কেন বারবার হারছে জাবির ভিসিজোট!
- বেলাল হোসেন, জাবি
- প্রকাশ: ২২ জুন ২০১৯, ০৮:৫৫ PM , আপডেট: ২২ জুন ২০১৯, ০৯:৫১ PM
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) অভ্যন্তরীণ কোন্দলে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে ভরাডুবির পর এবার সিনেট সিন্ডিকেটে হেরে গেছেন জাবির ভিসিপন্থি প্রার্থীরা। প্রশ্ন উঠেছে, কেন বারবার হেরে যাচ্ছেন জাবির ভিসিপন্থিজোট? জানা যায়, গত ১৭জুন অনুষ্ঠিত একাডেমিক কাউন্সিল নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরেও কলেজ অধ্যক্ষ ক্যাটাগরিতে সিনেট প্রতিনিধির ৫ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪ জন এবং সিন্ডিকেট প্রতিনিধির দুইজন প্রার্থীর মধ্যে ১ জন ভিসি সমর্থিত প্রার্থী পরাজিত হন।
সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার পরেও ভিসিজোটের বারবার হেরে যাওয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতির মধ্যে ‘অবিশ্বাস-সন্দেহ’ চরম আকার ধারণ করেছে।
গত জানুয়ারীতে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতার থাকার পরেও গড়ে ৫০ ভোটে হেরেছিল ভিসি প্যানেল। অনুসন্ধানে পরাজয়ের কারণ হিসেবে উঠে আসে সম্পাদক প্রার্থী নিয়ে নিজেদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল, বাসা ভাড়া ভাতা কমানো নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে অসন্তোষ, সিনিয়র শিক্ষকদের ডিঙিয়ে জুনিয়র শিক্ষকদের ‘এ’ টাইপ (প্রথম শ্রেণী) বাসা বরাদ্দ, প্রশাসনে জুনিয়রদের পদায়ন নিয়ে সিনিয়র শিক্ষকদের অসন্তোষ। বিপরীতে আওয়ামীলীগের একাংশসহ গঠিত ত্রিদলীয় ‘সম্মিলিত শিক্ষক সমাজ’ সভাপতি, সম্পাদকসহ ১০টি পদে জয়লাভ করেন।
পরিস্থিতির চাপে পড়ে ভিসি অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর শরাণাপন্ন হন। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমঝোতায় আওয়ামীলীগের ‘বিদ্রোহী’ অংশ ভিসির সাথে এক হলে লিখিতভাবে ভিসিজোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বিদ্রোহী অংশের সাথে ফারজানাপন্থি অংশের ‘অবিশ্বাস-সন্দেহ’ এখনো রয়ে গেছে। যার সর্বশেষ প্রতিফলন হচ্ছে সিনেট সিন্ডিকেট নির্বাচনে জোটের হার।
সম্প্রতি ভিসিপন্থি এক শিক্ষকের মন্তব্যে এই সন্দেহ আরও সুদৃঢ় হয়েছে। উপাচার্যপন্থি শিক্ষক অধ্যাপক আলী আজম তালুকদার নির্বাচনের হার নিয়ে গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমরা যারা আগে থেকে উপাচার্যের সঙ্গে ছিলাম তাদের এবং নতুন যোগ দেওয়া শিক্ষকদের মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি অবশ্যই রয়েছে। এ ঘাটতির কারণেই হয়তো নির্বাচনে আমাদের ভরাডুবি। উপাচার্য এ বিষয়ে এখনই সচেতন না হলে সামনে তাকে আরও বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।’
তবে সম্প্রতি যোগ দেওয়া অংশের নেতা অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার এই দাবি অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘যেসব শিক্ষক এ ধরনের বক্তব্য দিচ্ছেন তারা আসলে নিজেদের দুরবস্থা ঢাকতে চাচ্ছেন। আমাদের মধ্যে বিশ্বাস-যোগ্যতার কোনো ঘাটতি নেই।’
জৈষ্ঠ্য শিক্ষকরা বলছেন, সমঝোতার পরেও অস্বস্তিতে দুপক্ষের শিক্ষক নেতারা। বিভিন্ন সময় শিক্ষক নেতারা সাংবাদিকদেরকে অস্বস্তির কথা জানিয়েছেন। ভিসিজোটে যোগ দেওয়া শিক্ষক নেতারা আশা করেছিলেন, সবকিছু আগের মতো হয়ে যাবে। প্রশাসনিকভাবে তারা মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু আদতে সেটা ঘটেনি। সূত্র বলছে, ভিসিজোটে যোগ দেওয়া নতুন শিক্ষকদের মূল্যায়ন করতে গেলে, আগে থেকেই যারা ভিসির সঙ্গে আছেন, তাদের অসন্তোষের মুখে পড়তে পারেন ভিসি। এই অন্তর্দ্বন্দ্বকে নির্বাচনে পরাজয়ের কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা।
জানা যায়, যোগ দেওয়ার পরেও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ইফতারের দাওয়াতে ভিসি অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষকদের নিয়ে যাননি। এই কারণে অনেক শিক্ষক অসন্তুষ্ট। এছাড়া প্রায় ১১৩ জন নতুন শিক্ষক যোগ দেওয়ার পরেও ভিসিপন্থি শিক্ষক সংগঠনের কিঞ্চিত নাম পরিবর্তন করা হলেও শীর্ষ পদে তাদের মধ্যে কাউকে রাখা হয়নি। এটাও একটা ক্ষোভের কারণ।
অন্যদিকে, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ১৪৪৫ কোটি টাকার মেগাপ্রকল্প নিয়ে যোগ দেওয়া শিক্ষকসহ উপাচার্যপন্থি অনেক সিনিয়র শিক্ষককে অন্ধকারে রাখা হয়েছে। এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা ব্যালটে তার জবাব দিয়েছে বলে জানা যায়।
পরিবহনের দায়িত্বপ্রাপ্ত ভিসিপন্থি শিক্ষক আলী আজম তালুকদারের আরেকটি মন্তব্যেও ভোটারদের অসন্তুষ্ট করে বলে জানা গেছে। ভোটের দিন ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া শিক্ষক বাস ছিল বিকেল ৫টায়। কিন্তু ভোট দেওয়ার শেষ সময় ছিল মাগরিবের নামাজ পর্যন্ত। নির্বাচনকালীন সময়ে ঐ শিক্ষক ‘বিকেল ৫টার পর কোন বাস দিতে পারবেন না’ বলে ঘোষণা করেন তিনি। এমন বিতর্কিত ঘোষণা অনেক ভোটার ভালভাবে নেয়নি বলে জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
অন্যদিকে ভিসিপন্থি শিক্ষক পর্ষদের সম্পাদক অধ্যাপক বশির আহমেদ নির্বাচনের সময় দেশের বাইরে ছিলেন। নির্বাচনে ভোট চেয়ে অনেক শিক্ষকদের কাছে শুভেচ্ছা বার্তাও পাঠানো হয়নি দলের পক্ষে।
এদিকে ভিসির একান্ত সচিব সানোয়ার হোসেনের ‘খবরদারি’ নিয়ে অনেক সিনিয়র শিক্ষক ক্ষোভের কথা জানান প্রতিবেদকের কাছে। তারা বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করছি এক যুগের চেয়ে বেশী সময় ধরে। কিন্তু একজন কর্মকর্তা হঠাৎ করে বাঘা বাঘা শিক্ষক নেতাদের চেয়ে প্রভাবশালী হয়ে গেছে। এটা তো মেনে নেওয়া যায় না।’
এর পাশাপাশি প্রশাসনের রদবদলের শুরু থেকে থাকা ভিসিপন্থি জুনিয়র শিক্ষকদের প্রাধান্য দেওয়াকে একটি বার্তা হিসেবে নিচ্ছেন সদ্য যোগ দেওয়া শিক্ষকরা। জানা যায়, গত ২৩ মে বিশ্ববিদ্যালয়ে মীর মশাররফ হোসেন ও আল বেরুনী হলের প্রভোস্টের মেয়াদ শেষ হলে দুইজন ওয়ার্ডেনকে চলতি দায়িত্ব দেওয়া হয়। যাদের দুইজনই সহযোগী অধ্যাপক। সদ্য যোগ দেওয়া একাধিক সিনিয়র অধ্যাপক এই পদদ্বয়ের দাবিদার ছিলেন।
আরেকটি বিশ্লেষণ বলছে, এই নির্বাচনে ভিসিজোট মূলত কলা ও মানবিকী অনুষদের ভোট থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এই অনুষদে প্রভাবশালী একজন অধ্যাপক নিজেকে জানান দিতে নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করেন। তিনি ভিসি পন্থিদের ভোট না দিতে উদ্বুদ্ধ করেছেন বলেও ভিসিপন্থি এক শিক্ষক দাবি করেছেন।
যোগাযোগ করা হলে ভিসিপন্থি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পর্ষদের সভাপতি অধ্যাপক মান্নান চৌধুরী বলেন, ‘আমরা কেন হেরেছি এটা আলোচনার বিষয়। আমাদের অনেক শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে আমরা ঠিকমত পৌঁছাতে পারিনি। নির্বাচনে আমরা সিরিয়াস ছিলাম না। ভবিষ্যতে আমরা সতর্ক থাকব।’
ভিসিপন্থি এক অধ্যাপকের বিতর্কিত মন্তব্য নিয়ে দলের অবস্থান জানতে চাইলে তিনি জানান তাঁদের দলের সম্পাদক দেশের বাইরে আছেন তিনি ফিরে আসলে এই ব্যাপারে জানানো হবে।