অনলাইনে পরীক্ষা, যা ভাবছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা
- আবদুর রহমান
- প্রকাশ: ০৫ জুলাই ২০২১, ০৪:৩৫ PM , আপডেট: ০৫ জুলাই ২০২১, ০৪:৩৫ PM
করোনা মহামারির কারণে দীর্ঘ এক বছরের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময়ে অনলাইনে ক্লাস হলেও পরীক্ষা না হওয়ায় শিক্ষার্থীরা ভয়াবহ সেশনজটে পড়েছেন।
ফলে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষার্থীদের নতুন সেশন শুরু হওয়ার কথা থাকলে জুন মাস পেরিয়ে গেলেও তা হয়নি। করোনার প্রকোপ দিন দিন বাড়তে থাকায় নতুন করে আবারও কঠোর লকডাউনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অন্যদিকে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আরেকদফায় বাড়িয়ে ৩১ জুলাই পর্যন্ত করা হয়েছে। এতে করে শিগগির পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় খোলা নিয়েও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
এ অবস্থায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সেশনজট কমাতে বিকল্প পদ্বতি হিসেবে অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার অনুমতি দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা গ্রামে ও প্রত্যন্ত এলাকায় বসবাস করায় অনলাইনে পরীক্ষা না দিয়ে সশরীরে বা অ্যাসাইনমেন্ট আকারে পরীক্ষা দেওয়ার পক্ষে মতামত দিয়েছেন।
তারা বলছেন, ইন্টারনেট সমস্যার কারণে যেসব শিক্ষার্থীরা ক্লাস করতে পারেননি, অনলাইনে পরীক্ষা হলেও সেসব শিক্ষার্থীরা পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবেন না। শিক্ষার্থীরা অনলাইনে পরীক্ষা দিতে নারাজ হলেও অ্যাসাইনমেন্ট অথবা সরাসরি পরীক্ষা দিতে চান তারা। যদি জুলাইয়ের মধ্যে দেশে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তাহলে তারা সশরীরে পরীক্ষা দিতে চান। আর যদি এই সময়ের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয় তাহলে অ্যাসাইনমেন্টের মাধ্যমে পরীক্ষা দিতে চান। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণার ওপর গুরুত্ব দিতে চান। শিক্ষার্থীরা চান, তাদের এমন অ্যাসাইনমেন্ট হোক, যা হবে গবেষণাধর্মী এবং তা বাড়িতে বসে সম্পন্ন করা সম্ভব।
অনলাইন পরীক্ষার বিপক্ষে মত দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী আজিবুর রহমান। তিনি বলেন, আমাদের বিভাগের অর্ধেকেরও কম শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাসে উপস্থিত থাকেন। বাকিরা যারা অনলাইন ক্লাস করতে পারেন না তারা কীভাবে অনলাইনে পরীক্ষা দিবে তা চিন্তার বিষয়। তাছাড়া গ্রামে ও প্রত্যন্ত একালায় দুর্বল নেটওয়ার্ক ও ডিভাইস সমস্যা তো আছেই। অ্যাসাইনমেন্ট হলে আমাদের জন্য খুব ভালো হতো।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় সশরীরে পরীক্ষা নেওয়ার পরিবর্তে অনলাইনে নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও ইনস্টিটিউটগুলোকে নিদের্শনা দিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) কর্তৃপক্ষ। তবে চলমান কঠোর লকডাউনের মধ্যেই পরীক্ষা নেওয়া হবে না জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
অনলাইনে কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে পরীক্ষা নেওয়া হবে এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশিকা ইতোমধ্যে ঢাবি উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল নির্দেশনা অনুযায়ী তৈরি করে, তা সংশ্লিষ্ট অনুষদ এবং বিভাগগুলোতে পাঠানো হয়েছে। এদিকে নির্দেশনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে পাওয়া যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর হাসান শান্ত বলেন, সার্বিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও উন্নত ইন্টারনেট ব্যবস্থা ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা পরিচালনা বেশ অবাস্তব চিন্তা। বহু শিক্ষার্থী এখন এমন স্থানে আছেন, যেখানে ইন্টারনেট সংযোগ খুব দুর্বল। সবাই যদি একই রকম সুযোগ-সুবিধা না পায়, তাহলে অনলাইন পরীক্ষা নিবে কিভাবে? নেটওয়ার্ক জটিলতায় বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই আমরা অনলাইন ক্লাস করতে পারিনি।
ঢাবির ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী মির্জা নুর-উন-নবী বলেন, অনলাইন পরীক্ষাপদ্ধতিতে যদি খুব অল্প সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয় তাহলে সেটি শিক্ষার্থীদের জন্য ফলপ্রসু হবেনা। কারণ সেই নির্দিষ্ট সময়ে নেটওয়ার্ক জটিলতায় শিক্ষার্থীদের মাঝে অনেকে ভোগান্তিতে পড়তে পারে।
“তবে যদি অনলাইনের মাধ্যমে কয়েক দিন বা একটু বেশি সময় দিয়ে অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে সেমিস্টার শেষ করা যায় তাহলে সেটি আমাদের জন্য সুবিধাজনক হবে। তবে এ ক্ষেত্রে সিলেবাস কমিয়ে শিক্ষকদের প্রশ্নপত্র প্রণয়ণ করতে হবে, যেহেতু শিক্ষার্থীদের মাঝে একটি বড় অংশ অনলাইন ক্লাসের বাইরে ছিল।”
এদিকে, শিক্ষার্থীদের সেশনজট নিরসনে কঠোর লকডাউনের মধ্যেই প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষের সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া শুরু করেছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত বৃহস্পতিবার (১ জুলাই) বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু সংখ্যক বিভাগের পরীক্ষা অনলাইনে নেওয়া হয়েছে।
অনলাইন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে মত দিয়ে শিক্ষার্থীদের একাংশ জানান, করোনার কারণে দীর্ঘদিন যাবত আমরা ঘরবন্দি। অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে আমাদের শিক্ষাজীবন। এমতাবস্থায় শেষনজট এড়াতে অনলাইন পরীক্ষা পদ্ধতি আমাদের জন্য খুব উপকার করেছে। নেটওর্য়াক ডিভাইস সংকটসহ কিছু ক্রটিবিচ্যুতি থাকবে তবে আশা করছি পর্যায়ক্রমে এই সমস্যাগুলো নিরসন হবে।
এই করোনার এই মহামারির মধ্যে সশরীরে পরীক্ষা দেওয়ায় ঝুঁকি থেকেই যায়। করোনার প্রকোপ ও ওঠানামা করছে দিন দিন। আমাদের মধ্যে এই সংকট বেড়েই চলেছে। করোনার দিন দিন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এমতবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন সিদ্ধান্তকে আমরা সাধুবাদ জানায়। অন্যদিকে আমাদের যুগ প্রযুক্তির যুগ। এই যুগের মোটামুটি সব ছেলেমেয়েরাই মোবাইল ফোন/কম্পিউটার ব্যবহার সম্পর্কে জানে। বর্তমানে অনেক কম মূল্যে আমরা এসবের আওতাভুক্ত হতে পারি এবং অনলাইনে ক্লাস, পরীক্ষা দিয়ে ঝুঁকি থেকে এড়িয়ে থাকতে পারি।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (শাবিপ্রবি) বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী জান্নাতুল ফেরদাউস সাবিহা বলেন, অনলাইনে পরীক্ষা নেওয়ার যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে সেটিতে অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক অবস্থায় সমস্যায় পড়বে। তবে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে গেলে অনলাইন পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের আয়ত্তে চলে আসবে। যেভাবেই হোক দ্রুত সময়ে সার্বিক বিবেচনায় ও সুবিধাজনক উপায়ে পরীক্ষা নিয়ে নেয়া উচিত। দীর্ঘ সেশনজট শিক্ষার্থীদের মানসিকভাবে ক্ষতি করছে।
কুবির এক তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থীর অনলাইন পরীক্ষায় অনীহা: কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) এক তৃতীয়াংশেরও বেশি অথ্যাৎ ৩৪ ভাগ শিক্ষার্থী অনলাইনে পরীক্ষা দিতে আগ্রহী নন। আর ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইনে পরীক্ষা দিতে চান। বাকী ৩৪ শতাংশের মধ্যে অনলাইনের বিপক্ষে ১৭ শিতাংশ, ঈদের পর সশরীরে পরীক্ষা দিতে চান ১৫ শতাংশ, এসাইনমেন্টের মাধ্যমে মূল্যায়ন চান ১ শতাংশ এবং বাকীরা অটোপাশ ও শুধুমাত্র ইনকোর্স অনলাইনে দিতে চান। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির (কুবিসাস) গ্রুপে পরিচালিত এক অনলাইন জরিপে মোট ১ হাজার ৬৪৩ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেন। গত শুক্রবার (২ জুলাই) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমরান কবির চৌধুরী শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে অনলাইনে পরীক্ষা নেয়া হবে জানালে ওইদিন রাত থেকে এ জরিপ পরিচালনা করা হয়।
অনলাইনে পরীক্ষা নিচ্ছে জাবি: করোনার মধ্যে সেশনজট কমানোর লক্ষ্যে অনলাইনেই একাডেমিক পরীক্ষা নিচ্ছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) কর্তৃপক্ষ। তিনটি ধাপে নেওয়া হচ্ছে অনলাইনে পরীক্ষা। এর মধ্যে অ্যাসাইনমেন্ট, ওপেন বুক এক্সাম ও ভাইভা। অ্যাসাইনমেন্টে ১০ নম্বর, ওপেন বুক এক্সামে ১০ নম্বর এবং ভাইভায় ৩০ নম্বরে রাখা হয়েছে। এই ৫০ নম্বরকে আবার ৭০ নম্বরে রূপান্তর করা হবে। পাশাপাশি ক্লাস অনুশীলন পরীক্ষার ২০ নম্বর এবং ক্লাসে উপস্থিতির ১০ নম্বর এই ১০০ নম্বরে পরীক্ষা নেওয়া হবে।