জাবি ৪৯ ব্যাচের ক্যাম্পাস ভাবনা

  © টিডিসি ফটো

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অন্যান্য সকল ব্যাচগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি ব্যাচ হলো ৪৯ ব্যাচ। যারা ক্যাম্পাসে অনার্স প্রথম বর্ষ হিসেবেও পরিচিত। প্রতি ব্যাচের মতো ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও ক্যাম্পাসে এসেছিল তবে সেটা মাত্র ৭ দিনের জন্য। অনার্স প্রথম বর্ষকে বলা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় অথচ জাবির ৪৯তম ব্যাচ সেই সুখ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বলা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়েও যারা ফাস্ট ইয়ার উপভোগ করতে পারলো না, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটাই বৃথা। গতবছরের মার্চ মাসের প্রথমদিকে ক্যাম্পাসে পদার্পণ করেছিল অনার্স প্রথম বর্ষ বা ৪৯ ব্যাচ।অজস্র স্বপ্ন আর বুক ভরা আশা নিয়ে পরিবার ছেড়ে প্রাণের ক্যাম্পাসে এসেছিল একঝাঁক স্বপ্ন পিপাশু তারুণ্য। নতুন ক্যাম্পাসে নিজেদেরকে নতুন ভাবে তৈরি করার যে শপথ নিয়েছিলো, সেই শপথ বাস্তবায়ন করার পূর্বেই তাদেরকে ছাড়তে হয়েছে প্রাণের ক্যাম্পাস।

শিক্ষা জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় বলা হয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবনকে। যে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সূচনা হয় অনার্স ফার্স্ট ইয়ারের মধ্যে দিয়ে। শতশত স্বপ্নকে সঙ্গে নিয়ে, নিজেকে বিশ্ব পরিমন্ডলে উপস্থাপন করার লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে আসে হাজার হাজার উচ্চ শিক্ষা পিপাসু তরুণ-তরুণী। উচ্চ মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চ শিক্ষার তাগিদে জ্ঞান পিপাসু শিক্ষার্থীরা ভর্তি কাঙ্ক্ষিত বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষার্থীদের হাঁসি ঠাট্টা আর গল্প আড্ডায় মাতিয়ে তোলার কাঙ্ক্ষিত সময় হলো অনার্স প্রথম বর্ষ। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস সম্পর্কে জানার, বোঝার, বন্ধুত্বের সম্পর্কটাকে মজবুত করার সময় হলো অনার্স প্রথম বর্ষের সময়টুকু।

এমনই একটি বিদ্যাপীঠ হলো জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রতি ব্যাচের মতো নবীন শিক্ষার্থীদের সাজে সজ্জিত হয়ে ক্যাম্পাসে এসেছিল জাবি প্রথম বর্ষ ।যারা ক্যাম্পাসে ৪৯ ব্যাচ হিসেবেও সমধিক পরিচিত। প্রাণবন্ত ক্যাম্পাসের অপরূপ সৌন্দর্যের প্রকৃতিকে আপন করে পাবার যে ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা তারা মনের মধ্যে পোষণ করেছিল,সেই ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষা গুলো মুহূর্তের মধ্যে তছনছ করে দেয় মহামারী করোনাভাইরাস এসে। শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে রাষ্ট্র সরকার বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে দেয়। নিজেদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন ও ইচ্ছে গুলো হাতের মুঠোয় পেয়েও তা বাস্তবায়ন করতে পারলো না তারা। সব স্বপ্ন, কল্পনা গুলো অদৃশ্য শক্তির কাছে সঁপে দিয়ে যে পথে এসেছিল ক্যাম্পাসে, ঠিক সেই পথেই আবার তারা ফিরে যায়।

দীর্ঘ একটি বছর এভাবেই বাড়িতে বসে প্রাণের ক্যাম্পাসকে বুকে ধারণ করে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে তারা। তাদের কল্পনা গুলো, ইচ্ছা গুলোকে বাস্তবে রূপদান করতে না পারলেও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোতে তা পোস্ট করে ব্যক্ত করছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অনার্স প্রথম বর্ষের (৪৯ ব্যাচ) শিক্ষার্থী শবনম জেরিন লাক্সমি বলেন, ক্যাম্পাস! শব্দটা মনে আসলেই প্রথমেই আসে না পাওয়ার একটা বড় দীর্ঘশ্বাস! দুই বছরের না পাওয়ার হতাশা কি মাত্র ৭ দিনে মেটে? এই জীবাণু এসেই যেন সব এলোমেলো করে দিলো। আশেরপাশের মানুষ গুলোকে যেন নতুন রূপে দেখছি। এত ভয়, এত আতঙ্কের মধ্যে আমাদের আর ফেরা হলো না। শূণ্য ক্যাম্পাস হয়তো আমাদের যাওয়ার দিন গুনছে। আবার গিয়ে বসবো একসাথে সবাই মুক্তমঞ্চে। বিকালে আড্ডা দেব একসাথে শহীদ মিনারে। চৌরঙ্গীতে একসাথে বসে গান গাইবো। মুরাত চত্বর, টারজান, উচু বটে যাওয়া বাকি এখনো।আবার আলো জ্বলবে রাস্তার দুই ধারে,সারা ক্লাস কথা, খেলা আর খাতায় লেখা হবে অসম্ভব বোরিং সময় পারের অসাধারণ উপাখ্যান। একদিন ফোন কলে বন্ধুদের “আরো ভালো লাগছেনা, ক্যাম্পাস খুলবে কবে” বলা শেষ হবে। সেই সুদিনের অপেক্ষায় আছি।

৪৯ ব্যাচের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী ইরফান সাদিক রাজিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ক্যাম্পাস’ শব্দটিই একটি অন্যতম আগ্রহের নাম, বলা হয় ফার্স্ট ইয়ার হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়।অথচ, করোনা মহামারীর কারণে আমরা সেই শ্রেষ্ঠ সময় কাটাচ্ছি ঘরে বসে বসে, তীব্র বিষণ্ণতায় ডুবে।২০২০ এর মার্চে যখন প্রথম লকডাউন ঘোষণা করা হয়, কে জানতো দীর্ঘ এক বছরেও খুলবে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো?বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হবার কারণে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাদ, ক্যাম্পাসের বর্ণাঢ্য জীবন উপভোগ করার সুযোগ হয়ে ওঠেনি আমাদের। নতুন বন্ধুদের সাথে মেশা, আড্ডা, বিশ্ববিদ্যালয়ের কালচার, ক্লাব, নানা ধাঁচের সংগঠন কিছুই পাইনি আমরা।

উদ্ভূত এই পরিস্থিতিতে ক্লাস সচল ও স্বাভাবিক রাখতে শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। বাসায় বসে অনলাইন ক্লাস করার সুযোগ ও সামর্থ্য না থাকায় অনেকেই ক্লাস চালিয়ে যেতে পারেনি। করোনা পরিস্থিতি শুধু যে ক্যাম্পাস-জীবনই অবরুদ্ধ রেখেছে তা নয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য শিক্ষার্থী মানসিকভাবে বিপর্যস্তও হয়েছে এই সময়ে। বাসায় বসে থেকে অনেকেই বিষণ্ণতায় ভুগছে, আত্মহত্যা প্রবণতা বেড়ে গেছে আগের চেয়ে বহুগুনে। দ্রুত এই পরিস্থিতির উন্নতি হোক, আমরা ফিরে আসি স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এই আশাই করি।

ইনস্টিটিউট অফ ইনফরমেশন টেকনোলজি বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী নওশীন ঊলফাত সুকন্যা বলেন, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২০, ভর্তি পরীক্ষা দেয়ার উদ্দেশ্যে তখনই প্রথম পদার্পণ ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রথম দিনেই সবুজ শ্যামলে ঘেরা মনোরম পরিবেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম। সিট ছিল সমাজবিজ্ঞান অনুষদে, পরীক্ষা দেয়া মাত্রই ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে হয়েছিল, সেভাবে ঘুরে দেখার কোনো সুযোগই ছিল না। ভর্তি হবার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ক্যাম্পাস খোলার কথা থাকলেও তা পেছালো মার্চের ১০ তারিখ। অগত্যা ৫ দিন ক্লাস করার পরই বন্ধ হয়ে গেল প্রাণের ক্যাম্পাস। না পারলাম কারো সাথে পরিচিত হতে, না হলো ক্যাফেটেরিয়া ও চায়ের দোকানে আড্ডা দেয়া। সবাই মিলে ক্যাম্পাসে ঘোরাঘুরি, সিনিয়রদের ভালোবাসা ও ট্রিট, নতুন নতুন বন্ধুত্ব সবই চাপা পরে গেল অনলাইন ক্লাসের ভারে। যতই দিন যাচ্ছে মনে হচ্ছে আমাদের সময় ফুরিয়ে আসছে। ক্যাম্পাসে কাটানো দিনগুলির স্মৃতির পাতায়ও যেন ধূলো জমে গেছে। কিছুই করার নেই, শুধু অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকি আর ভাবি কবে শেষ হবে এই ঘরবন্দী জীবন আর কবে ফিরতে পারবো সবুজের কাছাকাছি, আমার ক্যাম্পাস জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী আল মাহমুদ বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়! একটি স্বপ্ন, একটি যুদ্ধ, একটি বিজয়। কিন্তু স্বপ্ন ধরা দিয়েই মেতে উঠল নিষ্ঠুর লুকোচুরিতে। শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় জানবিবিকে ছেড়ে চলে আসতে হয় বাড়িতে। করোনার প্রভাব ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ক্যাম্পাস খোলার তারিখ পিছাতে থাকে যা অদ্যাবধি চলমান। সবুজ সর্গের সংস্পর্শের বাইরে থাকা কতটা কষ্টকর সেটা শুধুমাত্র জাবিয়ান-৪৯ ব্যাচই বুঝতে পারবে। না হচ্ছে লেখাপড়া, না হচ্ছে বন্ধুদের সাথে গল্প-আড্ডা ।এই কষ্টের চেয়েও বেশি কষ্ট হবে তখন যখন দেখব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুরা কোর্স শেষ করে চাকরি করবে আর আমরা সেশনজটে পরে জীবন-যৌবন পার করব। তাই যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বিনীত অনুরোধ- আমরা অতীত হারিয়েছি কিন্তু ভবিষ্যৎ হারাতে চাই না।

করোনা মুক্ত হয়ে আবার তারা ফিরতে চায় প্রাণের বিভাগে, প্রাণের ক্যাম্পাসে। ভালোবাসার স্বপ্নগুলো আবার তারা বাস্তবায়ন করতে চায়। হাঁসি ঠাট্টা আড্ডা গানে প্রাণের বন্ধুদের সাথে আবার তারা মেতে উঠতে চায়, এমনটাই প্রত্যাশা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের।

লেখক: শিক্ষার্থী, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়


সর্বশেষ সংবাদ

×
  • Application Deadline
  • December 17, 2025
  • Admission Test
  • December 19, 2025
APPLY
NOW!
GRADUATE ADMISSION
SPRING 2026!
NORTH SOUTH UNIVERSITY
Center of Excellence