারমিডিয়েট কলেজ নামে উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনুমোদন দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে কবি নজরুল সরকারি কলেজ নামকরণ করা হয়। ধীরে ধীরে কলেজের শিক্ষার্থী বাড়তে থাকলে ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ক্লাসরুমগুলো কলেজের নিয়ন্ত্রণে যেতে থাকে। মাঠের পূর্ব পাশে তিনতলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় চলে কলেজের ক্লাস। আর নিচতলায় মাত্র ৮টি কক্ষে চলে ইসলামিয়া সরকারি স্কুলের কার্যক্রম।

ইসলামিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়

সরকারি এই স্কুলে তৃতীয় থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত প্রায় ৬০০ শিক্ষার্থী রয়েছে। ক্লাসরুম সংকট থাকায় এ বছর ১৪০ শিক্ষার্থীকে ভর্তি করানো হয়। ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষার্থী ভর্তি করাতে পারে না বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি মাউশি ও মন্ত্রণালয়কেও জানানো হয়েছে। ক্লাসরুম সংকটের কারণে একই কক্ষে দুই শ্রেণির বা দুটি বিষয়েরও ক্লাস নিতে হয়। একই কক্ষে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ক্লাস নিতে হয়। এতে একাডেমিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে স্কুল কর্তৃপক্ষ।

স্কুল কর্তৃপক্ষ জানায়, শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে মনোযোগী হতে পারে না। উপস্থিতি বাড়লে বারান্দায় চলে পাঠদান। মাঠে কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও উচ্চ শব্দের ফলে প্রায় সময়ই দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিতে হয়। দরজা বন্ধ না করলে ক্রিকেট বল ক্লাসে এসে যায়, কখনো কখনো শিক্ষক-ছাত্ররা আহত হয় এবং হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়।

এ ছাড়া কলেজের পরীক্ষা চলাকালীন স্কুলের কার্যক্রম চালানো যায় না এবং স্কুল ছুটি দিতে হয়। রাজনৈতিক অনুষ্ঠান কিংবা কোনো ধরনের ঝামেলায় কলেজের কিছু শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে অবস্থান নিলে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে কান্না করতে থাকে। সে সময় অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরুপায় হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।

কলেজের স্নাতকপড়ুয়া ছেলেমেয়েরা যখন মাঠে হাত ধরাধরি করে চলাফেরা করে, বাচ্চা-অভিভাবক, এমনকি বিব্রতবোধ করেন স্কুলের শিক্ষকরাও। দুটিই সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ায় কোনোটিই সরানো সম্ভব নয়। যে মাঠটি রয়েছে, মাঝখান দিয়ে একটি বাউন্ডারি বা দেয়াল তুলে পুরোপুরি আলাদা করা হলে শিক্ষাকার্যক্রম স্বাভাবিক রাখা যাবে বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

এদিকে প্রতিবছর স্কুলের নামে উন্নয়ন বরাদ্দ এলেও তা প্রতিবারই ফেরত যায়। ২০২৪ সালে ১০ তলা ভবনের উন্নয়নকাজ এলেও ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় কলেজের ক্লাসরুম থাকায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কলেজ কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি। গত বছর, অর্থাৎ ৫ আগস্টের আগে অ্যাসেম্বলির জন্য পতাকা লাগানোর জন্য বেদি নির্মাণ করতে গেলে কলেজের ওই সময়ের অধ্যক্ষ ছাত্রলীগের ছেলেদের নিয়ে এসে বাধা দেন। সবমিলিয়ে যে যখন ক্ষমতায় থাকে, তারাই স্কুলের উন্নয়ন বা কার্যক্রমে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

‘শিক্ষার্থীরাও ক্লাসে মনোযোগী হতে পারে না। উপস্থিতি বাড়লে বারান্দায় চলে পাঠদান। মাঠে কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও উচ্চ শব্দের ফলে প্রায় সময়ই দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিতে হয়। দরজা বন্ধ না করলে ক্রিকেট বল ক্লাসে এসে যায়, কখনো কখনো শিক্ষক-ছাত্ররা আহত হয় এবং হাসপাতালে পর্যন্ত নিতে হয়। এ ছাড়া কলেজের পরীক্ষা চলাকালীন স্কুলের কার্যক্রম চালানো যায় না এবং স্কুল ছুটি দিতে হয়। রাজনৈতিক অনুষ্ঠান কিংবা কোনো ধরনের ঝামেলায় কলেজের কিছু শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে অবস্থান নিলে স্কুলের ছোট ছোট বাচ্চারা ভয়ে কান্না করতে থাকে। সে সময় অভিভাবক-শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরুপায় হওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকে না।’

জানা যায়, হাজী মুহাম্মদ মহসীন ফান্ডের আর্থিক সহায়তায় কলকাতা মাদ্রাসার আদলে ১৮৭৪ সালে ঢাকা মোহসিনীয়া মাদ্রাসা, ১৯৫৮ সালে ইসলামিয়া হাইস্কুল, ১৯৬৮ সালে ইসলামিয়া সরকারি হাইস্কুল করা হয়। তখনই স্কুলের নামে এসব জমি দান করা হয় এবং এই স্কুল থেকে তিনটি প্রতিষ্ঠান পাশাপাশি করা হয় বলে জানান স্কুলের প্রধান শিক্ষক।

এ ছাড়া এসএসসি পাস করা শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯২৩ সালে স্কুলের সঙ্গে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি চালু না করে আলাদাভাবে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ করা হয়। পরে নাম পরিবর্তন করে ইসলামিয়া সরকারি কলেজ করা হয়। ১৯৭২ সালে কবি নজরুল ইসলাম সরকারি কলেজ নামকরণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে ‘ইসলাম’ শব্দটি বাদ দিয়ে কবি নজরুল সরকারি কলেজ নামকরণ করা হয়। এমনকি ১৯১৬ সালে ইসলামিয়া স্কুল থেকে অ্যাংলো-পার্সিয়ান বিভাগটি আলাদা করে ঢাকা গভ. মুসলিম হাইস্কুল নামকরণ করা হয়।

জানতে চাইলে মাউশির সরকারি কলেজ শাখার সহকারী পরিচালক (কলেজ-১) মুহাম্মদ সফিউল বশর দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘এক প্রতিষ্ঠানের কারণে আরেক প্রতিষ্ঠানের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটবে, এটা ঠিক না। তবে অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভেতর বা সাথে অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা স্কুল থাকলে কলেজের ক্লাস-পরীক্ষার যে ব্যাঘাত ঘটছে, এটা নিয়ে ভাববার বিষয়। শুধু এ স্কুল বা কলেজ নয়, অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানেও এমন ঘটনা ঘটছে।

এ বিষয়ে মাউশির উপপরিচালক মো. শাহজাহান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে জানি না। সব সম্পত্তিই মাউশির। তবে এসব মাউশির মহাপরিচালক ভালো বলতে পারবেন আর আমি এ বিষয়টি দেখিও না।’

এ বিষয়ে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক মুহাম্মদ আজাদ খানের সঙ্গে মোবাইলফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।


সর্বশেষ সংবাদ