কানাডায় পড়তে যেতে যা জানা জরুরি, থাকছে নাগরিকত্বের সুযোগও
- আফরিন সুলতানা শোভা ও সাগর হোসেন
- প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৩, ০২:০৮ PM , আপডেট: ১৩ আগস্ট ২০২৫, ০৩:৫৯ PM
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে উত্তর আমেরিকার দেশ কানাডা। স্থায়ীভাবে বসবাস ও নাগরিকত্বের জন্য কানাডা সব সময়ই অভিবাসীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষের দিকে থাকে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন পাওয়া দিন দিন কঠিন হতে থাকায় কানাডার দিকে ঝুঁকে পড়ছেন অনেকেই।
অর্থনৈতিক সক্ষমতা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে কানাডার অর্জন অন্য দেশগুলোর কাছে ঈর্ষণীয়। উন্নত জীবন-যাপন ব্যবস্থা এবং আধুনিক নাগরিক জীবনের সব সুবিধা থাকার কারণে প্রতি বছর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য মানুষ পাড়ি জমায় নায়াগ্রা জলপ্রপাতের এই দেশটিতে। দেশটির সরকারও জাতিগত বৈচিত্র্য ধরে রাখার লক্ষ্যে এই অভিবাসীদের সাদরে বরণ করে নেয়।
এছাড়া মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর একটি কানাডা। শিক্ষাজীবন শেষে অনেক উন্নত দেশেই চাকরি কিংবা নাগরিক সুবিধা পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা কানাডাকে নিজেদের পছন্দের তালিকার শুরুতেই রাখতে পারেন। কারণ এ দেশে শিক্ষাজীবন শেষে সহজেই পছন্দনীয় পেশায় যোগদান ও নাগরিক সুবিধার ব্যবস্থা রয়েছে।
ইমিগ্রেশন বলতে একটি দেশ থেকে অন্যদেশে কোনো উদ্দেশ্যে, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকা বা সেই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করার প্রক্রিয়াকে বুঝায়। অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য কানাডা প্রতিবছর ৩ লাখের ওপর ইমিগ্র্যান্ট পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে এনে থাকে। আজ থেকে ২০–৩০ বছর আগেও কানাডার ইমিগ্রেশন অনেক সহজ ছিল। দিনে দিনে কানাডা ইমিগ্রেশন সিস্টেমকে জটিল করে ফেলছে। কারণ তারা প্রচুর দরখাস্ত পায়, ফলে অনেক যাচাই-বাছাই করে কানাডা বিদেশ থেকে লোক আনে। চলুন জেনে নেওয়া যাক কানাডার ইমিগ্রেশন সম্পর্কে খুঁটিনাটি বিষয়সমূহ।
কানাডার ইমিগ্রেশন কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে-
(১) এক্সপ্রেস এন্ট্রি (Express Entry)
উচ্চ-দক্ষ কর্মীদের চাহিদা ভিত্তিতে ২০১৫ সালে কানাডা সরকার এক্সপ্রেস এন্ট্রি চালু করে। এক্সপ্রেস এন্ট্রি প্রোগ্রামের প্রসেসিং সময় আনুমানিক ৯ থেকে ১২ মাস হয়ে থাকে। এটি একটি নতুন কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন সিস্টেম যা নীচের প্রোগ্রামগুলির জন্য খুব দ্রুত কানাডার স্থায়ী বাসিন্দা (PR) ভিসার জন্য আবেদনের অনুমতি পান:
• ফেডারেল দক্ষ কর্মী প্রোগ্রাম (FSWP)।
• ফেডারাল দক্ষ ট্রেডস প্রোগ্রাম (FSTP)।
• কানাডিয়ান অভিজ্ঞতা শ্রেণি (CEC) প্রোগ্রাম।
যোগ্যতাসমূহঃ
আইইএলটিএস স্কোর ৭.৫ এবং বয়স ৩০ এর নিচে থাকতে হয়।
(২) আটলান্টিক ইমিগ্রেশন পাইলটঃ
কানাডায় স্থায়ী বসবাসের জন্য আন্তর্জাতিক দক্ষ জনশক্তিরা আটলান্টা প্রভিন্স এ আবেদন করতে পারবেন।
বিস্তারিত জানতে ক্লিক করুন
(৩) কুইবেক ইমিগ্রেশনঃ
কুইবেক এর ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়া অন্যান্য ইমিগ্রেশনগুলো থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এবংস্বতন্ত্র। বছরের যে কোনো সময় নির্দিষ্ট কোটা উল্লেখ করে তাদের প্রোগ্রাম ঘোষণা দেওয়া হয়। সাধারণত এই প্রভিন্সের শর্ত বা যোগ্যতাসমূহ অনেক সহজ ও শিথিলযোগ্য থাকে। কুইবেক-এর প্রোগ্রামগুলো মূলত তিনটি ক্যাটাগরিতে হয়ে থাকে
যেমন: *কুইবেক স্কিল ওয়ার্কার প্রোগ্রাম, *এন্টারপ্রেনার প্রোগ্রাম *কুইবেক এক্সপেরিন্স ক্লাস। প্রতিটি প্রোগ্রামের নিজস্ব শর্তাবলি রয়েছে। প্রয়োজন ও যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো কোনো আইনজীবীর পরামর্শ নিয়ে আপনি আবেদন করতে পারেন।
(৪) আলবার্টা ইমিগ্র্যান্ট নমিনি প্রোগ্রামঃ
কম্পিউটার নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান, সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার, কম্পিউটার প্রোগ্রামার, নার্স, রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার, সেলসম্যান, হেলথকেয়ার ম্যানেজার, অ্যাকাউনটেন্ট পেশার মানুষেরা এই প্রোগ্রামের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

যোগ্যতাসমূহঃ
* স্নাতক অথবা ডিপ্লোমা ডিগ্রীধারী হতে হবে।
* সংশ্লিষ্ট কাজে এক বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে।
* আইএলটিএস সর্ব নিম্ন ৫.৫-৬ থাকতে হবে।
(৫) স্টুডেন্ট ইমিগ্রেশনঃ
কানাডার ষ্টুডেন্ট ভিসা পেতে আপনাকে প্রথমে কানাডার যে =কোন একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার পেতে হবে। এ জন্য আপনাকে প্রথমে আপনার পছন্দসই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবে প্রদত্ত আবেদন করার নিয়ম অনুসারে আবেদন করে, উক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অফার লেটার সংগ্রহ করে নিতে হবে।
স্টাডি পারমিট মূলত আপনার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোর্সের মেয়াদের উপর নির্ভর করে। অর্থাৎ কোর্সের মেয়াদ যদি চার বছর হয় তাহলে আপনার স্টাডি পারমিটের মেয়াদও চার বছর হবে। সাথে অতিরিক্ত ৯০ দিন দেয়া হবে। আপনার স্টাডি প্রোগ্রাম যদি ৬ মাস কিংবা তারচেয়ে কম সময়ের হয়, তাহলে আপনাকে কোনো ধরনের স্টাডি পারমিট নিতে হবে না। যদি আপনার পরিবারের কেউ কানাডা থেকে থাকেন, তাহলেও আপনাকে স্টাডি পারমিট নিতে হবে না। একইভাবে আপনার কিংবা আপনার পরিবারের কারো যদি রেজিস্টার্ড ইন্ডিয়ান স্ট্যাটাস থেকে থাকে, তাহলেও আপনাকে স্টাডি পারমিট নিতে হবে না।
কানাডার স্টাডি পার্মিটের জন্য সর্বপ্রথম সিটিজেনশিপ অ্যান্ড ইমিগ্রেশন কানাডার (CIC) ওয়েবে অনলাইনে আবেদন করতে হয়। অথবা, নিকটস্থ কানাডিয়ান এম্বাসিতে যোগাযোগ করে অফলাইনে আবেদন করতে হয়।
আবেদনের জন্য আপনাকে যা যা সংযুক্ত করতে হবে;
* কানাডার সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার,
* কানাডায় থাকাকালীন আপনার থাকা, খাওয়া ও পড়ার খরচ বহন করার মতো পর্যাপ্ত আর্থিক যোগান রয়েছে, তার প্রমাণপত্র।
* আপনি কোনো প্রকার সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত নেই তার প্রমাণপত্র,
* আপনি পুরোপুরি সুস্থ তার প্রমাণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্ট,
* কানাডায় থাকাকালীন আপনি কোনো প্রকার সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ডে যুক্ত হবেন না, তার অঙ্গীকারনামা।
তবে এই স্টাডি পারমিট দিয়ে আপনি কানাডায় বসবাস করতে পারবেন না। কানাডায় ভ্রমণ ও বসবাসের জন্য আপনাকে টেম্পোরারি রেসিডেন্ট ভিসা অথবা ইলেকট্রনিক ট্র্যাভেল অথোরাইজেশন (ইটিএ) নামক ভিসার জন্য আবেদন করতে হবে।
ভিজিট ভিসা
কানাডায় যারা ভিজিট ভিসায় বেড়াতে আসতে চান। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা করতে আসতে চান তাদের রিকোয়্যারমেন্ট কি সে তথ্য এই লিংক।

৬.বিয়ে করে স্পাউস ভিসায় কানাডায় আসা যায়
কেউ যদি কানাডার কোন নাগরিক বা অভিবাসিকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরী করে, ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে এখানে আসতে পারেন। সে প্রক্রিয়াও সময় সাপেক্ষ বিষয়। সেক্ষেত্রে আপনাকে একজন ভাল ও নিরাপদ অভিবাসি পেতে হবে যাকে বিয়ে করে আপনি স্পাউস ভিসায় কানাডায় আসতে পারবেন।
যে যে বিষয় মাথায় রাখতে হবেঃ-
(১) প্রয়োজনীয় নথিপত্রের নামের বানানঃ
আমাদের দেশে অনেকের নামের বানান একেক জায়গায় একেক ধরনের থাকে। তেমনি আমাদের নামের বানানে অনেক অসঙ্গতি থাকে। কারও নামের শুরুতে এক জায়গায় শুধু মো. থাকে, আবার অন্য জায়গায় মোহাম্মদ থাকে, আবার কোথাও মুহাম্মদ থাকে। সব ডকুমেন্টে একই ধরনের বানান থাকা উচিত, তা না হলে আপনার আবেদনপত্র বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। শুধু নিজের নাম নয়, মা–বাবার নামের বানানও সব জায়গায় এক রকম থাকা জরুরি।
(২) পারসোনাল ইনফরমেশন ডকুমেন্টঃ
যিনি আবেদন করবেন, তাঁর এবং তাঁর ডিপেন্ডেডের (স্বামী/স্ত্রী, সন্তান) মেশিন রিডেবল পাসপোর্ট এবং আবেদনপ্রক্রিয়া চলার সময় কমপক্ষে ছয় মাস পাসপোর্টের মেয়াদ থাকতে হবে। আবেদনপ্রক্রিয়া চলার মধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়ার কমপক্ষে ছয় মাস আগে পাসপোর্ট নবায়ন করে নিতে হবে। আবেদনকারী এবং তাঁর ডিপেন্ডেডদের জন্মনিবন্ধন থাকতে হবে। জন্মনিবন্ধন হতে হবে সরকার প্রদত্ত প্রকৃত জন্মনিবন্ধন।
১৮ বছরের ওপরের সবার ভোটার আইডি কার্ড অথবা ন্যাশনাল আইডি কার্ড থাকতে হবে। বিবাহিতদের জন্য Marriage Certificate এবং নিকাহনামা থাকতে হবে। বাংলাদেশে এ দুটি ডকুমেন্ট এখনো বাংলায় ইস্যু করা হয়। তবে যে কাজি আপনাকে বিয়ে পড়িয়েছেন, তাঁর কাছে আপনি যদি আপনার বাংলা ডকুমেন্ট নিয়ে যান, তবে তিনি একটি নির্দিষ্ট ফির বিনিময়ে তা ইংরেজিতে অনুবাদ করে দেবেন।
(৩) শিক্ষাগত ও ভাষাগত যোগ্যতাঃ
প্রতিটি শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদপত্র ক্রিডেনশিয়াল করতে হবে। অর্থাৎ, আপনি বাংলাদেশে বা পৃথিবীর যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশুনা করেছেন, তার মান কানাডিয়ান স্ট্যান্ডার্ডে কতটুকু, তা তারা দেখে নেবে। আর এ ক্রিডেনশিয়াল করার গাইডলাইন কানাডার ইমিগ্রেশনের সরকারি ওয়েবসাইটে (http://www.cic.gc.ca/) দেওয়া আছে। আইইএলটিএস (IELTS) স্কোরের সার্টিফিকেট জমা দিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি যদি স্টুডেন্ট ভিসায় আসেন, তবে আপনাকে একাডেমিক আইইএলটিএস পরীক্ষা দিতে হবে। আর প্রায় অন্য সব ভিসার জন্য আপনাকে ‘জেনারেল’ আইইএলটিএস দিতে হবে।
(৪) সেটেলমেন্ট ফান্ডঃ
ভিসার জন্য আপনাকে ব্যাংকে সেটেলমেন্ট ফান্ড দেখাতে হবে। বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে টাকার পরিমাণের ভিন্নতা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে ওরা যে টাকার পরিমাণের কথা আপনাকে বলবে, সেই পরিমাণ টাকা ক্যাশ আকারে ব্যাংকে থাকা ভালো। এ টাকা বিভিন্নভাবে থাকতে পারে। যেমন ফিক্সড ডিপোজিট, সঞ্চয়পত্র, চলতি হিসাব, প্রভিডেন্ট ফান্ড, শেয়ারবাজার ইত্যাদি। বাড়তি হিসেবে আপনাদের সোনা-গহনা, নিজ নামে বা স্পাউসের নামে সম্পত্তি থাকলে তা দেখাতে পারেন। শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তাঁদের মাতা–পিতার টাকা এবং সম্পত্তি দেখালেও হবে।
(৫) কাজের অভিজ্ঞতাঃ
কানাডায় আবেদনের ক্ষেত্রে ওয়ার্ক এক্সপেরিয়েন্স একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে কোনো মিথ্যার আশ্রয় নেবেন না। যেমন আপনার বা আপনার স্পাউসের যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঁচ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকে, তবে প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা অভিজ্ঞতার সনদপত্র জোগাড় করতে হবে। একেকটা সনদপত্র এক পাতার বেশি না হওয়াই ভালো। প্রতিটি জায়গায় যিনি আপনাকে এ সনদপত্র প্রদান করবেন, তাঁর নাম, পদবি, স্বাক্ষর, ঠিকানা, ফোন নম্বর এবং ই-মেইল অ্যাড্রেস থাকতে হবে। অনেক ক্ষেত্রে কানাডার ইমিগ্রেশন বিভাগ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তাই যাঁদের কাছ থেকে অভিজ্ঞতার সনদপত্র আনবেন, তাঁদের জানিয়ে রাখবেন। তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা যেন আপনার অভিজ্ঞতাপত্রে যা লিখেছেন, তা বলতে পারেন।
মনে রাখবেন, প্রতিবছর লাখ লাখ আবেদন বাতিল হয়ে যায় আবেদনপত্র পূরণের অভাবে এবং প্রকৃত ডকুমেন্ট না করার কারণে।